খাদ্যনালির ক্যানসারের কারণ ও লক্ষণ, প্রতিরোধ করবেন যেভাবে

দেশে খাদ্যনালির ক্যানসার ভয়াবহভাবেই বাড়ছে। নারী-পুরুষ সমানভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন এই রোগে। খাদ্যনালির ক্যানসার সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ।
খাদ্যনালির ক্যানসার কী ও কেন হয়
ডা. ফারুক আহমেদ বলেন, পরিপাকতন্ত্রের যে অংশ গলা থেকে পাকস্থলী পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে, যা নলের মতো, সেটিকে খাদ্যনালি বলে। খাদ্যনালির প্রধান কাজ হচ্ছে খাবার ও তরল মুখ থেকে পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া।
খাদ্যনালিতে যেসব টিউমার হয় তার মধ্যে ক্যানসারযুক্ত টিউমার সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ক্যানসারযুক্ত টিউমার হলো ম্যালিগন্যান্ট টিউমার যা অপ্রতিরোধ্য এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এক সময় খাদ্যনালির বাইরেও ছড়িয়ে যেতে পারে। খাদ্যনালির আশপাশের অঙ্গ এমনকি দূরর্বতী অঙ্গেও ম্যালিগন্যান্ট টিউমার ছড়িয়ে যেতে পারে।
সারা বিশ্বে তথা বাংলাদেশে শনাক্ত হওয়া সাধারণ ক্যানসারগুলোর মধ্যে একটি হলো খাদ্যনালির ক্যানসার বা ইসোফেগাল ক্যানসার। বাংলাদেশে নারী ও পুরুষ সব মিলিয়ে সবার মধ্যে এই ক্যানসার রয়েছে শুরুর দিকে।
খাদ্যনালির ক্যানসার কেন হয় তার সঠিক কারণ জানা না গেলেও ক্যানসার হওয়ার পেছনে কিছু কারণকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন-
১. অপুষ্টি ও ভিটামিনের অভাব খাদ্যনালির ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষ করে ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব।
২. নাইট্রোসামাইন নামক উপাদান যা তামাকে থাকে, অন্যান্য অনেক খাবারেও থাকে। নাইট্রোসামাইন বেশি আছে এমন খাবার খাওয়ার কারণে খাদ্যনালির ক্যানসার হতে পারে।
৩. সবসময় গরম চা, গরম কফি, গরম পানীয় পান করার অভ্যাস খাদ্যনালির ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. ধূমপান, তামাকজাত দ্রব্য সেবন, মদ্যপান খাদ্যনালির ক্যানসারের অন্যতম কারণ। পান, সানফ্লাওয়ার সিড যারা বেশি পরিমাণে খান তাদেরও ঝুঁকি বেশি।
৫. কিছু কিছু রোগ আছে যেগুলোর কারণে খাদ্যনালির ক্যানসার বেশি হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো অ্যাকালাসিয়া কার্ডিয়া নামক রোগ। যার কারণে খাদ্যনালির নিচের অংশ ঠিকভাবে প্রসারিত হতে পারে না, ফলে খাবার সহজে পাকস্থলীতে যেতে পারে না। দীর্ঘদিন এই রোগ থাকলে খাদ্যনালির ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৬. এছাড়া গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ, যার কারণে পাকস্থলীর অ্যাসিড বারবার খাদ্যনালিতে উঠে আসে এবং জ্বালাপোড়া ও প্রদাহ সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিন এই রোগখাদ্যনালির ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
৭. কোনো কারণে যদি খাদ্যনালিতে ক্ষত হয়, যেমন- ভুলবশত বিভিন্ন রাসায়নিক, অ্যাসিড জাতীয় দ্রব্য পান করলে খাদ্যনালী সরু হয়ে যায়। পরে চিকিৎসা না করলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।
৮. বয়স্কদের মধ্যে খাদ্যনালির ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
লক্ষণ
১. খাবার গিলতে সমস্যা হওয়া। খাবার গলায় বা বুকে আটকে যাবে। নিচে নামতে পারবে না।
২. প্রথম দিকে শক্ত খাবার গিলতে অসুবিধা হবে, ধীরে ধীরে তরল খাবার গিলতেও অসুবিধা হবে।
৩. স্বাভাবিক অবস্থায় ঢোক গিলতে কষ্ট হয় না, কিন্তু খাদ্যনালির ক্যানসারে ঢোক গিলতে ব্যথা হতে পারে।
৪. খাদ্যনালির ক্যানসার অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে ব্যথা হতে পারে, যেমন- লিভারে ছড়ালে পেটের ডানদিকে ব্যথা, লিভার বড় হয়ে যাওয়া, জন্ডিস হওয়া। মস্তিষ্কে ছড়ালে মাথা ব্যথা, বমি ও খিঁচুনির উপসর্গ দেখা দিবে।
৫. খাবার সঠিকভাবে নিচের দিকে নামতে না পারলে জমে থেকে তা শ্বাসনালীতে চলে আসতে পারে। এর ফলে শ্বাসকষ্ট, কাশি ও জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
চিকিৎসা
ডা. ফারুক আহমেদ বলেন, অ্যান্ডোস্কোপির মাধ্যমে খাদ্যনালির ক্যানসার শনাক্ত করা যায়। এই পরীক্ষায় খাদ্যনালীর টিউমার দেখা যায়। আর ক্যানসার কোষ আছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বায়োপসি করা হয়। এ ছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় রোগীর।
খাদ্যনালির ক্যানসার সময় মত শনাক্ত হলে প্রথম ও প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে অস্ত্রোপচার। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিউমার ফেলে দিলে রোগী অনেক দিন ভালো থাকবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়, যখন রোগীর অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয় না। খাদ্যনালির ক্যানসার যদি শেষ পর্যায়ে ধরা পরে যখন অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি দেওয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে রোগীর কষ্ট কমানোর জন্য প্যালিয়েটিভ থেরাপি দেওয়া হয়।
তবে ক্যানসারের আকার, ধরন এবং রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়।
প্রতিরোধ
খাদ্যনালির ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতন হতে হবে। ধূমপান, অ্যালকোহল, পান, তামাকজাত দ্রব্য সেবন পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত গরম চা, কফি ও পানীয় কম পান করতে হবে। পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খেতে হবে, ভিটামিন ও মিনারেলস আছে এমন খাবার বেশি খেতে হবে। যেসব রোগের কারণে খাদ্যনালির ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে সময়মতো সেসব রোগের চিকিৎসা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
Comments