যে বিপণন কৌশলে বাড়তে পারে বইয়ের বিক্রি

অনেকে প্রায়ই অভিযোগ করেন, ‘বইয়ের বিক্রি কমে গেছে। মানুষ আগের মতো বই কেনে না।’ হয়তো এটি সত্যি! কিন্তু এটাও সত্যি, বই বিপণনে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। অনেক লেখক-প্রকাশক জানেন না কীভাবে একটি বইয়ের বিক্রি বাড়াতে হয়, কিংবা বই বিপণনে করণীয় কী। ফলে, বেশিরভাগ লেখকের বইয়ের বড় একটি অংশ অবিক্রীত থেকে যায়।
বই, বই বিপণন,
ফাইল ফটো, অর্কিড চাকমা

অনেকে প্রায়ই অভিযোগ করেন, 'বইয়ের বিক্রি কমে গেছে। মানুষ আগের মতো বই কেনে না।' হয়তো এটি সত্যি! কিন্তু এটাও সত্যি, বই বিপণনে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। অনেক লেখক-প্রকাশক জানেন না কীভাবে একটি বইয়ের বিক্রি বাড়াতে হয়, কিংবা বই বিপণনে করণীয় কী। ফলে, বেশিরভাগ লেখকের বইয়ের বড় একটি অংশ অবিক্রীত থেকে যায়।

ফোবর্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি বইয়ের সর্বাধিক বিক্রি নিশ্চিত করা সম্ভব যদি যথাযথ বিপণন কৌশল অবলম্বন করা হয়। বইয়ের বিক্রি বাড়াতে ৭টি পরামর্শ দিয়েছেন বই বিপণন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ জাকুই লেন।

পাঠক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা

বেশিরভাগ লেখক একটি বইয়ে নিজের জ্ঞান এবং অন্তর্দৃষ্টিতে তুলে ধরতে চান। কিন্তু, তারা জানেন না, ওই বইটির পাঠক কারা। অথচ, একটি বই সবার কাছে বিক্রি করা সম্ভব নয়। কারণ, সবার আগ্রহ বা পছন্দ একরকম নয়। তাই শুরুতে একজন লেখককে ওই বইয়ের প্রাথমিক পাঠক কারা তা নির্ধারণ করতে হবে এবং তাদের কথা মাথায় রেখে বইটি লিখতে হবে। যেমন- তাদের জন্য লেখকের চ্যালেঞ্জ কী হতে পারে, তারা কেমন লেখা পছন্দ করেন, তারা কোন মাধ্যমে পড়ে (প্রিন্ট বই, ই-বুক বা অডিওবুক) এসব জানতে হবে। এছাড়া তারা বই পড়ার কোনো প্ল্যাটফর্ম, সাইট বা পডকাস্টের সঙ্গে জড়িত কিনা তাও জানতে হবে।

উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য জানা

বইটি কেন লেখা হচ্ছে কিংবা বইটি দিয়ে লেখক কী বলতে চান- তা অবশ্যই লেখক এবং প্রকাশককে জানতে হবে। সহজ কথায় একটি বই লেখা ও প্রকাশের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য নিয়ে লেখক-প্রকাশকের সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। অথচ, অনেক লেখক বা প্রকাশ এ বিষয়ে যথেষ্ট ভাবেন না। কিন্তু, একজন লেখকের অবশ্যই জানা উচিত তিনি কী উদ্দেশ্য বইটি লিখছেন। তাহলেই বিপণন কৌশল ঠিক করা ও পাঠককে টার্গেট করা সহজ হবে।

বিপণন পরিকল্পনা তৈরি

বইয়ের বিক্রি বাড়াতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সম্পূর্ণ বিপণন পরিকল্পনা। এজন্য লেখক-প্রকাশককে প্রচার মাধ্যম নিয়ে ভালো ধারণা থাকতে হবে। তাহলে কোথায় বইটির প্রচারণা চালাতে হবে তা ঠিক করা অনেক সহজ হবে। যেমন সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট বা ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে প্রচারণা। তবে, যেখানে বিজ্ঞাপন দেওয়া হোক না কেন, বিজ্ঞাপন এমন হতে হবে যেন পাঠককে আকৃষ্ট করে। আর সেখানেই বিজ্ঞাপন দিতে হবে যেখানে টার্গেট পাঠক আছে। এজন্য প্রয়োজন একটি সুপরিকল্পিত বিপণন পরিকল্পনা। জাকুই লেনের মতে, বই লেখা থেকে শুরু করে মোড়ক উন্মোচন পর্যন্ত ১৮ মাসের সময়কাল থাকা উচিত। তাহলে বিপণন নিয়ে বিশদ পরিকল্পনা করা সহজ হবে।

মিডিয়া প্রচারণা

মিডিয়া কভারেজ বই বিপণন এবং বিক্রয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বইয়ের জন্য মিডিয়া কভারেজ নিশ্চিত করার বেশকিছু কৌশল আছে। এমন কয়েকটি কৌশলের একটি হলো- সামাজিক মাধ্যমে সাংবাদিকদের ফলো করা ও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। তারপর সাংবাদিক বা মিডিয়া আউটলেটের কাছে বইটির তথ্য তুলে ধরা। তাদের কাছে বইটি প্রাসঙ্গিক করে তোলা। তবে, কোনোভাবেই বইয়ের সংবাদ প্রকাশে জোর করা যাবে না বা বারবার বলাও ঠিক হবে না। তাহলে ফলাফল উল্টো হতে পারে। মানে তারা বিরক্ত হতে পারেন। বরং, বইটি তাদের কাছে প্রাসঙ্গিক করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে তারাই আগ্রহী হয়ে বইয়ের সংবাদ প্রকাশ করবেন।

বইয়ের সঙ্গে উপহার

বেশিরভাগ প্রকাশক পাঠকের কাছে বই বিক্রি করতে চান। বই বিপণনের জন্য এ ধরনের কৌশল কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন বাজারজাতকরণ বিশেষজ্ঞরা। তার এর পরিবর্তে বইয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ছোট ছোট উপহার দেওয়ার পক্ষে আগ্রহী। কিন্তু, সেগুলো খুব ব্যয়বহুল হবে না। যেমন- কলম, পকেট ক্যালেন্ডার, বুক মার্কার ইত্যাদি। উৎসবের দিন বইমেলায় বইয়ের সঙ্গে শুভেচ্ছা কার্ড বা ফুলও দেওয়া যেতে পারে। তাহলে বিষয়টি উৎসবের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। তাতে বইয়ের ক্রেতা বা পাঠকও সন্তুষ্ট হবেন। কারণ, উপহার যত ছোটই হোক না কেন মানুষ উপহার পেতেই পছন্দ করেন। তাই বইয়ের বিক্রি বাড়াতে এদিকে নজর দেওয়া যেতে পারে।

বইয়ের কমিউনিটি গড়ে তোলা

লেখালেখির শুরুতে একজন লেখককে একটি কমিউনিটি গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সহকর্মী, ক্লায়েন্ট, শিল্প সহকর্মী, বোর্ড সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীগোষ্ঠী, কমিউনিটি সংগঠন, বন্ধু-বান্ধব এবং পারিবারিক নেটওয়ার্ক কাজে লাগানো যেতে পারে। তারা যেসব সামাজিক মাধ্যমে জড়িত আছেন একজন লেখককে তাতে সক্রিয় থাকতে। তাদের সঙ্গে নিয়মিত না হোক মাঝে মাঝে যোগাযোগ করতে হবে। আর বইটি প্রকাশের পর তাদের নেটওয়ার্কে বইটির তথ্য শেয়ারের অনুরোধ করতে হবে। হয়তো সবাই করবে না, কিন্তু কিছু মানুষ তো করবেই। তাতেই বইয়ের তথ্য অনেকের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে। এভাবে অনেক পাঠক পাওয়া সম্ভব।

ধারাবাহিক ও অবিচল থাকা

বই বিক্রি একটি দীর্ঘমেয়াদী অনুশীলনের ব্যাপার। তাই বইয়ের বিক্রি বাড়াতে বিপণন পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে সপ্তাহে অন্তত ১ বা ২ ঘণ্টা বরাদ্দ রাখা উচিত। একজন লেখকের কাছে যদি বিষয়টি কঠিন হয়ে যায়, তাহলে যে পারবে এমন কাউকে নিয়োজিত করতে হবে। তারপর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও ফলাফল মূল্যায়ন করতে হবে। মোট কথা একজন লেখককে বিপণন নিয়ে ধারাবাহিক হতে হবে।

শেষ কথা একটি বইয়ের বিক্রি বাড়াতে বা লেখক হিসেবে সফল হতে সময়ানুবর্তিতা, প্রচেষ্টা ও ফোকাস লাগে। বই বিক্রি বাড়াতে শুধু বইয়ের বিপণন করলে হবে না নিজেকেও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হবে। একজন লেখক যত বেশি পরিচিতি, আস্থা অর্জন করতে পারবেন বইয়ের বিক্রিও তত বেশি হবে। কারণ, লেখকের পরিচিতি বই বিক্রিতে প্রভাব ফেলে। তাই হতাশ না হয়ে নিজের লেখালেখিতে ধারাবাহিক ও অবিচল থাকাটাই মূল কথা।

Comments