বইমেলা বিশেষ-৯

স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবীতার শক্তি ক্রমশ ফিকে হয়ে এসেছে

চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে সাংবাদিক ও কবি কাজল রশীদ শাহীনের কবিতার বই ‘এই আমি কোথাও নেই’ প্রকাশ করেছে বাংলানামা। বইমেলা ও নিজের লেখালেখি নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

চলছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন বই। এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে সাংবাদিক ও কবি কাজল রশীদ শাহীনের কবিতার বই 'এই আমি কোথাও নেই' প্রকাশ করেছে বাংলানামা। বইমেলা ও নিজের লেখালেখি নিয়ে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

প্রকাশ হয়েছে 'এই আমি কোথাও নেই'। আপনাকে তো গুরুত্বপূর্ণ সব জায়াগায় দেখা যায়, তাহলে কেনইবা বলছেন 'এই আমি কোথাও নেই।'

কাজল রশীদ শাহীন: আমি মূলত সময়কে ধরতে চেয়েছি। লালন যেমন বলেছেন, 'ধরো মন হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে।' সময়কে ধরা তো অনেক কঠিন, দীর্ঘমেয়াদী, সময়সাপেক্ষ এবং অসম্ভবও বটে। সময়কে ধরতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, আমরা মূলত কেউ কোথাও নেই। খেয়াল করে দেখবেন আমরা এমন একটা সময়ের ফাঁদে পড়েছি যেখানে নিজস্বতা বলে কিছুই নেই। উত্তরাধুনিক সময়ের জটিলতা ও বাস্তবতাকে এভাবেই দাঁড় করানো হচ্ছে, সদর্থক অর্থে কোনো বুদ্ধিজীবী নেই বলে। এমনকি রাষ্ট্র-রাষ্ট্রের জায়গায় নেই, গণমাধ্যম-গণমাধ্যমের জায়গায় নেই, বিশ্ববিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় নেই। তা হলে মানেটা দাঁড়াল কি আমরা কেউ কোথাও নেই। করোনা মহামারির অভিজ্ঞতায় সেটা আরও অনেক বেশি স্পষ্ট হয়েছে। এই আমি কোথাও নেই মূলত সবাইকে নিজেদের জায়গায় ফেরার আহবান।

প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশের সঙ্গে একমত নই আমি। আমাকে গুরুত্বপূর্ণ-অগুরুত্বপূর্ণ কোনো জায়গাতেই দেখা যায় না। পারতপক্ষে কোনো জায়গায় যাই না আমি, যেতেও চাই না। আমার মনে হয়, ঝাঁকের কৈ হয়ে কোনকিছু দেখা বা পর্যবেক্ষণ করা যায় না। নিঃসঙ্গতায় একজন ঋষির ধ্যানমগ্নতার প্রধান ও প্রথম শর্ত । ঈগলকে তার শিকারের জন্য নিঃসঙ্গ হতে হয়। বটবৃক্ষকে নিঃসঙ্গ হয়েই সবার জন্য ছায়া বিস্তারের ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। নিঃসঙ্গতার কামনা ছাড়া একজন কবির আর কিছু চাওয়ার থাকতে পারে না। বুদ্ধিজীবীতার মৌলিক শর্ত নিঃসঙ্গতা, সংঘবদ্ধতা নয়, দলবদ্ধতা বা দলদাস হওয়া তো নয়ই।

 
অনেকে বলেন, মানুষের জন্য ভাবনায় কেউ নেই। আপনার একটা কবিতার লাইনও আছে 'মানুষটা সবাই হয়, মানুষ কেউ কেউ কেবল'

কাজল রশীদ শাহীন: আপনার কি মনে হয়, মানুষের জন্য ভাবনায় কেউ আছে? আমার তো মনে হয় না আছে। এখন দুই একটা ছিঁটেফোটাকে যদি উদাহরণ হিসেবে হাজির করতে চান , সেটা আলাদা কথা। কিন্তু বাস্তবতা হল, মানুষ মন্দ একটা সময় পার করছে। এই জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগে এসেও যদি মানুষের এই হাল হয়, তাহলে এই সব প্রযুক্তি, উন্নয়ন কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় না? আমার ভেতরের এই প্রশ্ন, এই সিদ্ধান্ত হাজির করে যে,  মানুষ আসলে এখনও মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি। একারণেই আমার অন্বেষণ, 'মানুষটা সবাই হয়, মানুষ কেউ কেউ কেবল।'

বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা একটা দেশের জন্য কেন দরকার, কতটা হচ্ছে বা কেন হচ্ছে না?

কাজল রশীদ শাহীন: বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা একটা দেশের জন্য অপরিহার্য। একটা দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ‍ওপর। যে কোনো জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির শক্তিই হল তার বুদ্ধিজীবীতার শক্তি। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের যে বিজয় সেটা মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিজয়।

একজন কৃষক যে যুদ্ধে গিয়েছিল, একজন মুটে, মজুর ও কুলি। এভাবে লাখে লাখে মানুষ যে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সেটা কেন ও কীভাবে সম্ভব হল এই প্রশ্নের উত্তর একটাই বুদ্ধিজীবীরা সেই আবহ নির্মাণ করেছিল। একটা ফুলকে বাঁচাব বলে মোরা যুদ্ধ করি, এই গান তাদেরকে দেশের জন্য জীবন দিতে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছিল। বেদনার হলো, স্বাধীনতার পর আমাদের বুদ্ধিজীবীতার শক্তি ক্রমশ ফিকে হয়ে এসেছে। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। কারণ বুদ্ধিজীবীরাইতো বলেছেন, 'স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।' আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এখন সংঘজীবী হয়ে গেছেন, দলজীবী-দলদাস হয়ে তারা নিজেদের আখের গোছানোতে ব্যস্ত রয়েছেন, দেশ রাষ্ট্র সমাজ ও মানুষ তাদের কাছে গৌণ হয়ে গেছে।

আপনি নিয়মিত পত্রিকায় লিখছেন। কিন্তু বই প্রকাশে অনীহা। এই বিষয় নিজস্ব ভাবনা আছে?

কাজল রশীদ শাহীন: আমরা তো শিখেছি, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক- এভাবেই শিক্ষা জীবনের ধারাবাহিকতা পাড়ি দিতে হয়। ঠিক লেখালেখিতেও একটা ধারাবাহিকতা জরুরি। প্রশ্ন হল লেখালেখিরতো এরকম প্রাথমিক-মাধ্যমিকের কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই, তাহলে সেটা কীভাবে সম্ভব। এই সম্ভবটা লেখককে নিজে থেকেই রপ্ত করতে হবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে। আমাদের এখানে মননশীল বইয়ের সংখ্যা কম, তার পাঠকও আরও কম। অথচ সমাজ রাষ্ট দেশ নির্মিত হয় তার মননশীলতার ওপর।

এটার একমাত্র কারণ আমাদের লেখকদের দীর্ঘমেয়াদী কোনো প্রস্তুতি নেই। এখানে তরুণ কলাম লেখক ফোরাম হয়। এটা কীভাবে সম্ভব? এ যেন, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের খায়েস হল বাবার মতো সেও তার নামের শেষে এম. এ লিখবে। যখন বলা হল, এটা তো হয় না। তখন সে নিল কৌশলের আশ্রয়, বলল এটা কোন ডিগ্রী নয়। বাবারটা ডিগ্রী, আমার পুরোটা নাম, আবুল কালাম এম. এ। এসব নিয়ে কেউকিছু বললেবও না। কারণ সবাই লোকরঞ্জনবাদীতাকে জীবনের পরম পাওয়া বলে জ্ঞান করছে। বললে তো সমর্থক কমে যাবে, ভোটের মাঠে ‍ঝুঁকিতে পড়তে হবে, লাইক ভিউয়ার কমে যাবে। হযরত মোহাম্মদ (সা.) কিন্তু আগে আল আমীন হয়েছেন। চল্লিশ বছর বয়সে গিয়ে নবুয়ত পেয়েছেন। ৪০ এর আগে কোনভাবেই নয়, খুব ভাল হয় কেউ যদি ৫০ বছরের প্রস্তুতি নিয়ে লেখালেখিতে আসেন। তার আগে বড়োজোর ড্রেস রিহার্সেল হতে পারে যা মহড়ার জন্য মানায়, কিন্তু মঞ্চায়নের জন্য কোনভাবেই নয়।

সাহিত্যের জন্য আড্ডা, মেলা ও পাঠচক্র কতটা সহায়ক বলে মনে করেন

কাজল রশীদ শাহীন: অনেক বেশি সহায়ক। লেখালেখি বা সাহিত্য চর্চার জন্য এর চেয়ে ভাল কিছু সম্ভবত নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, আড্ডাটা আদতে সাহিত্যের জন্য হচ্ছে কি না। আমাদের সাহিত্যের আড্ডার মধ্যেও এক ধরণের গোষ্ঠীপ্রিয়তা ঢুকে গেছে। সংঘবদ্ধতার নামে সেটা একে অপরের পিঠ চাপড়ানি বিশেষ হয়ে উঠেছে। তবে লেখালেখির জন্য নিঃসঙ্গতার কোনো বিকল্প নেই। আড্ডা মেলা পাঠচক্র এসবের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ভাল, এগুলোর প্রয়োজনীয়তা চিরকালীন, কিন্তু এর সঙ্গে বিযুক্ত হওয়ার সাধনাটাও জরুরি।

দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি অনেক হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু বলার মতো কাজ কয়টা? গবেষণার সংকটটা কি?

কাজল রশীদ শাহীন: অনেক হয়েছে কি না, সেটা তর্কসাপেক্ষ। সংখ্যায় কিছু হয়তো হয়েছে, কিন্তু মানে সন্তোষজনক নয়। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ এ জাতির এই ভূগোলের মানুষের এমন একটা প্রপঞ্চ, যা নিয়ে আরও কাজ হওয়া দরকার। এর সঙ্গে আমাদের আবেগ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গগুলো এমনভাবে জড়িত, যা ব্যতীত আমরা সবক্ষেত্রেই ঊনমানুষ বলে বিবেচিত হওয়ার সংশয় রয়েছে। এ কারণে এসব নিয়ে যতবেশি লেখালেখি হয় তত ভাল। একথা সত্যি এসব নিয়ে বড় ক্যানভাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লেখালেখি সেভাবে হয়নি। যারা বলেন ঢের হয়েছে, তারা কোনো প্রকার অনুসন্ধান ছাড়া বলেন কিংবা যথার্থ বলেন না।

আমাদের এখানে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে তেমনভাবে গবেষণার চর্চা নেই। যা কিছু হচ্ছে ওখানেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার গবেষণার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু বিষয় ও ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ। ফলে, এখানে গবেষণার পরিবেশ এখনও উন্মুক্ত হয়নি। এই বাস্তবতায় দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আশাব্যাঞ্জক কাজ অপ্রতুল। রাষ্ট্রের এ ব্যাপারে কোন হেলদোল যেমন নেই তেমনি বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোরও এদিকে কোনোপ্রকার আগ্রহ নেই। এমনকি দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও আমরা এখনও গবেষণামনস্ক জাতির অবয়ব দাঁড় করাতে পারেনি

 

Comments

The Daily Star  | English

Yunus’ economic gambit paying off

Two months ago, as Professor Muhammad Yunus waded into Bangladesh’s unprecedented political turmoil, he inherited economic chaos by default.

2h ago