বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিতে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা

বাড়ির উঠোনে ভিজিয়ে দেয়া হচ্ছে কুলা নামানির দলকে। ছবি: সংগৃহীত

গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত। অনাবৃষ্টির কবলে ওষ্ঠাগত প্রাণ। কৃষিপ্রধান বাংলায় এই দাবদাহ আর অনাবৃষ্টি  চিরকালই এক অভিশাপ। চৈত্র ও বৈশাখের প্রচণ্ড খরতাপে ফসলের মাঠ হয়ে উঠত বিবর্ণ। সব জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় খাবার পানি জোগাড় করাও হয়ে পড়ত দুঃসাধ্য। এজন্য গ্রাম বাংলার মানুষ অপেক্ষা করত বৃষ্টির।

বৃষ্টির দেখা না পেলে বাংলার বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ বৃষ্টির জন্য তাদের আদি সংস্কৃতি ও লোক সংস্কৃতি অনুযায়ী নানা নিয়মাচার ও লোকাচার পালন করত। কালের পরিক্রমায় বৃষ্টির জন্য বাংলার লোকজ সংস্কৃতির সেই সমৃদ্ধ অধ্যায়টি আজ এক প্রকার বিলুপ্তই বলে চলে। কিছু কিছু আচার যদিও পালিত হয় এখনও। 

'হায় বিধি বড়ই দারুণ

পোড়া মাটি কেঁদে মরে ফসল ফলে না

হায় বিধি বড়ই দারুণ

ক্ষুধার আগুন জ্বলে আহার মেলে না।

কি দেব তোমারে, নাই যে ধান খামারে

মোর কপাল গুণে রে –

কাঠফাটা রোদের আগুনে

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে আয় রে –' 

সলিল চৌধুরীর লেখা 'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেবো মেপে' গানে ফুটে উঠেছে বৃষ্টির জন্য পরম কামনা ও তীব্র হাহাকার।

লোকসংস্কৃতির উর্বর ভূমি কৃষিপ্রধান গ্রামবাংলায় পালিত হওয়া কিছু লোকজ ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বর্ণনা রইল এই লেখায়। 

ব্যাঙের বিয়ে

'ব্যাঙ্গা-ব্যাঙ্গির বিয়ে, কুলো মাথায় দিয়ে/ ও ব্যাঙ জল আন গিয়ে আন গিয়ে/ খালেতে নাই জল/ বিলেতে নাই জল/ আকাশ ভেঙে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা জল।'

এমনটাই গাইতে গাইতে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয় কোনো বিল বা জলাশয় থেকে ধরে আনা একজোড়া ব্যাঙকে। ব্যাঙের মাথায় থাকে টোপর, নারীরা শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে ব্যাঙের গায়ে হলুদ মাখিয়ে দেন। বিয়ে উপলক্ষে চলে ভুরিভোজও।

ব্যাঙের বিয়ে। ছবি: সংগৃহীত

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, ব্যাঙের বিয়ে দিলে বৃষ্টির দেবতা বরুণ দেব সন্তুষ্ট হয়ে শিগগির পর্যাপ্ত বৃষ্টি নামাবেন এবং ওই বছর ধানের উৎপাদন ভালো হবে। অনাবৃষ্টি ও খরার দরুন দেশের নানা অঞ্চলে আজও ব্যাঙের বিয়ে সমারোহে পালিত হয়ে থাকে। 

কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই নয়, ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করা হয় পাহাড়ি সমাজেও। অনেক পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ব্যাঙের বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদার মতো সবজি ও চাল সংগ্রহ করে। এরপর বিয়ের আয়োজনকারী বাড়ি গোবর দিয়ে লেপে পবিত্র করে ব্যাঙের বিয়ে আয়োজন করা হয়। আয়োজন শেষে মহা ধুমধামের মাধ্যমে খাবার পরিবেশন করা হয়।

তালতলার শিন্নি

বাংলার কৃষি প্রধান অঞ্চলে তালতলার শিন্নি বৃষ্টির জন্য প্রার্থনার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি আয়োজন। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ, চাল, গুড় চাঁদা হিসেবে তোলা হয়। কেউ কেউ অর্থ সাহায্যও করে। সংগৃহীত রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের সবচেয়ে উঁচু গাছের তলায়। এরপর হাঁড়িতে চড়িয়ে রান্না করা হয় শিন্নি।

চলছে কলাপাতায় শিন্নি বিতরণ। ছবি: সংগৃহীত

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উঁচু গাছ তালগাছ হওয়ায় এটি তালতলার শিন্নি হিসেবেই পরিচিত। অনেক অঞ্চলে খিচুড়িকেও শিন্নি নামে ডাকা হয়। তালতলা শিন্নি খাওয়ার জন্য গ্রামের সর্বস্তরের মানুষ গাছতলায় জড়ো হয়। রান্না শেষে উপস্থিত গ্রামবাসীদের কলাপাতায় শিন্নি বিতরণ করা হতো। খাওয়ার পর উপস্থিত গ্রামবাসী বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে। 

কাদা মাখানো

কোনো কোনো অঞ্চলে বৃষ্টি নামানোর জন্য কাদা মাখানোরও চল রয়েছে। মেয়েরা পানি ভর্তি কলসি নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাজির হয়। তারা শুকনো উঠোনে পানি ঢেলে কাদা তৈরি করে একে অন্যের গায়ে কাদা ছিটিয়ে দেয়। 

হুদুমদ্যাও পূজা বা মেঘ পূজা

উত্তরবঙ্গে অনাবৃষ্টির সময় বৃষ্টি নামানোর জন্য লোকজ পূজার নাম হুদুমদ্যাও পূজা বা মেঘ পূজা। এ উপলক্ষে নৃত্য-গীতেরও আয়োজন করা হয়। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি থেকে বৈশাখ মাসের শুরুতে এই লোকপূজার আয়োজন করা হয়।

ফিঙে পাখির বাসা, কলাগাছ, পানিভর্তি একটি ঘট, কুলো, পান-সুপারি, বরণ ডালা, ধুপ এবং পূজার নানাবিধ সরঞ্জামাদি নিয়ে হুদুমদ্যাও পূজার আয়োজন করা হয়। মেঘ পূজায় পুরুষদের কোনো প্রবেশাধিকার নেই। এটি নারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

পূজার একপর্যায়ে নারীরা গেয়ে উঠেন,

'হুদুম দ্যাও হুদুম দ্যাও, এক ছলকা পানি দ্যাও

ছুয়ায় অশুচি আছি, নাই পানি

ছুয়াছুতির ধারা বাহি ঝালকানি।

কালা ম্যাগ, উতলা ম্যাগ, ম্যাগ সোদর ভাই

এক ঝাঁক পানি দ্যাও গাও ধুইবার চাই।।'

ইসতিসকার নামাজ

গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত, ঠিক তখনই ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা গ্রামের খোলা মাঠে কিংবা উন্মুক্ত প্রান্তরে জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়েন। এটিকে ইসতিসকার নামাজ বলা হয়। এই নামাজের পর অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ মোনাজাত। মোনাজাতের উদ্দেশ্য খরা ও অনাবৃষ্টি থেকে মুক্তি এবং বৃষ্টির জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে করজোড়ে প্রার্থনা।

হুদমা গান

বৃষ্টি নামানোর জন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষজন রাতে দলবেঁধে হুদমা গান গেয়ে থাকেন। তাদের বিশ্বাস, হুদমা মেঘের দেবতা। যদি দেবতা হুদমাকে সন্তুষ্ট করা যায় তাহলে তিনি চাষের উপযুক্ত বৃষ্টির বর্ষিত করবেন।

কুলা নামানি

গ্রাম বাংলায় বৃষ্টির জন্য কৃষকদের এক লোকজ অনুষ্ঠানের নাম কুলা নামানি। প্রথমে নতুন একটি কুলায় ধান, বিভিন্ন বনফুল, ধান, দূর্বাঘাস এবং কাকের বাসার কাঠখড় দিয়ে সাজানো হয়। গ্রামের কোনো এক কিশোর বা কিশোরীর মাথায় সেই কুলা তুলে দেওয়ার আগে একটি কাঁসার কলসির উপর কুলাটি রাখা হয়। কলসিতে থাকে সোনা-রূপা ভেজানো পানি। সঙ্গে থাকে একটি আমগাছের ডাল।

কুলা বহনকারী সেই কিশোর/ কিশোরীর মুখে মাখানো থাকে সাদা চুন ও কালি। এ চুন-কালি দিয়ে মেঘের প্রতীক। কুলা বহনকারীর পেছনে সারিবদ্ধভাবে আসতে থাকে বাকি কিশোর, বালকরা।  তাদের মুখেও চুন-কালি থাকে। কুলা নামানির দলের সঙ্গে থাকেন কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ গ্রামবাসীও।

কুলা নামানি বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরীরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে চাল, ডাল, তেল মশলা, শাকসবজি বা টাকা পয়সা চাঁদা হিসেবে তোলে। তাদের জিনিসপত্র দেওয়ার সময় বিভিন্ন বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা কুলা নামানির দলকে দিয়ে ভিজিয়ে দেন। তখন সবাই বৃষ্টির গান ধরে বৃষ্টি নামানোর জন্য প্রার্থনা করে। 

এমনই একটি গান 'আল্লাজিরা, তেওল্লাজিরা, বাঁশপাতার ভাই/ এমন বরণ বইরা যাবি ভিজ্জা বাড়ি যাই'। গান গাইতে গাইতে বিভিন্ন বাড়ি থেকে সংগৃহীত চালডাল ও আনাজপত্র নিয়ে কোন এক বাড়ির উঠানে খিচুড়ি রান্নার আয়োজন করা হয়। রান্নার সময়ও উপস্থিত সবার মুখে মুখে থাকে বৃষ্টির গান। খিচুড়ি রান্না শেষে তা আগত সবাইকে খেতে দেওয়া হয়।

পুণ্যিপুকুর ব্রত

গ্রামবাংলায় বৃষ্টি নামানোর আরেকটি প্রথা 'পুণ্যিপুকুর ব্রত'। এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আচার।

পুণ্যি পুকুর ব্রতের আয়োজন। ছবি: সংগৃহীত

বৃষ্টি নামানোর পাশাপাশি বৃষ্টির অভাবে এবং তীব্র সূর্যতাপে যেন পুকুর না শুকিয়ে যায়, গাছপালা না মারা যায় এবং ফসলের ফলন ভালো হয় সেজন্য ১ মাসব্যাপী এই ব্রত পালন করা হয়। ৫ থেকে ৯ বছরের মেয়েরা এই ব্রত পালন করে থাকে। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে বিবাহিত নারীরাও অংশ নেন ব্রতে।

পুণ্যিপুকুর ব্রতের জন্য গৃহস্থ বাড়ির উঠানে গর্ত করে ছোট পুকুর কেটে কড়ি দিয়ে ৪টা করে ঘাট সাজানো হয়। এরপর সাদাফুল, চন্দন, দূর্বাঘাসসহ পূজার নানা উপযোগ এবং কাঁটাসহ বেলগাছের ডাল ও তুলসি গাছ পুকুরে পুঁতে পুকুর পানি দিয়ে পূর্ণ করা হয়।  পুণ্যিপুকুর ব্রত বাড়ির উঠান ছাড়াও পুকুরপাড়ে এবং বাগানে পালন করা হয়।

 ব্রত পালনের সময় ছড়া কাটা হয় এভাবে-

'পুণ্যিপুকুর ব্রতমালা/কে করে গো সকালবেলা

আমি সতী,লীলাবতী/সাতভায়ের বোন,ভাগ্যবতী

হবে পুত্র,মরবে না/ধান সে গোলায় ধরবে না

পুত্র তুলে স্বামীর কোলে/আমার মরণ হয় যেন এক গলা গঙ্গাজলে...'

 

তথ্যসূত্র:

বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ/ সম্পাদক ড. বরুণকুমার চক্রবর্তী

বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ/সম্পাদনা দুলাল চৌধুরী

 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Threat of fresh Rohingya influx looms as clashes erupt in Myanmar

Gunfire and explosions were heard late Friday night from villages across the border in Myanmar opposite Whykong union in Teknaf upazila of Cox’s Bazar. Residents, gripped by panic, reported that this was the most intense gunfire they had heard in months.

3h ago