‘ছাত্রদের দায়িত্ব স্বৈরাচারের ফিরে আসা প্রতিরোধে সতর্ক থাকা’

বাংলা একাডেমির আয়োজনে চলছে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা। প্রতিদিন মেলায় আসছে নতুন নতুন বই। এবারের মেলায় কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক ফয়জুল লতিফ চৌধুরির 'নানা চোখে জীবনানন্দ'। গণঅভ্যুত্থান, নিজের লেখালেখি ও বইমেলা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে

আপনার এবারের মেলায় কয়টি বই, কি নিয়ে?

এই বইমেলা নিয়ে অনেক আশা ছিল যার কিছুই বাস্তবায়িত হলো না বলা যায়। ‌ কথাপ্রকাশ একটি বই প্রকাশ করেছে। শিরোনাম "নানা চোখে জীবনানন্দ"। কবি জীবনানন্দ দাশের জীবন ও কীর্তি নিয়ে কয়েক হাজার প্রবন্ধ নিবন্ধ রয়েছে:─ সেগুলো থেকে সযত্নে বাছাই করে ২১টি প্রবন্ধের সংকলন এই গ্রন্থ। যাদের প্রবন্ধ নেয়া হয়েছে তারা হলেন আবুল ফজল, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আহমদ রফিক, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, আবু তাহের মজুমদার, সুতপা ভট্টাচার্য,  ক্ষেত্র গুপ্ত, শাহরিয়ার মোল্লা, সালাহউদ্দিন আইয়ুব, আক্তার কামাল, ফয়জুল লতিফ চৌধুরি, হুমায়ুন কবির, ভুমেন্দ্র গুহ গোপাল রায় এবং প্রভাত কুমার দাস। 

বেঙ্গল বুকস থেকে প্রকাশিত হবে আমার ৪র্থ উপন্যাস ''প্রশ্নোত্তর কেন্দ্র''। অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের দীর্ঘতম কবিতা 'সোমেশ্বর মুস্তফীর পৃথিবী'। ৩৯২ পংক্তির অসামান্য কবিতা। জীবনানন্দ দাশের কবিতা লেখার ১৮ সংখ্যক খাতা থেকে পাঠোদ্ধার করেছি। পাঠক সমাবেশ প্রকাশিত হবে আমার লেখা "জীবনানন্দ দাশের জীবন ও কীর্তি"।

আপনি গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিধান নেই কাজ করছেন। অভিধানের কাজ তো টিমওয়ার্ক। আপনি কি একাই করছেন?

বাংলা ভাষার অভিধানের সংখ্যা কম নয়। ‌তবে একটি শব্দকোষ গঠণ করা দরকার ছিল। নিয়ম হচ্ছে শব্দকোষ থেকে বাছাই করে অভিধান তৈরী করা । যাই হোক,  প্রায় ৩০ বছর আগে খেয়াল করেছিলাম যে, বিভিন্ন প্রবন্ধে এবং গদ্য রচনায় এমন অনেক শব্দ গত একশত বছরের ব্যবহৃত হয়েছে যেগুলো কোনো অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ‌ এই প্রণোদনা থেকে আমি দুই শত বই থেকে দুইহাজার শব্দ সংকলন করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। ২০১০ সাল নাগাদ ‌ বাংলা ভাষার বড় মাপের ১৭টি অভিধানে নেই এ রকম ১০০০ শব্দের সংকলন তৈরি করেছি যাতে শব্দ এবং শব্দটি যে বাক্যে অবস্থিত সেই বাক্য এবং গ্রন্থসূত্র ইত্যাদি রয়েছে।  সঙ্গে ইংরেজি সমার্থক শব্দ দেয়ার চেষ্টা করেছি। ‌ এটা কঠিন কাজ। ‌ কিন্তু অসম্ভব নয়। ‌ আমার লক্ষ্য ছিল দিনে একটি শব্দ নিয়ে কাজ করা। ‌ অভিধান একটি দলগত কর্মকাণ্ড বললে ইতিহাসকে অবজ্ঞা করা হয়।  হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়. জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, সুবলচন্দ মিত্র প্রমুখ যারা বাংলা ভাষার অভিধানের প্রধান কারিকর তারা এক হাতে অভিধান প্রণয়ন করেছেন। ‌২০২৫ সালেই এটি প্রকাশ করবো আশা রাখি।

পত্রোপন্যাস এখন একেবারে কম দেখা যায়। সেখানে আপনার দুর্দানা খানের চিঠি" অসামান্য প্রশংসা পেয়েছেঙ্গ

এটি পত্রোপন্যাস হওয়ার কথা ছিল না। ‌ কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ ২০২৫ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন এবং তার প্রথম স্ত্রী দীর্ঘকালের অভিমান ভেঙে হুমায়ূন আহমেদকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, এরকম একটি চিঠি দিয়ে উপন্যাসটি শুরু। ‌ একটি চিঠি থাকলে তার উত্তরটিও অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। ‌ দু'টি চিঠি লেখার পরে মনে হল যে কেবল চিঠি দিয়েই উপন্যাসটি লেখার সুযোগ রয়েছে। সবজান্তা কথকের বয়ানে রচিত উপন্যাসের তুলনায় পত্রোপন্যাস রচনা দুরূহতর সন্দেহ নেই। যাই হোক শেষপর্য‌ন্ত পত্রোপন্যাস আকারেই "দুর্দানা খানের চিঠি" লেখা হয়ে গেল। দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ‌ প্রচারের অভাব রয়েছে। আমার মনে হয় হুমায়ূন আহমেদের জীবনকে সামনে রেখে এটি একটি আধুনিক কাঠামোর উপন্যাস। ‌ পাঠক তা এটা পছন্দ করেছেন। ‌ আমি প্রীত হয়েছি।  লেখার মধ্যে আনন্দ আছে; ‌ সৃজনের আনন্দ। কিন্তু লেখক তো নিজের জন্য লেখেন না। ‌একজন পাঠক যখন বইটি পড়েন এবং তার অভিজ্ঞতা জানান তখন লেখক নিজেকে সার্থক অনুভব করেন।   

জীবনানন্দ বিষয়ক কাজ অনেক। আরও কত অনাবিস্কৃত আছে বলে মনে করেন?

জীবনানন্দ দাশের অনেক পান্ডুলিপি হারিয়ে গেছে যখন তার একটি বড় অংশ কবিকন্যা মঞ্জুশ্রী দাশকে দেয়া হয়েছিল। কিছু উদ্ধার করা হয়েছে। ভূমেন্দ্র বলেছিলেন, ‌ হারিয়ে যাওয়া পান্ডুরিপি উদ্ধারের জন্য যাদের পাঠিয়েছিলেন তারা পান্ডুলিপি উদ্ধার করে সব পান্ডুলিপি জমা দেয়নি। ‌ কবির ভাতুষ্পুত্র অমিতানন্দ দাশ একটি পান্ডুলিপির কবিতাগুলি মৃত্যুর আগে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন এবং ভূমিকায় লিখেছেন কে এই খাতা এতদিন লুকিয়ে রেখেছিল। ‌ এটা অদ্ভুত ব্যাপার। 

যাই হোক, জীবনানন্দ দাশের নতুন পান্ডুলিপি আবিষ্কার হবে এরকমটি এখন আর আশা করা যায় না। ‌ তবে আমাদের জন্য বিস্ময় অপেক্ষ করছে। জীবনানন্দের 'বিভা' উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল কম করে হলেও কুড়ি পঁচিশ বছর আগে। প্রতিক্ষণ থেকে 'বিভা' উপন্যাসটি ছাপানো হয়েছিল ''জীবনানন্দ সমগ্র'' ষষ্ঠ খন্ডে। ‌ পাঠক হিসেবে তার মধ্যে আমরা কিছুটা অপূর্ণতা লক্ষ্য করতে পেরেছিলাম তিনটি লেখার খাতার ভিত্তিতে উপন্যাসটি প্রকাশ করা হয়েছিল। অসম্পূর্ণতা ছিল। তা কারোরই দৃষ্টি এড়ায়নি। চতুর্থ খাতাটি উদ্ধার করেন ভূমেন্দ্র গুহ। পাঠোদ্ধারের সময় পাননি।  স্নেহাশীষ পাত্রকে খাতাটি দিয়ে গিয়েছিলেন মৃত্যুর আগে। শুনেছি সম্প্রতি পাঠোদ্ধার করে চারটি খাতার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ 'বিভা' প্রকাশ করা হয়েছে। কবিতার প্রসঙ্গে আসি।

জীবনানন্দের কবিতার ৪৮ টি কবিতা লেখার খাতা ভারতের জাতীয় লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। তার থেকে কম বেশি ২১৫০টি কবিতা এ যাবৎ প্রকাশ করা হয়েছে। গত দুই বছরে আরো ছয়টি কবিতা পাঠোদ্ধার করে আমি প্রকাশ করেছি। ‌ এটা কঠিন বিষয় কিন্তু অসম্ভব নয়। ‌ হয়তো আরো কিছু কবিতা পাঠোদ্ধার করে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। ‌ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যাই হোক, আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। 

অভিযোগ আছে আপনি যথাযথ রেফারেন্স না দিয়ে গবেষণা করেন। যেমন জীবনানন্দের চিঠি ও কবিতা। 

আমি যখন একাডেমিক একটু প্রবন্ধ বা বই লিখি তখন আমি প্রথামাফিক প্রবন্ধের ভিতরে সাইটেশন দেই এবং প্রবন্ধের শেষে রেফারেন্স দেই। ‌ পত্রপত্রিকায় লেখালেখির ক্ষেত্রে এই কষ্ট স্বীকার করি না। জীবনানন্দের পত্রাবলীর ভূমিকা দীর্ঘ। ‌ এখানে চিঠিগুলো প্রকাশের ইতিহাস এবং পান্ডুলিতে থেকে উদ্ধারের ইতিহাস সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। ‌ ‌ জীবনানন্দ দাশের দিনলিপির খাতা থেকে প্রায় ২৫ টি চিঠির খসড়া উদ্ধার করেছি। ‌আরো করছি। ভূমিকাটা পড়ে দেখবেন কাঙ্খিত সব তথ্য পেয়ে যাবেন।

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অনেক বিভক্তি। অভ্যুত্থানের প্রেরণা ছাত্রদের এখন কী করনীয়?

বাংলাদেশের জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জুন জুলাই আগস্ট মাসে একটি অচিন্তনীয় গণঅভ্যুত্থান হয়েছে এবং স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে। সমাজের মধ্যে মানুষে মানুষে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে যে সম্পর্ক রয়েছে তার সমীকরণ নতুন করে রচিত হচ্ছে। তবে সার্বিক অবস্থা এখনও জায়মান। রাজনীতির ছক নতুন করে সাজানো হচ্ছে। তরুণরা রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে চলেছে।ছাত্রদের দায়িত্ব স্বৈরাচারের ফিরে আসা প্রতিরোধে সতর্ক থাকা। অন্তবর্তী সরকারকে সমর্থন দেয়া। এলাকায় এলাকায় মাস্তানী রাহাজানী ও সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা।

বইমেলা নিয়ে কিছু অভিযোগ দিচ্ছেন কেউ কেউ। লেখক হিসেবে আপনি কি বলবেন? 

হাঁটতে গিয়ে আঘাতে পড়ে গিয়ে পায়ে প্রচন্ড চোট পেয়েছি তাই বইমেলায় যাওয়া হয়নি। ‌ বইমেলা প্রকাশক এবং পাঠকের মেলা। ‌পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় থাকাই যথেষ্ট। বইমেলা আমাদের অন্যতম জাতীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আমি কখনোই এর সমালোচনা করবো না। ‌বইমেলায় যেভাবেই হবে আমরা সেভাবেই অভ্যর্ধনা জানাবো। 

Comments