বইমেলা: লেখক-প্রকাশক হতাশ, মেলা কমিটির উচ্ছ্বাস

'জুলাই গণঅভ্যুত্থান: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ' প্রতিপাদ্যে মাসব্যাপী একুশে বইমেলা শেষ হয়েছে। লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের বৃহত্তম এই উৎসবকে ঘিরে সবার মাঝেই থাকে আলাদা আগ্রহ ও উদ্দীপনা। অবশ্য, প্রকাশকরা জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় অর্ধেকে নেমেছে তাদের বিক্রি, আর লেখকরা বলছেন 'হযবরল' বইমেলা।
শেষ পর্যন্ত কেমন হলো বইমেলা?—এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কয়েকজন লেখক ও প্রকাশকের কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম বইমেলা নিয়ে তাদের ভাবনা। জানতে চেয়েছি, এবারের বইমেলা কেমন হলো? যদি ভালো না হয়ে থাকে, তাহলে এর জন্য দায় কার? কী বলছেন বাংলা একাডেমি?
আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনি জানান, সবার জন্য বইমেলা পরিচালনা কমিটি মেলার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। এই বইমেলা করে আমরা হতাশ। তাই আমাদের এই খারাপ অবস্থা--যা করোনার সময়ও ছিল না।
উল্লেখ্য আগামী প্রকাশনীর গত বইমেলায় ১২০টির অধিক নতুন বই ছিল, এবারের মেলায় ৭০টির মতো। বিক্রি হয়েছে আগের তুলনায় ৩০%-এর মতো।
সূচীপত্র প্রকাশনীর প্রকাশক সাঈদ বারী বলেন, সূচীপত্র প্রতিবাদস্বরূপ ফ্যাসিবাদের শেষ ৫ বছর একুশে বইমেলায় অংশ নেয়নি। আর এবারের মেলায় আমাদের বিক্রি আশানুরূপ নয়। আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রকাশকরা যেরকম সুষ্ঠু, সুন্দর বইমেলা চেয়েছিলাম, সেই কাঙ্ক্ষিত বইমেলা পাইনি। এরজন্যে মূলত দায়ী বাংলা একাডেমির একশ্রেণীর কর্মকর্তা, যারা ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে পরিচিত। তাদের দুর্নীতিপ্রবণতা, স্বেচ্ছাচারিতা, সর্বোপরি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে বইমেলাকে অসফল, ব্যর্থ প্রমাণের মানসিকতা- এজন্যে দায়ী।
ইউপিএল প্রকাশনী প্রকাশক মাহরুখ মহিউদ্দিন বলেন, এবারের বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে একটা অসম্ভব বিচলিত সময়ে। বিরাট কোন দুর্বিপাক ছাড়া মেলাটা শেষ হয়েছে; আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। মেলার প্রথম দিন থেকেই নানান বিতর্ক ও অপ্রীতিকর ঘটনা মেলার আমেজ ও আকর্ষণ কমিয়ে ফেলেছিল বড় অংশের পাঠকদের মধ্যে। আয়োজনের পেশাদারিত্ব ও নিরাপত্তার জায়গাটিও সুখকর ছিল না। আমরা আশা করবো যে ভবিষ্যতের বইমেলা শুধু বইমেলাই হবে, এবং যারা নানান মত, পথ, চিন্তার খোঁজ করেন, তারা সবাই স্বচ্ছন্দে আসবেন বই দেখতে এবং কিনতে। প্রকাশকরা যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য নানামাত্রিক ঝুঁকি নেন এই মেলাকে কেন্দ্র করে, এবং যে পরিমাণ শ্রম নিয়োজিত এখানে হয়, তার প্রতি ন্যায়বিচার করতে আয়োজকদেরকে আরও পেশাদার ও সংবেদনশীল হতে হবে সামনের দিনে।
ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের প্রকাশক জহিরুল আবেদীন জুয়েল জানান, এবারের বইমেলাকে এককথায় বলতে গেলে অরক্ষিত বারোয়ারি মেলা বলা যায়। আর বইমেলা না বলে প্রদর্শনী উৎসব বলা যেতে পারে। আমার ২০ বছরের বইমেলা-জীবনে এমন মেলা দেখিনি। বইমেলা উদ্বোধনের দিনেই পাঠকদের বয়কটের মুখে পড়ে মেলা। যদিও দর্শনার্থীর কমতি ছিল না। নিয়মিত পাঠক—যারা প্রতি বছর বই কেনেন এমন বেশিরভাগ পাঠক-ক্রেতাকে চোখে পড়েনি এই মেলায়। প্রতিদিন হকারদের যন্ত্রণায় অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে থাকতে হয়েছে আমাদের। যা বইমেলার দুই দশকে আমি দেখিনি। এমন হযবরল বইমেলার জন্য অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই দায়ী করতে হয়।
ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ এ বছর ৫০টি বই বেরিয়েছে। যার ৩০টি বই বেরিয়েছে মেলা উপলক্ষে। এবারে বইবিক্রি বিগত কয়েক বছরের তুলনায় কম। আর গত বইমেলার তুলনায় অর্ধেক।
বাতিঘর প্রকাশনীর প্রকাশক ও কথাসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিন বলেন, মেলার ভেতরে-বাইরে ছিল অগোছালো। দরকারের চেয়ে অনেক বেশি স্টল দেওয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমির যে নিয়ম-কানুন আছে, সেগুলো অনুসরণ করলে অনেক প্রকাশনীই স্টল পেতো না। মেলার প্রাঙ্গণে এবং বাইরে পুলিশ ছিল নিষ্বিক্রয়। মেলা কর্তৃপক্ষের ঝোঁক ছিল যত বেশি সম্ভব বাণিজ্যিকীকরণ করা। যে ইভেন্ট প্রতিষ্ঠানকে এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের কাজের মান খুবই নিম্নমানের। দায় অবশ্য একাডেমির চেয়ে সরকারের বেশি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা-ই শেষ পর্যন্ত এই মন্দার মূল কারন। এবারের মেলায় বাতিঘর প্রকাশনীর বিক্রি গত বারের চেয়ে ১০% কম হয়েছে। তবে অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতে, তাদের বিক্রি আরো কমে গেছে।
প্রথমা প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন জানান, একাডেমির অব্যবস্থাপনা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে বইমেলা ভালো হয়নি। আমরা এমন মেলা আগে করিনি। আমাদের মেলায় বিক্রি কম হয়েছে আগের তুলনায় ৬০%।
বইমেলা ও মেলায় প্রকাশিত বই নিয়ে কাজ করছেন কবি ও সম্পাদক মারুফ রায়হান। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে জানিয়েছেন মতামত। বইমেলা একটা অস্থির সময়ে হয়েছে। একদিকে মবসন্ত্রাস অন্য দিকে গণপিটুনি। সারাদেশেই পুলিশ ঠিকমতো দায়িত্ব পালনে ভয় পাচ্ছে। সবমিলিয়ে একটা শঙ্কা আমাদের ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ, লেখক পাঠক প্রকাশক সবারই আন্তরিকতায় একটা বই মেলা হয়েছে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে এই বই মেলাকে আমরা সর্বাঙ্গীণ সুন্দর বলতে পারব না; শতভাগ সফলও নয় এই বইমেলা। তবে অনেকটাই সফল। একই রকম চেহারা নিয়ে এসেছিল বইমেলা। এবার স্টলও কিন্তু আগের তুলনায় বেশি ছিল। সবদিক থেকে একটা প্রসারিত অবস্থা ছিল। যথেষ্ট সংখ্যক বইও বেরিয়েছে। কোন কমতি ছিল না। মানসম্পন্ন বইও আছে। তবে সত্য প্রকাশের দায়বোধ থেকে বলতেই হচ্ছে, একদিকে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ সেলফ সেন্সরশিপের ঘেরাটোপে ছিল। আর মেলাপ্রেমী মানুষের ভেতর ছিল শঙ্কা ও টানাপোড়েন।
বইবিষয়ক কনটেন্ট তৈরি করেন আহসান নাহিয়ান। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, মেলায় বহুবার যাওয়া হয়েছে। তবে, কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা, নেতিবাচক প্রচারণা, বেশ কিছু অপরিবর্তনীয় কারন যেমন- ছুটির দিন কম থাকা, ২টা শনিবারে মেলা সকালে না শুরু করা, ছুটিরদিনে বৃষ্টি, এর জন্য তুলনামূলক কম বিক্রি হওয়া, কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রচারের আধিক্য থাকা- ইত্যাদি বিষয় কিছুটা কষ্ট দিয়েছে। তবুও অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সুন্দর এক বইমেলার কথাই আমি বেশি মনে রাখতে চাই।
লেখক ও সাংবাদিক কাজল রশীদ শাহীন বলেন, এবারের বইমেলা কবি-লেখক-পাঠক-প্রকাশক-শুভানুধ্যায়ী, সকলের প্রত্যাশা পূরণ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আয়োজক কর্তৃপক্ষের তরফে একটা সুন্দর বইমেলা উপহার দেওয়ার বিষয়ে কোন ভাবান্তর বা জোর চেষ্টার বিষয়টা মেলায় দৃশ্যমান হয়নি। উল্টো তারা, কথার মোড়কে দায় ও দায়িত্বকে অস্বীকার করেছে। যা সকলের জন্য অবমাননা ও লজ্জার। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের যে বারতা, সাহস, শক্তি ও উদ্যম তার কোনটার প্রতিফলন বইমেলায় ঘটেনি। ২০২৪ এর আগের বইমেলা এবং এবারের বইমেলার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য চোখে পড়িনি। উল্টো নির্লজ্জের মতো কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। লেখক-প্রকাশকদের নিরাপত্তায় বাংলা একাডেমির জোর কোন চেষ্টা ছিল বলেও মনে হয়নি। 'হযবরল' মেলার মধ্যে দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, স্বৈরাচারের বিদায় ঘটলেও তার শিষ্য-প্রশিষ্যরা, শাসক ও প্রশাসকবর্গ বহাল তবিয়তে আছে।
কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল বলেন, পাখির চোখে দেখার মতো করে যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, মেলায় অন্তরঙ্গ পরিবেশ ছিল না বরং বেশ এলোমেলো ছিল। সম্ভবত যারাই স্টল চেয়েছে তাদেরকেই দেওয়া হয়েছে, কোনো বাছবিচার ছাড়াই। সম্ভবত সর্বোচ্চ সংখ্যক স্টল ছিল এবার, ফলে মেলার পরিধি অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল। কোনো পাঠক/ক্রেতার পক্ষে পুরো মেলা ঘুরে দেখা বা বই বাছাই করা সম্ভব ছিল না। কয়েকজন প্রকাশকের কাছে জেনেছি, বিক্রিও প্রত্যাশিত মাত্রায় হয়নি। এর কারণ অনেক। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা করুণ। যারা প্রধান ক্রেতা সেই মধ্যবিত্তদের হাতে বাড়তি টাকা নেই।
আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য সাধারণ পাঠকরা এবার মেলায় যাননি বলে ধারণা করি। মেলার আগেই পুরস্কার-বিতর্কে একাডেমি ঘেরাও করা, মেলার চলাকালে একটা স্টল বন্ধ করা, একজন কবিকে হত্যার হুমকি দেওয়া এবং গ্রেফতার করা, উগ্রপন্থীদের অবিরাম আস্ফালন ইত্যাদি মেলাকে আক্রান্ত করেছে। শুধু বইমেলা নয়, এবারের বাণিজ্যমেলাও ভালো হয়নি বলে শুনেছি। দেশে শান্তি, শৃঙ্খলা এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বইমেলা বাংলা একাডেমি করে না। বইমেলা আয়োজন করে মেলা কমিটি। আপনি মেলা বাস্তবায়ন কমিটির সঙ্গে কথা বলেন।
বইমেলা কমিটির সদস্য সচিব সরকার আমিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের মাঝে এক ধরনের অস্থিরতা ছিল। এমন একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে বইমেলা করতে হয়েছে। যে সময়ে মেলা মাসব্যাপী করাটাই একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রকাশক লেখকদের যে অভিযোগ তা মেনেই বলছি, আমাদের সীমাবদ্ধতা ছিল সত্য। কিন্তু এর মাঝে বড় ধরনের ঝামেলা ছাড়া বইমেলা শেষ করতে পেরে আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত বিষয় বলেও মত দিচ্ছেন এই সদস্য সচিব।
Comments