৯০তম জন্মদিন

সূর্যাস্তেও উজ্জ্বল যিনি

রেহমান সোবহান। স্কেচ: সজীব

নব্বইতম জন্মদিন অতিক্রম করছেন রেহমান সোবহান। খ্যাতিমান অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সালের ১২ মার্চ কলকাতায়। সূর্যাস্তের আলোয় আজও সমান উজ্জ্বল তিনি। গাছের ডালপালার মতোই সবুজ আর বিস্তৃত তার পরিবার।

ঢাকার নবাব পরিবারে ছিল তার নানাবাড়ি। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ছিলেন তার নানা। উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা বাবা কে এফ সোবহানের চাকরির সুবাদে শৈশব কেটেছে কলকাতায়। পড়াশোনার জন্য কেটেছে দার্জিলিং, লাহোর ও কেমব্রিজে।

দেখা যায়, ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই ৩ পর্বের জীবনে গল্পের অন্ত ছিলো না। সাতচল্লিশের আগে ও পরে স্থান, কালের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বহু মানুষের জীবন সংগ্রাম দেখেছেন। রেহমান সোবহান ঠেকেছেন পদে পদে, শিখেছেন বাঁকে বাঁকে। সাহচর্য পেয়েছেন নানা, বাবার। সেই সঙ্গে বংশের সবাই কমবেশি বিভিন্ন দলের রাজনীতি করতেন। বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ও ছিল অনেক। 

এইভাবে গুণে মানে সুবিস্তৃত ছিলো তার পরিবার। মেধা মনন, প্রজ্ঞার সঙ্গে তৈরি হয় রুচিবোধ। কেমব্রিজে পড়ার সময় রেহমান সোবহান সিদ্ধান্ত নেন স্থায়ী হবেন ঢাকায়। গত বছর এক আলোচনায় বলেন, ' ঢাকায় থাকা ছিল  তার পলিটিকাল ও আইডিওলজিক্যাল সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিস্থিতির মধ্যেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন।'

লন্ডন থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসার পর পারিবারিক চামড়ার ব্যবসায় যুক্ত করতে চাইলেন তার বাবা। রেহমান সোবহানের ভাষায়, 'এটি ছিল তাঁর বাবার পিকিউলিয়ার আইডিয়া বা অদ্ভুত চিন্তা।' চামড়ার ব্যবসায় যুক্ত হওয়া নিয়ে পিতা-পুত্রের মধ্যে দ্বৈরথের বিষয়টিও উঠে আসে তার কথায়। সেখানে তিনি কথা বলেন রাজনীতি নিয়ে, উঠে আসে দেশের বিদ্যমান বৈষম্য আর অন্যায্যতার বিষয়ও।

১৯৫৭ সালে দেশে ফিরে যুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতায়। কাছ থেকে দেখেন পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ, সাধারণ মানুষের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও সেই সময়ের ছাত্র-জনতার রাজনীতি। সেই দ্রোহে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের শুরুতে একাডেমিক এক আলোচনায় "এক দেশ দুই অর্থনীতি" তত্ত্ব উচ্চারণ করলে ব্যাপক সাড়া জাগায়। জনশ্রুতি আছে, আইয়ুব খান জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'কে এই রেহমান সোবহান'। এভাবেই একজন তরুণ অর্থনীতিবিদ পরিচিতি পান পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামো চ্যালেঞ্জ করা সাহসী হিসেবে। 

এই বিষয়ের একটি বই প্রকাশিত হয়েছে "ফ্রম টু ইকোনমিস টু টু নেশনস : মাই জার্নি টু বাংলাদেশ" নামে ডেইলি স্টার বুকস থেকে। ১০ বছরে লেখা (১৯৬১-১৯৭১) নিবন্ধ, কলাম ও সম্পাদকীয় নিয়ে বইটি। যাকে বলা যায়, ষাটের দশকের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দলিল। যার প্রভাব এতোটা ছিল যে, শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা থেকে প্রতিটি কর্মসূচিতে প্রভাবিত হয়েছে এর দ্বারা। স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের বিভিন্ন সংকটকালেও রেহমান সোবহানের ভূমিকা ছিল অসামান্য দরদী।

একাত্তরে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের প্রতি ভারত সরকারের আস্থা সৃষ্টিতে তিনি তার সহযোগীদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। নব্বইয়ের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য হিসেবে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ছিলেন যুক্ত। আবার ছিয়ানব্বই নির্বাচন নিয়ে দেশে পুনরায় যখন অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়, তখন আরও চার বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে দুই নেত্রীর মাঝে সমঝোতা সৃষ্টিরও উদ্যোগ নেন। এইভাবে দেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার সোচ্চার প্রচেষ্টা স্মরণীয়।

২০২৪ গণঅভ্যুত্থানের আগে আগে ৮ জুলাই সমাজ গবেষণা কেন্দ্র এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে রেহমান সোবহান বলেন, 'বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় আমরা যাকে মধ্যবর্তী শাসনব্যবস্থা হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছিলাম, তা এখন পূর্ণাঙ্গ পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। আর শুধু সাধারণ পুঁজিপতিরা নয়, বরং ওই বিশেষ শ্রেণির একটি অংশ সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রকে হাতের মুঠোয় নিয়েছে।'

নিমর্ম বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। একটা রাষ্ট্রকে শেষ করে দিতে পুঁজিবাদীদের অপ্রপ্রয়াস ন্যাকারজনক। গণঅভ্যুত্থানের পরে ৭ ডিসেম্বর (বিআইডিএস) এক সম্মেলনে রেহমান সোবহান বলেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিনটি 'সংসদ নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ'। সেসব নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা কেবল রাবার স্ট্যাম্পের মতো কাজ করতেন। ফলে অবসর সময়ে তারা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কাজে সময় ব্যয় করেছেন। এর ফলে স্থানীয় সরকার অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটেছিল। সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ এলাকায় রীতিমতো জমিদার হয়ে গিয়েছিলেন।"

এইভাবে তিনি সত্য উচ্চারণ করেছেন পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে। যখন বহুমুখী প্রশংসার সমাজে বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ যখন গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছেন-- তখন বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও রেহমান সোবহানরা স্রোতের বিপরীতেই থেকেছেন। ভেবেছেন বাংলা ও বাঙালির সামাজিক মুক্তি নিয়ে। সামগ্রিক নিজস্বতায় দেশ দাঁড়াতে ভূমিকা রেখেছে তাদের সংগ্রামী জীবনের মূল্যবোধ। এই মানুষগুলোকে বলা যায় বাংলাদেশের সমাজ রাজনীতির অন্যতম দীক্ষাগুরু।

রেহমান সোবহান স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও জাতীয় বিকাশের ধারার সঙ্গে তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে তারুণ্যের ক্যানভাসে দলমত নির্বিশেষে প্রায় সবাই পাণ্ডিত্যের জন্য শ্রদ্ধা করেন এই অর্থনীতিবিদকে। তার বন্ধু প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, 'রেহমান সোবহান অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য পণ্ডিত।' এ ব্যাপারেও তার মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন অনেকে। 

এমন মানুষের সময়ে আমরা আছি এটাও নিশ্চয় আনন্দের। বিদ্বৎসমাজের অনেকের আগ্রহ বাংলার সামাজিক ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে জানার ও বুঝার। প্রসঙ্গে তার দুটি বই সহায়ক।

একটি- বাংলাদেশের অভ্যুদয়: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য। এতে ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দেশে-বিদেশে আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা পর্বের ঘটনাবলি একজন প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারী হিসেবে অভিজ্ঞতার আলোকে বইয়ে তুলে ধরেছেন, যা পাঠকে সমৃদ্ধ করবে। স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলোতে বিদেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সংগঠনেও অন্য অনেকের সঙ্গে রেহমান সোবহান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেদিন কত বাধা ও অপপ্রচারের মোকাবিলা করে প্রবাসী বাঙালিদের এই কাজ করতে হয়েছিল, তার কৌতূহলোদ্দীপক বর্ণনাও পাবেন। 

অন্যটি হচ্ছে স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ 'উতল রোমন্থন'। এটিও পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সাধারণ কোনো জীবনের সাধারণ গল্প নয়, বরং একটি সমৃদ্ধ জীবনবোধ, রাজনীতি ও দর্শনের প্রতিচ্ছবি রয়েছে এতে। কেবল স্মৃতির ওপর ভর করেও যে মানুষ এমন জনম-লিখন লিখতে পারেন, তা 'উতল রোমন্থন' না পড়লে বোঝা যেত না। এতে ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিকতার যে নিখুঁত বর্ণনা করা হয়েছে, তা বোধকরি রেহমান সোবহানের দ্বারাই সম্ভব। 

রেহমান সোবহান এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যার জীবন ও কর্ম তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক কৌতূহল, স্বাধীন চিন্তাভাবনা এবং স্বাধীনতার অনুসন্ধানকে মূল্য দেয় এমন জনগোষ্ঠীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত করেছে। ৯০ বছর বয়সী এই গুণী এখনো বক্তৃতা করেন দাঁড়িয়ে; দৃঢ়-কণ্ঠে বলেন অর্থনীতির গল্প। বিনয়ে স্বীকার করেন সহকর্মীদেরও অবদান। বলেন- দীর্ঘ জীবনের, কোনো গবেষণা ও লেখার কাজ এককভাবে করেননি। জানান অবসর নিতে আর খুব বেশি দেরি করবেন না। 'এখন আমার বয়স ৯০ বছর। আমি তৃতীয় আত্মজীবনী লিখছি। এটা লেখা হলে কলম ছুড়ে ফেলব। তখন টিভিতে সিরিয়াল দেখব।' 

অসাধারণ মানুষের সাধারণ এক ভাবনা। সামগ্রিক জীবনে আবিষ্কার করেছেন সমাজ সমন্বয় নীতি সংস্করণের সমালোচনামূলক নিবন্ধ, দুঃশাসনের ব্যবচ্ছেদ এবং দারিদ্র বিমোচনের কৌশল। দীর্ঘ জীবনের সংবেদী স্মৃতিকথার সঙ্গে বুনে দিয়েছেন ইতিহাস ও রাজনীতি সম্পর্কে। উপস্থাপিত হয়েছে অর্থনীতির তত্ত্ব বিষয়ক অসামান্য আলাপ। 

রেহমান সোবহান কথা বলেন উষ্ণ অনুভূতি নিয়ে। এখনো তার কথায় আসে দেশের বিদ্যমান বৈষম্য আর অন্যায্যতা। অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যায় তার লেখায়। আলোচনায় অনুপ্রাণিত করে প্রজন্মকে। নীতিনিষ্ঠ রেহমান সোবহানের অমিত সংগ্রাম এখনো থামেননি বুঝা যায়। প্রশ্ন উত্থাপন করেন উন্নয়নের অর্থনীতি, রাষ্ট্র চরিত্র ও প্রবণতা নিয়ে।

Comments

The Daily Star  | English

Pahela Baishakh sales better this year

In previous years, Baishakh celebrations and the purchase of new dresses accounted for an estimated one-fourth of annual sales by local fashion outlets.

8h ago