একুশের একাত্তর

ভাষা আন্দোলনে কিশোরগঞ্জ

দেশের অন্যান্য স্থানের মতো কিশোরগঞ্জে ভাষা আন্দোলনে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের মার্চে পাকিস্তানের গভর্নর মুহম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানে ও কার্জন হলে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে ঢাকার ছাত্র সমাজ।
কিশোরগঞ্জে ভাষা আন্দোলন
কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজ মাঠে শহীদ মিনার। ছবি: সংগৃহীত

(ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে চলতি বছর। ভাষা আন্দোলনের একাত্তরতম বছরে ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজন 'একুশের একাত্তর'। ধারাবাহিক এই আয়োজনে ২১ দিনে ডেইলি স্টার প্রকাশ করবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ২১ জনপদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। আজকের ষষ্ঠ পর্বে থাকছে কিশোরগঞ্জের ভাষা আন্দোলনের চিত্র।)

দেশের অন্যান্য স্থানের মতো কিশোরগঞ্জে ভাষা আন্দোলনে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের মার্চে পাকিস্তানের গভর্নর মুহম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানে ও কার্জন হলে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে ঢাকার ছাত্র সমাজ।

কিশোরগঞ্জেও উঠেছিল ছাত্র-জনতার প্রতিবাদের ঝড়। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে রাস্তায় নামে ছাত্র-জনতা। কিশোরগঞ্জ শহরের ইসলামিয়া ছাত্রাবাস, রথখোলার ময়দান, গুরুদয়াল কলেজ ও তরুণ লাইব্রেরি ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের কর্মসূচিতে মুখরিত হয়ে উঠে।

পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে কিশোরগঞ্জের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। অন্যদিকে আন্দোলনে নামা বাংলা ভাষাপ্রেমী ছাত্র-জনতার আন্দোলন প্রতিহত করতে তৎপর হয়ে উঠেন মুসলিম লীগের সদস্যরা।

দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় কিশোরগঞ্জে মুসলিম লীগ ও মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের দাপট ছিল প্রবল। কিশোরগঞ্জে এই প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে ভাষা আন্দোলন দমন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতা মওলানা আতাহার আলী, মুসলেহ উদ্দিন, সাইদুর রহমান, আবু লাইছ আলী, আবদুল আজিজ মোক্তার প্রমুখ।

তারা স্থানীয় মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের নিয়ে পাল্টা সংগঠন তৈরি করে এবং ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচিতে বাধা দেন। একই সঙ্গে মওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি পালন করা হয়।

'২১ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট কিশোরগঞ্জে সফল হয়। সেদিন শহরের গুরুদয়াল কলেজ, রামানন্দ হাইস্কুল, আজিমুদ্দিন হাইস্কুল, সরযুবালা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশীরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। আমরা যখন মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করছিলাম তখন দু-এক জায়গায় ধর্মঘটবিরোধী মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের অনুসারীদের তৎপরতা দেখা যায়।'

— অধ্যাপক ফুল হুসেন

কিশোরগঞ্জের স্থানীয় মাওলানাদের অধিকাংশই ছিলেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধী। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার পক্ষে প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিতে তারা দ্বিধাবোধ করতেন না। তাদের অশুভ তৎপরতা বন্ধ করতে কিশোরগঞ্জের সচেতন বুদ্ধিজীবী মহল ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়। সেসময় বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী, রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, আশরাফ উদ্দিন মাস্টার, শামসুদ্দিন আহম্মদ, অধ্যাপক নরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ, ফুল হোসেন প্রমুখ।

১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন কিশোরগঞ্জে নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হলেও থেমে থাকেননি সেখানকার ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই তারা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেন।

১৯৫২ সালে কিশোরগঞ্জের রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। একইসঙ্গে ছাত্রসমাজেও রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে।

১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে পুরো পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হয়। এর প্রভাব পড়ে কিশোরগঞ্জেও। এখানে গঠন করা হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।

এই পরিস্থিতিতে কিশোরগঞ্জের ছাত্রনেতারা ঢাকার কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংগ্রাম কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।

কিশোরগঞ্জ শহরের আখড়া বাজারের পরিত্যক্ত ভবনে গোপনে সভা করে হেদায়েত হোসেনকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদে অন্য সদস্যরা ছিলেন—আবু তাহের খান পাঠান, এবি সিদ্দিক, নজরুল ইসলাম, শাহাদাত চৌধুরী প্রমুখ।

কিশোরগঞ্জের প্রায় সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে থাকলেও জমিয়তে তেলাবিয়া আরাবিয়া রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে সমর্থন করে সার্বিক সহযোগিতা করেছিল।

মুসলিম লীগের সদস্য ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা আন্দোলনকারীদের দমনে নানান কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু তাতে থেমে থাকেনি আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর ঢাকার কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি সফল করতে আন্দোলনের নেতাকর্মীরা লিফলেট বিতরণ এবং চোঙা ফুঁকে প্রচারণা চালান। একই সঙ্গে একাধিক গোপন বৈঠকের মাধ্যমে আন্দোলনকে গতিশীল করার সিদ্ধান্ত নেন।

২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুসরণ করে কিশোরগঞ্জ শহর, বাজিতপুর ও করিমগঞ্জে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। সেদিন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ, কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, আজিম উদ্দিন হাইস্কুলসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা স্ব-স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মিছিল বের করে। তাদের কণ্ঠে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগান।

সেদিন কিশোরগঞ্জ শহরের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল। যদিও ইন্দিরা পট্টি ও তেলীপট্টিতে মুসলিম লীগ নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তা দোকানিদের দোকান খুলতে বাধ্য করা হয়েছিল। ভয়ভীতি উপেক্ষা করেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল কিশোরগঞ্জ শহর।

উত্তাল সেই দিনের স্মৃতিচারণা করে অধ্যাপক ফুল হুসেন লিখেছিলেন, '২১ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট কিশোরগঞ্জে সফল হয়। সেদিন শহরের গুরুদয়াল কলেজ, রামানন্দ হাইস্কুল, আজিমুদ্দিন হাইস্কুল, সরযুবালা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশীরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। আমরা যখন মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করছিলাম তখন দু-এক জায়গায় ধর্মঘটবিরোধী মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের অনুসারীদের তৎপরতা দেখা যায়।'

২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে গুলির সংবাদ কিশোরগঞ্জে এসে পৌঁছায় ২২ ফেব্রুয়ারি ভোরে। সমগ্র শহর উত্তাল হয়ে উঠে। রাস্তায় নেমে আসে সাধারণ ছাত্ররা।

২২ ফেব্রুয়ারি সকালে ছাত্ররা গুরুদয়াল কলেজ হোস্টেল চত্বরে কালো পতাকা তুলে শোকসভার আয়োজন করেন। ক্রমেই কিশোরগঞ্জ শহরের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে প্রত্যন্ত জনপদেও।

এ দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে প্রতিবাদী মিছিল বের হয়। মিছিলটি পুরো শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন শত শত তরুণ, যুবক, ছাত্র ও সাধারণ মানুষ।

কিশোরগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরি ও শাহী মসজিদে প্রতিবাদী সভা অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছাত্র-জনতার চোখে-মুখে ছিল গণবিস্ফোরণের দাবানল।

অধ্যাপক ফুল হোসেন আরও লিখেছিলেন, 'আমরা কিশোরগঞ্জের মানুষ ঢাকার নারকীয় হত্যাকাণ্ডের কাহিনী সে দিনই জানতে পারিনি। কিন্তু ২২ তারিখ ভোর বেলাতেই সে খবর শহরজুড়ে প্রচারিত হয়ে যায়। আমরা সবাই সকালেই কিশোরগঞ্জের শহীদী মসজিদের সামনের ইসলামিয়া বোর্ডিং অঙ্গনে জমায়েত হই। শহরের সাধারণ মানুষেরাও আসতে থাকেন। স্বতঃস্ফূর্ত সেই সমাবেশে হেদায়েত হোসেন, আবু তাহের খান পাঠান, আমি ও আরো একজন কি দুজনের বক্তৃতার পর পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি স্কুল-কলেজে ধর্মঘট, শহরের হরতালের মাধ্যমে প্রতিবাদ ও শোক দিবস পালনের সর্বাত্মক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।'

২১ ফেব্রুয়ারির পর থেকে কিশোরগঞ্জে আন্দোলন এতটাই প্রবল আকার ধারণ করে যে আন্দোলনের বিরোধিতাকারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

২২ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাজকুমার এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা সেদিন শোভাযাত্রা বের করে স্থানীয় বাজার ও কয়েকটি গ্রাম প্রদক্ষিণ করেছিল।

২৩ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জে হরতাল হয় ও ২টি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে শহরের খেলার মাঠে আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দেন আবু তাহের খান পাঠান, আশরাফ উদ্দিন মাস্টার, রশিদুর রহমান চৌধুরী, আমিনুল হক, শামসুদ্দিন আহমদ, সুন্দর আলী প্রমুখ।

২৫ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জের সাধারণ মানুষ শহরের রথখোলার মাঠে শহীদ মিনার নির্মাণ করে তাতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। শহীদ মিনার নির্মাণ ও আন্দোলনে মদদ দেওয়ার অভিযোগে আবু তাহের পাঠান, আশরাফ উদ্দিন মাস্টার, আমিনুল হক ও সুন্দর আলীর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেন তৎকালীন কিশোরগঞ্জের ডিআইবি ইন্সপেক্টর আওলাদ হোসেন।

কিন্তু তাতেও স্তিমিত হয়নি কিশোরগঞ্জের ভাষা আন্দোলন। আন্দোলনের একপর্যায়ে মুসলিম লীগের অনেক নেতাকর্মী স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচিতে যোগ দিতে শুরু করেন।

২৮ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জের খেলার মাঠে মুসলিম লীগ নেতা আবদুস আজিজ খাঁয়ের সভাপতিত্বে এক বিশাল গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন কিশোরগঞ্জ শহর ছাড়াও দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে হাজারো মানুষ ওই সমাবেশে যোগ দেন।

৭ মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, '২৮শে ফেব্রুয়ারী স্থানীয় খেলার মাঠে অন্যূন ৪০ সহস্র লোকের সমাবেশে এক বিরাট প্রতিবাদ সভা হয়। সভায় শহর ও গ্রামের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। মুসলিম লীগ নেতা জনাব আবদুল আজিজ খাঁ সভাপতিত্ব করেন। সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ, ভাষা আন্দোলনের বন্দীকৃত সকল ছাত্রের মুক্তি এবং বর্তমান মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবী করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।'

তথ্যসূত্র: ভাষা আন্দোলন কোষ প্রথম খণ্ড/ এম আবদুল আলীম

ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/ আহমদ রফিক

৭ মার্চ ১৯৫২, দৈনিক আজাদ

[email protected]

Comments