কালরাতের শুরুতেই শহীদ হন বুদ্ধিজীবী ফজলুর রহমান খান

গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল ফজলুর রহমান খানের বুক। কিন্তু তাতেও তৃপ্ত হয়নি হানাদাররা। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ফজলুর রহমানের বুকে X চিহ্ন কেটে দিল তারা।
শহীদ বুদ্ধিজীবী ফজলুর রহমান খান। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) পাশে বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার শিক্ষক ভবনের ২৩/এফ ফ্ল্যাটে থাকতেন মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমান খান।

স্ত্রী ফরিদা খানম ছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে ফরিদা খানম পিএইচডি করতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। এরপর থেকে ফজলুর রহমান খানের সঙ্গে থাকতেন তার কলেজশিক্ষার্থী ভাগ্নে কাঞ্চন ও কাজের সহযোগী ১০-১২ বছর বয়সী একটি ছেলে।

ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে এবং মার্চ মাসের শুরুর দিকে ভাগ্নে কাঞ্চনকে নিয়ে প্রায় নিয়মিতই ৩০৮/ এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাড়িতে আড্ডা দিতে যেতেন ফজলুর রহমান খান। বাড়িটি ছিল ফজলুর রহমান খানের ভায়রা প্রকৌশলী ড. শামিমুজ্জামান বসুনিয়ার। মার্চের শুরুর দিকে এই বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করেন আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন বসুনিয়া। পাশের বাড়িতেই থাকতেন ভয়েস অব আমেরিকার ব্যুরো চিফ সাংবাদিক রফিকুল হক। মূলত দেশের রাজনীতির খবরাখবর নেওয়ার জন্য বাড়িটিতে নিয়মিত যেতেন ফজলুর রহমান খান। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত চলত তাদের আড্ডা।

মার্চের মাঝামাঝি সময়ে জলবসন্তে আক্রান্ত হন ফজলুর রহমান খান। তখন তাকে দেখাশোনার জন্য তার শ্বশুরবাড়ি থেকে অত্যন্ত বিশ্বস্ত জবান আলী নামের এক ব্যক্তিকে পাঠানো হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠেন ফজলুর রহমান খান। এরপর জবান আলীকে নিয়েই পুনরায় ৩০৮/ এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িটিতে যাতায়াত শুরু করেন ফজলুর রহমান খান। সেখানে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, চলমান পরিস্থিতি ও অসহযোগ আন্দোলনের নানা কর্মসূচির খবরাখবর।

২৫ মার্চ সন্ধ্যায়ও সেই বাড়িতে গিয়েছিলেন ফজলুর রহমান খান। রাত ৯টার দিকে সাংবাদিক রফিকুল হক হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এসে বললেন, 'আজকের রাতটা সুবিধার নয়। ভয়ংকর কিছু হতে পারে। আমাকে এখনি আবার বের হতে হবে।'

বলে মুহূর্তের মধ্যে তিনি বেরিয়ে গেলেন। ফজলুর রহমান খান বাসায় ফেরার জন্য তোড়জোড় শুরু করলেন। শামিমুজ্জামান বসুনিয়া তাকে তাদের বাসায় রাতটি কাটিয়ে পরদিন সকালে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু রাজি হলেন না ফজলুর রহমান। কারণ তার ভাগ্নে এবং কাজের ছেলেটা ঘরে একা। তাই তিনি জবান আলীকে নিয়ে বাসায় ফিরে গেলেন। ভাগ্নে কাঞ্চন গিয়েছিলেন আজিমপুরে বাবার কাছে। তাকেও বলা হয়েছিল রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে যেতে। কিন্তু মামাকে একা রেখে থাকতে রাজি হননি কাঞ্চন।

ঘড়ির কাঁটা রাত ১১টায় পৌঁছানোর আগেই ঢাকার ঘুমন্ত নাগরিকদের উপর নারকীয় গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। রাত ১২টার দিকে হানাদার বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে গোলাবর্ষণ শুরু করে। এ সময় হানাদার সেনারা জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলে প্রবেশ করে।

ঘড়িতে তখন রাত ১২টা ২০ মিনিট। শোবার ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন ফজলুর রহমান খান। ভাগ্নে কাঞ্চন, জবান আলী, কাজের ছেলেটিও তখন ঘুমিয়ে। হঠাৎই ঘরের দরজায় রাইফেলের বাঁট ও বুটের লাথির আঘাত পড়ল।

দরজা যেন এখনই ভেঙে যাবে। বাইরে তখন দরজা খোলার জন্য উর্দুতে হুঙ্কার চলছে। এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে অধৈর্য হয়ে কাঞ্চন বলে উঠলেন, 'মামা, আমার ইউওটিসির ট্রেনিং আছে। সারেন্ডারের ভঙ্গিতে গিয়ে দরজা খুলে দিই, তখন ওরা কিছু করবে না।' ফজলুর রহমান খান ভাগ্নে কাঞ্চনকে ফেরাতে গিয়েও ব্যর্থ হলেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. ফজলুর রহমান খান স্মরণে প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকিট। ছবি: সংগৃহীত

দরজা খুলেই ফজলুর রহমান খান, কাঞ্চন, জবান আলী ৩ জন হাত উঁচু করলেন। কাজের ছেলেটা ভয়ে বাথরুমে গিয়ে লুকাল। সঙ্গেসঙ্গে হানাদারদের গুলি শুরু হলো। ঝাঁঝরা হয়ে গেল কাঞ্চনের শরীর। তখন সহ্য করতে না পেরে ফজলুর রহমান খান উচ্চকণ্ঠে বকতে শুরু করলেন। এরপরই ফের গুলি। ঝাঁঝরা হয়ে গেল ফজলুর রহমান খানের বুক। কিন্তু তাতেও তৃপ্ত হয়নি হানাদাররা। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তার বুকে X চিহ্ন কেটে দিল তারা। পাশেই বাথরুমে লুকিয়ে থাকা কাজের ছেলেটি করুণ চোখে দেখল এই বিভীষিকাময় মুহূর্ত। ভাগ্যক্রমে পায়ে গুলি লাগা সত্ত্বেও প্রাণে বেঁচে যান জবান।

ড. ফজলুর রহমান ও কাঞ্চনের মরদেহ সেভাবেই পড়েছিল আরও দেড় দিন। ২৭ মার্চ কারফিউ কিছু সময়ের জন্য উঠিয়ে নেওয়া হলে তাদের স্বজনরা মরদেহ ২টি নিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করেন।

রশীদ হায়দার সম্পাদিত 'স্মৃতিঃ ১৯৭১' এর প্রথম খণ্ডে ড. ফজলুর রহমান খানের চাচাতো ভাই আবদুল হান্নান ঠাকুর লিখেছেন, '২৭ মার্চ যখন কারফিউ কিছু সময়ের জন্য উঠিয়ে নেওয়া হলো তখন সংবাদ পেয়ে ভাই ও কাঞ্চনকে আনতে যাওয়া হয়। সে মর্মান্তিক দৃশ্য বর্ণনা করা সাধ্যতীত। ঘরে ও বারান্দায় রক্ত, শুধু রক্ত। জমাট বাঁধা কালো রক্ত। দরোজার পাশেই পড়ে আছে কাঞ্চনের লাশ। স্টিলের আলমারির গাঁ-ঘেঁষে ভাইয়ের একটি অনড় হাত পড়ে আছে আলমারির ওপর। মনে হয়েছিল এই আলমারিতে হয়তো কিছু ছিল যা ভাইয়ের কাছে মহামূল্যবান। পরে জানা গেছে এই আলমারিতে ফরিদা ভাবির কিছু জিনিস ছিল। ২৭ মার্চ তারিখে আজিমপুর কবরস্থানে ছোটভাই ও কাঞ্চনকে কফিনে পুরে তাড়াহুড়া করে পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়। আর সেখান থেকে আমরা ঘরে না ফিরে হায়েনার ভয়ে সবাই পালিয়ে যাই অজানার পথে।'

২৫ মার্চ কালরাতে ফজলুর রহমান খানের শহীদ হওয়ার খবর তার স্ত্রী ফরিদা খানম পেয়েছিলেন ভাসুর ড. বজলুর রহমান খানের কাছে। স্বামীর মৃত্যুর কথা জানতে পেরে তিনি ভীষণ মুষড়ে পড়েন। পিএইচডির পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে লন্ডনের একটি স্কুলে চাকরি নেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন ফরিদা খানম।

এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে শহীদ ড. ফজলুর রহমান খানের কাছ থেকে একটি চিঠি পান তার করাচিতে বসবাসরত মামাতো ভাই ড. আবদুল মতিন। চিঠিটি পাওয়ার কয়েকদিন আগেই ফজলুর রহমান খানের শহীদ হওয়ার খবর পেয়েছিলেন আবদুল মতিন। মূলত ২ মার্চ মামাতো ভাইকে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন ফজলুর রহমান খান।

সেই চিঠিতে ফজলুর রহমান খান মামাতো ভাইকে সস্ত্রীক ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, 'তোমার চিঠি পেয়েছি অনেকদিন হয়েছে। ফরেন এক্সচেঞ্জের অনুমতি অবশেষে পাইনি। ...ভাইসাব তোমার ২৬ তারিখের চিঠি পেয়েছেন। আমাকে বলেছেন তোমার কয়েকদিনের জন্য বাড়ি আসা খুবই প্রয়োজন। চিঠি পেয়েই লুটুকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি এসো'।

কৈশোর থেকেই রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন ফজলুর রহমান খান। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। তখন তিনি ছিলেন নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশি গুলিবর্ষণ ও ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে মোহনগঞ্জ হাইস্কুল থেকে এক বিরাট ছাত্র মিছিল বের হয়েছিল। সেই মিছিলে ২ সহোদর বজলুর রহমান খান ও আবদুল মতিনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ফজলুর রহমান খান।

মোহনগঞ্জ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে আইএসসি পাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ফজলুর রহমান খান। এই বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে বিএসসি ও এমএসসি পাসের পর একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়েছিল তার। পরে যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের অ্যাবারিস্টওয়িথ বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন তিনি।

শ্রেণিকক্ষের সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে পাঠদানের জন্য ছাত্রদের মাঝে তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তার সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ বহু শিক্ষার্থীকেই প্রভাবিত করেছিল।

তথ্যসূত্র:

স্মৃতি ১৯৭১: প্রথম খণ্ড/ রশীদ হায়দার

 

[email protected]

Comments