ইনার গ্রুপ: স্বাধীনতার প্রথম প্রয়াস
(১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রহর প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করলেও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য নানা তৎপরতার শুরু হয়েছিল আরও কয়েক দশক আগে। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম বীজ বপন করা হয়। স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম পর্ব।)
পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে চল্লিশের দশক থেকেই শুরু হয় নানা কার্যক্রম ও তৎপরতার। এসব কর্মকাণ্ডে নানা পর্যায়ে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ অনেকে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরী, আবদুল আজিজ বাগমার, সিরাজুল আলম খানসহ অনেকেই।
পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার প্রক্রিয়ায় সবগুলো কর্মকাণ্ড সম্পর্কেই অবগত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এর মধ্যে বেশিরভাগ কর্মকাণ্ডেই তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
এই প্রতিবেদনে আফসান চৌধুরী রচিত 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ধারাবাহিকতার ইতিহাস', মহিউদ্দিন আহমদ রচিত 'প্রতিনায়ক', মোরশেদ শফিউল হাসানের 'স্বাধীনতার পটভূমি ১৯৬০ দশক' এবং ডা. মাহফুজুর রহমানের 'বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ' এবং আবদুল আজিজ বাগমার রচিত 'স্বাধীনতার স্বপ্ন উন্মেষ ও অর্জন' এর তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
স্বাধীনতার প্রথম প্রয়াস
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করার প্রচেষ্টা শুরু হয় ইনার গ্রুপের মাধ্যমে। পরবর্তীতে পাকিস্তান জন্মের পর পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার জন্য গোপন প্রচেষ্টা শুরু করে ইনার গ্রুপ।
গবেষক আফসান চৌধুরী রচিত 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ধারাবাহিকতার ইতিহাস' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ইনার গ্রুপের প্রধান সংগঠক ছিলেন রাজনীতিবিদ ও সংগঠক মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরী। গ্রুপের সঙ্গে আরও যুক্ত ছিলেন সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কূটনীতিবিদ কামরুদ্দীন আহমদ, রুহুল কুদ্দুস (পরবর্তীকালে সচিব) প্রমুখ।
পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই ইনার গ্রুপের সদস্যরা স্বাধীনতায় সহায়তার জন্য ভারতীয় দূতাবাস ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ শুরু করেন। এ জন্য ইনার গ্রুপের কয়েকজন সদস্য কলকাতায় কয়েক মাস অবস্থান করে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। ভারত সরকার স্বাধীনতার জন্য তাদের মেঘালয়ে গোপন ট্রান্সমিটার বসাতে দিতেও রাজি ছিল।
ইনার গ্রুপের বিষয়ে আফসান চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইনার গ্রুপই সর্বপ্রথম স্বাধীনতার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিল। ওই গ্রুপের সদস্যরা আগে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের ছাত্রফ্রন্টে করতো এবং বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ওদের আদর্শ ছিল সুভাষ চন্দ্র বসু। ওরা চেয়েছিল শেখ সাহেবকে লন্ডনে পাঠিয়ে সুভাষ বসুর মতো আন্দোলন করা। কিন্তু ১৯৫৫ সালের পর তারা বুঝতে পারেন যে সুভাষ বোসের মডেলে স্বাধীনতা সম্ভব নয়।'
ইনার গ্রুপের কার্যক্রম কেবল ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি হলে ইনার গ্রুপের কার্যক্রমে কিছুটা ভাটা পড়ে। তবে এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যতিক্রম ছিল স্বাধীনতার আরেকটি প্রচেষ্টা।
ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট
১৯৫৮ সালের অক্টোবরে দেশে সামরিক শাসন জারির পর ইনার গ্রুপের কার্যক্রমে ভাটা পড়লেও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার উদ্যোগে ময়মনসিংহের জামালপুর মহকুমায় গঠিত হয় 'ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট'। সংগঠনটির প্রচারপত্রের বয়ান ছিল 'পূর্ব বাংলা বাঙালিদের, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ছাড়ো'। স্বল্প সময়েই ফ্রন্টের জামালপুর, নেত্রকোণা, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ মহকুমা কমিটি গঠিত হয়েছিল।
মহিউদ্দিন আহমদের 'প্রতিনায়ক' ও আফসান চৌধুরীর 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ধারাবাহিকতার ইতিহাস' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, 'ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টও ভারতের সাহায্যে সশস্ত্র উপায়ে দেশ স্বাধীন করতে চেয়েছিল। ১৯৫৯ সালের মার্চে গোপনে ভারতের আসামের মাইনকার চর ও ধুবড়ী হয়ে কলকাতা যান ফ্রন্টের নেতারা। কলকাতায় তাদের সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা সুরেন ঘোষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সুরেন ঘোষই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ করিয়ে দেন। যদিও ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ায় সে কথা স্মরণ করিয়ে নেহেরু অস্ত্র সাহায্যের বিষয়ে সীমাবদ্ধতার কথা জানান।'
গ্রন্থ দুটির সূত্রে আরও জানা যায়, ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট সম্পর্কে অবগত ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমেদ, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। প্রাথমিক পর্যায়ে শেখ মুজিব ফ্রন্টের জন্য নগদ অর্থ প্রদান করেছিলেন।
ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট রাজনৈতিকভাবে তেমন প্রভাব রাখতে না পারলেও 'পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা' শিরোনামে পোস্টার ও লিফলেট ছাপিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা তোলে। ফ্রন্টের কর্মীরা সচিবালয়, সিনেমা হলসহ জনবহুল স্থানে এসব পোস্টার লাগালে তা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের পাশাপাশি সরকারি মহলেও চাঞ্চল্যের তৈরি করে।
যদিও দ্রুতই পাকিস্তানি প্রশাসন ফ্রন্টের কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করলে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল ফ্রন্টটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একইসঙ্গে পাকিস্তানি প্রশাসনের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা হয়, দেশের বিরুদ্ধে বড়সড় ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের কথা বলতে গিয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট স্বাধীনতার স্বপক্ষে প্রথম বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল। ষাটের দশকে অনেক গ্রুপই তো কাজ করেছে। তবে তাদের কার্যক্রম খুবই সীমিত ছিল। এক্টিভিস্ট গ্রুপ বলতে যা ছিল তা ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট।'
শরীফ শিক্ষা কমিশন
পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার পথচলায় গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্দোলন ছিল ষাটের দশকে শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন।
'বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ', 'প্রতিনায়ক' ও 'স্বাধীনতার পটভূমি ১৯৬০ দশক' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ক্ষমতায় আরোহণের দুমাস পরই পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে শিক্ষাসচিব এস শরীফের নেতৃত্বে কমিশন অন ন্যাশনাল এডুকেশন নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। সংক্ষেপে শরীফ শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত এই কমিশনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষাবিদরা সদস্য হিসেবে ছিলেন।
১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট আইয়ুব খানের কাছে ৩৫০ পৃষ্ঠার একটি খসড়া প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ছিল দুই বছরের বিএ পাস কোর্সকে তিন বছর করা, অবৈতনিক শিক্ষা তুলে দেওয়া, উর্দু ও বাংলা বর্ণমালা সংস্কার করে রোমান বর্ণমালায় অক্ষরান্ত করা, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা ইত্যাদি।
কমিশনের এই প্রতিবেদন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ফলে কমিশনের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। প্রথমে ঢাকা কলেজে এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরো দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, 'আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্ররা তখন আন্দোলনের একটি সুযোগ খুঁজছিল। এ সময় সোহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তার হন। আবার তখন শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টও বের হয়ে। ফলে সব মিলে ছাত্রদের আন্দোলন শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধেই গড়ে উঠে।'
লেখক ও গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিক্ষা কমিশনের সুপারিশগুলো তখন বাস্তবায়িত না হলেও পরবর্তীতে আমরা সবগুলোই কিন্তু গ্রহণ করেছি। মূলত আন্দোলনে নামার ক্ষেত্র হিসেবে শিক্ষা কমিশনকেই টার্গেট করেছিল ছাত্ররা।'
আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির বৈঠক
'প্রতিনায়ক' ও 'স্বাধীনতার পটভূমি ১৯৬০ দশক' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ১৯৬১ সালের শেষের দিকে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ এবং খোকা রায়ের মধ্যে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে শেখ মুজিব বলেন, 'এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হনে। আন্দোলনের প্রোগ্রামে ওই দাবি রাখতে হবে।'
আফসান চৌধুরী বলেন, 'শেখ সাহেব যখন মণি সিংহ এবং খোকা রায়ের সঙ্গে বৈঠকে স্বাধীনতার প্রস্তাবটি তুললেন, তখন মণি সিংহরা রাশিয়াতে জিজ্ঞেস করে যে আমরা এই উদ্যোগে জড়িত হবো কি না। কিন্তু রাশিয়া থেকে সম্মতি না আসায় তারা বলেন, আমরা মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে থাকতে চাই। ১৯৬৮ সালের আগে এরপর আর কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতার পক্ষে কোনো কাজ করেনি।'
শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ বরাবরই স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার ছিল। 'প্রতিনায়ক' সূত্রে আরও জানা যায়, '১৯৬১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসেও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণিসহ ছাত্রলীগের একাধিক নেতার নেতৃত্বে রাতের অন্ধকারে "স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কায়েম কর" লিখিত লিফলেট ও পোস্টার বিলি করেছিলেন। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গোপনে পূর্ব বঙ্গ মুক্তি ফ্রন্টের প্রচারণা চালানো হয়। এই লিফলেটটিতে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার আহ্বান জানিয়ে লেখা হয়েছিল।'
স্বাধীনতার জন্য ষাটের দশক থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান কতোটা সক্রিয় ছিলেন তার প্রমাণ মিলে 'প্রতিনায়ক' গ্রন্থে।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে স্বাধীনতার পক্ষে ভারত সরকারের সমর্থনের জন্য গোপনে ত্রিপুরা সফর করেন শেখ মুজিব। এই ত্রিপুরা সফরে শেখ মুজিবের সহযাত্রী ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা রেজা আলী। তার ভাষ্য অনুযায়ী, গোপনীয়তার স্বার্থে নারায়ণগঞ্জ থেকে সিলেটগামী ট্রেনে তারা টঙ্গী স্টেশন থেকে উঠেছিলেন।
টিকেটও কাটা হয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নের অন্য দুই নেতার নামে। ফলে শেখ মুজিবের ওই ট্রেন ভ্রমণের রেকর্ড রেলওয়ে বিভাগের কাছে ছিল না।
মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, 'সে সফরে ভুল বোঝাবুঝির কারণে বঙ্গবন্ধু কিন্তু একদিন জেলেও ছিলেন। সেই সফর কিন্তু ব্যর্থ হয়। তিনি ফিরে এসে পরদিনই জননিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন।'
কয়েকমাস পর মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব ডিসেম্বরে ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়ার উদ্যোগে ইত্তেফাক অফিসে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় কূটনীতিবিদ শশাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী গোপন বৈঠক করেন।
বৈঠকের একপর্যায়ে শেখ মুজিব তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুকে ব্যক্তিগতভাবে সম্বোধন করা একটি চিঠি দেন। চিঠিতে ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে লন্ডন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও প্রবাসী সরকার গঠনের একটি কর্মপরিকল্পনাও ছিল।
এ নিয়ে নেহেরুর সঙ্গে বৈঠকের ইচ্ছেও প্রকাশ করেন মুজিব। কিন্তু এমন সময় চীন-ভারত যুদ্ধ হওয়ায় আরেকটি যুদ্ধে যেতে রাজি হয়নি ভারত। ফলে দিল্লি থেকে অপেক্ষায় থাকতে বলা হয়। কিন্তু শেখ মুজিব ধরে নিয়েছিলেন যে ভারতীয় আমলাদের জন্যই দেরী হচ্ছে। তাই ভারত সরকারের চূড়ান্ত মনোভাব জানতে ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে ত্রিপুরায় মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের সঙ্গে দেখা করেন শেখ মুজিব।
শেখ মুজিবকে আগরতলায় রেখেই দিল্লি যান মুখ্যমন্ত্রী। দিল্লিতে নেহেরু ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, শেখ মুজিবের প্রস্তাবের বিষয়ে ভারত অবগত রয়েছে। এরপর থেকে তিনি যেন একমাত্র ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমেই দিল্লিতে যোগাযোগ করেন।
অপূর্ব সংসদ
শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা রেখেছিল ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গঠিত হওয়া পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফোরাম। ফোরামের সভাপতি ছিলেন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ ওয়ারেস ইমাম ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের ছাত্রনেতা আবদুল আজিজ বাগমার।
প্রথমে দেশে সামরিক আইন থাকার কারণে আন্দোলন কিছুটা সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৯৬২ সালের ১ মার্চ সামরিক শাসন তুলে নেওয়া মাত্রই শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জের এক ছাত্রসভায় ছাত্রনেতা আবদুল আজিজ বাগমার পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিষয়টি উচ্চারণ করেন। বাগমার তার রচিত 'স্বাধীনতার স্বপ্ন, উন্মেষ ও অর্জন' গ্রন্থে 'স্বাধীনতার প্রথম স্লোগান' অনুচ্ছেদে লিখেছেন, '১৯৬২ সালে এ ধ্বনিটি বা স্লোগানটি আমিই উচ্চারণ করেছিলাম।' সেই ছাত্রসভায় সবাই স্বাধীনতার পক্ষে শপথ নেওয়ার উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, 'তারা আরও একটি শপথ নেয় যে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করা হবে।'
শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের মাঝেই ১৯৬২ সালের ১ অক্টোবর স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা গড়ে তোলার জন্য জন্ম হয় আরেকটি নতুন গোপন সংগঠনের—অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার। সাংস্কৃতিক নাম অপূর্ব সংসদ।
কবি সুফিয়া কামালকে রাষ্ট্রপতি, আবদুল আজিজ বাগমারকে প্রধানমন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ শরীফ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুহম্মদ আবদুল হাই ও শওকত ওসমানকে উপদেষ্টা করে অপূর্ব সংসদের একটি সরকার কাঠামোও ঠিক হয়। অপূর্ব সংসদের মনোগ্রাম অঙ্কন করেন প্রাণেশকুমার মণ্ডল।
১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত 'বাঙালি কি চায়? স্বাধীনতা', 'শকুন-শৃগালের আবার বাংলা আক্রমণ', 'ইতিহাসের ধারায় বাঙালী' শিরোনামে অপূর্ব সংসদের তিনটি ইশতেহার প্রকাশিত হয়।
অপূর্ব সংসদের উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা' গানটিকে ভবিষ্যতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলা। স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণার জন্য অপূর্ব সংসদের কর্মীরা মূলত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের ট্রেনের ইন্টারক্লাস যাত্রীদেরই বেছে নিতেন। অপূর্ব সংসদ সম্পর্কে অবগত ছিলেন শেখ মুজিব থেকে মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য জাতীয় নেতারা।
অপূর্ব সংসদ বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অপূর্ব সংসদ ছিল ছাত্রলীগের মধ্যেই একটি গ্রুপ। তবে তাদের প্রকাশ্যে কোনো প্রচার ছিল না। যা করেছিল সব গোপনেই। তবে তাদের তৃতীয় ইশতেহার "ইতিহাসের ধারায় বাঙালি" ভীষণ দূরদর্শী ছিল। এটি লিখেছিলেন অধ্যাপক আহমদ শরীফ।'
ষাটের দশকের প্রতিটি আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর সংযোগ ছিল জানিয়ে লেখক ও গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, 'শেখ সাহেব আসলে একটিভ পার্টিসিপেন্ট ছিলেন। স্বাধীনতার কোনো প্রচেষ্টা হলেই শেখ সাহেব, মওলানা ভাসানী, মানিক মিয়ার কাছে আসতেন। যাদের সঙ্গে শেখ সাহেবের সম্পর্ক পূর্বে ছিল না, তারাও শেখ সাহেবের কাছে গিয়েছেন। সুতরাং বলা যায়, স্বাধীনতার যতোগুলো প্রচেষ্টা ছিল সবগুলোর সঙ্গে শেখ সাহেবের একটি সংযোগ ছিল।'
Comments