বিজয় ত্বরান্বিত করেছে যেসব যুদ্ধ

দেশব্যাপী সংঘটিত এমন যুদ্ধের মাঝে কিছু ছিল অবিশ্বাস্য ও দুঃসাহসিক সামরিক কৌশলের। এই যুদ্ধগুলোতে মুক্তিবাহিনী জয়লাভ করায় মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুরে গিয়েছিল।
মহান বিজয় দিবস ২০২৩
ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়জুড়ে দেশব্যাপী অসংখ্য গেরিলা আক্রমণের পাশাপাশি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং সুপরিকল্পিত যুদ্ধ পরিচালনা করে মুক্তিবাহিনী। এসব যুদ্ধে কখনো বিজয়ী হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা, আবার কখনো বিজয়ী হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরাজিত হলেও মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই দমে যাননি। দেশকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে রণাঙ্গনে চালিয়ে গেছেন লড়াই।

দেশব্যাপী সংঘটিত এমন যুদ্ধের মাঝে কিছু ছিল অবিশ্বাস্য ও দুঃসাহসিক সামরিক কৌশলের। এই যুদ্ধগুলোতে মুক্তিবাহিনী জয়লাভ করায় মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুরে গিয়েছিল।

এই যুদ্ধে জয়ের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন দেশব্যাপী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠে, তেমনি যুদ্ধগুলোতে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আত্মবিশ্বাস ও মনোবল পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে পাকিস্তানি বাহিনী। যার ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে তারা।

মুক্তিযুদ্ধের বই ও নথিপত্র থেকে ব্যাপক গবেষণা এবং প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ডেইলি স্টার এমন ছয়টি যুদ্ধ চিহ্নিত করেছে, যেগুলো নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে যুদ্ধের গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়েছে।

বিলোনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ

'ফেনী-বিলোনিয়া রণাঙ্গনের এক প্রান্তর' বইয়ের তথ্যানুসারে, মুক্তিযুদ্ধে বিলোনিয়ার যুদ্ধই ছিল প্রথম যুদ্ধ যেখানে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী।

এ যুদ্ধের রণাঙ্গন ছিল ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার একাংশজুড়ে। যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৫ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত।

৫ নভেম্বর ছিল কার্তিকের হিম শীতল বৃষ্টিস্নাত রাত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ও পিনপতন নীরবতা। অন্ধকারের মধ্যেই দশম ইস্ট বেঙ্গলের মেজর জাফর ইমামের (পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) নেতৃত্বে ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

চৌকস ও নির্ভুলভাবে অগ্রসর হয়ে তারা তিন দিক থেকে ভারত সীমান্তবর্তী বেলোনিয়ার একটি বিশাল এলাকা ঘিরে ফেলেন। ঘেরাওয়ের পর শুরু হয় অবস্থান গ্রহণের কাজ। সারারাত ধরে চলে বাঙ্কার খনন। এক সময় ভোর হয়। কিন্তু পাকিস্তানিরা তখনো জানে না আগের রাতে কী ফাঁদে আটকে গেছে তারা।

৬ নভেম্বর সকাল থেকে শুরু হয় মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ। টানা তিনদিনের যুদ্ধে নাকাল হয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। ৯ নভেম্বর অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্যার্থে স্যাবর জেট দিয়ে উড়োজাহাজ হামলা চালানো হয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে একটি স্যাবর জেট ভূপাতিত হলে বন্ধ হয়ে যায় হামলা। শেষ পর্যন্ত ১০ নভেম্বর রাতে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী।

দশম ইস্ট বেঙ্গলের কামান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীর বিক্রম এক সাক্ষাৎকারে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবস্থানগত কারণে বিলোনিয়া অঞ্চল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে এ যুদ্ধে জয় গোটা যুদ্ধের মোড়ই পরিবর্তন করে দিয়েছিল। এ যুদ্ধে বিজয়ের পরপরই দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও বিজয়ের সুবাস আসতে শুরু করে। আজও বিলোনিয়া যুদ্ধের রণকৌশল বিশ্বের বহু সামরিক কলেজে পাঠ্যসূচির অংশ।'

অপারেশন ডাবর ফেরিঘাট ও জাওয়া ব্রিজ ধ্বংস

"স্বাধীনতা '৭১ মুক্তিযুদ্ধে জনযোদ্ধা" বইয়ে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া আরেকটি যুদ্ধ ছিল সুনামগঞ্জের ডাবর ফেরিঘাট ও জাওয়া ব্রিজ ধ্বংস। দুটি যুদ্ধ পৃথক দিনে হলেও দুটিরই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট (পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) আবদুর রউফ।

সিলেট ও সুনামগঞ্জকে সড়কপথে যুক্ত করা ডাবর ফেরিঘাট ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাঁচ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মীর শওকত আলী সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আবদুর রউফকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে ডাবর ফেরিঘাট ধ্বংসের নির্দেশ দেন। সেই সময় ফেরিঘাটে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল পাকিস্তানি ৯১ মুজাহিদ ব্যাটেলিয়নের একটি প্লাটুন ও একদল রাজাকার।

১২ নভেম্বর রাতে লেফটেন্যান্ট রউফের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা ফেরিঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর ফেরিঘাটের দখল নেন তারা। একই রাতে তারা লিমপেট মাইন দিয়ে ফেরিটি উড়িয়ে দেন।

মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছাতক দখলের জন্য জাওয়া সড়ক ও রেল ব্রিজ ছিল বড় অন্তরায়। ১২-১৫ অক্টোবর সংঘটিত ছাতকের যুদ্ধের তৃতীয় বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা ছাতক সিমেন্ট কারখানা দখল করতে পারলেও ধরে রাখতে পারেননি।

ফলে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রউফকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ব্রিজ দুটি ধ্বংসের নির্দেশ দেন সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী। ২৯ নভেম্বর রাতে রউফের নেতৃত্বে ১৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে চার ঘণ্টা যুদ্ধের পর ব্রিজ দুটি উড়িয়ে দেন। এই দুটি ব্রিজ ধ্বংস করায় পাকিস্তানি বাহিনী পুরো অঞ্চল থেকে পালিয়ে যায়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবদুর রউফ বীর বিক্রম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই দুটি যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা সিলেটের অগ্রভাগে পাকিস্তানিদের এক রকম পঙ্গু করে দিলাম। ডাবর ফেরিঘাট ধ্বংস করার কারণে সুনামগঞ্জে যেমন পাকিস্তানিদের সমস্ত রসদ বন্ধ হয়ে গেল, তেমনি জাওয়া ব্রিজ ধ্বংস করায় ছাতক, দোয়ারাবাজার, টেংরাটিলাসহ সুনামগঞ্জের অংশ আমাদের দখলে চলে এলো।'

অপারেশন কানাইঘাট

মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের যুদ্ধে এক অবিস্মরণীয় স্থান দখল করে আছে কানাইঘাট যুদ্ধের একটি কাউন্টার অ্যাটাক। এই আক্রমণটির জন্যই কানাইঘাট দখল করতে পেরেছিলেন ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা, যা সিলেটের যুদ্ধের মোড় পরিবর্তন করে দিয়েছিল।

'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ—ব্রিগেড ভিত্তিক ইতিহাস' বই থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানির অবস্থান ছিল কানাইঘাট ও দরবস্ত এলাকাতে। একটি সংযোগসড়কের মাধ্যমেই দুটি অবস্থানের যোগাযোগ পরিচালনা করত পাকিস্তানি বাহিনী। সিলেট মুক্ত করতে হলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীকে এই সংযোগ সড়কটি দখল করেই আসতে হতো।

নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে আটগ্রাম ও জকিগঞ্জ মুক্ত করে ২২ নভেম্বর গৌরিপুরে পৌঁছায় প্রথম বেঙ্গল।

এ সময় ৩১ পাঞ্জাবের আলফা কোম্পানির সেনারা প্রথম বেঙ্গলের আলফা ও ব্রাভো কোম্পানির ওপর আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।

২৬ নভেম্বর ডেল্টা কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ওয়াকার হাসানের নেতৃত্বে পাল্টা আক্রমণ চালান মুক্তিযোদ্ধারা। ব্যাপক হতাহতের ঘটনার মধ্যেও ওয়াকার তার অবশিষ্ট বাহিনীকে একত্রিত করেন এবং যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেন।

তার সাহস ও কৌশলে ২৬ জন পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি কমান্ডার মেজর সারওয়ারসহ নিহত হয় ৮৮ জন পাকিস্তানি সেনা।

মেজর ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ওই যুদ্ধটিতে আমরা জয়লাভ না করতে পারলে কানাইঘাট দখল করা সম্ভব হতো না। ফলে সিলেটের যুদ্ধেও আমরা জয়লাভ করতে পারতাম না। সে রাতে আমার মাত্র এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা দুর্ধর্ষ পাঞ্জাব সেনাদের বিরুদ্ধে যে দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, তা বিরল।'

অপারেশন নাট ক্র্যাক

মুক্তিযুদ্ধে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো এক যুদ্ধ ছিল আখাউড়া দখলের যুদ্ধ বা অপারেশন নাট ক্র্যাক। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত এই যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে ঢাকা বিজয়ের পথ অনেকাংশেই উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল।  

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (দশম খণ্ড) থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে রেলপথের জন্য সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে আখাউড়া ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আখাউড়ার দখল নিতে পারলেই চট্টগ্রাম ও সিলেটে রেলপথে সেনা-পরিবহন-রসদ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারবে মুক্তিবাহিনী।

৩০ নভেম্বর ভারতীয় ১০ বিহার রেজিমেন্টের সহায়তায় অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে আখাউড়ার পশ্চিম এলাকাগুলো দখল নিয়ে নেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা।

দ্বিতীয় পর্যায়ের আক্রমণে ১ ডিসেম্বর রাতের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনীর সিঙ্গারবিল রেলওয়ে স্টেশন ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালান দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা।

এ সময় পাকিস্তানি সেনারা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হলেও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় দুপক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ। ২ ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত চলে একটানা যুদ্ধ।

প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটলেও ফের সংগঠিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। তখন মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা আক্রমণ চালালে দুপক্ষের মধ্যে তুমুল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়, যা ভোর ৫টা পর্যন্ত চলে।

প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাল্টা হামলা শুরু করে। এই অনবরত হামলার মাধ্যমে ৩ ডিসেম্বর আজমপুর রেলস্টেশন দখল করে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল।

৪ ডিসেম্বর ভারতীয় দুটি ব্রিগেড মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলে যৌথ বাহিনী। টানা ছয় দিনের যুদ্ধশেষে ৪ ব্রিগেড সেনাসহ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি বাহিনী।

অপারেশন নাট ক্র্যাকের আলফা কোম্পানির কমান্ডার ডা. মোহাম্মদ আনিসুল হাসান ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'টানা এক সপ্তাহের এই যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাকবোন ভেঙে দিয়েছিলাম আমরা। এই যুদ্ধের পর ঢাকা বিজয় তখন কেবল সময়ের অপেক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চট্টগ্রাম ও সিলেটে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাদের সমস্ত রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পেরেছিলাম আমরা।'

অপারেশন কিলো ফ্লাইট

স্থলযুদ্ধের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের মোড় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বিমানযুদ্ধও। অপারেশন কিলো ফ্লাইট ছিল মুক্তিযুদ্ধে বিমানবাহিনীর অপারেশনগুলোর সমন্বিত সাংকেতিক নাম।

আলমগীর সাত্তারের লেখা 'কিলো ফ্লাইট'বই থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের ৩ ডিসেম্বর সংঘটিত অপারেশন কিলোফ্লাইটের দুটি অপারেশনেই মুক্তিযুদ্ধের ভাগ্য পুরোপুরি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।

২৮ অক্টোবর ভারতের নাগাল্যান্ডে তিনটি বেসামরিক উড়োজাহাজ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং। প্রতিষ্ঠার পরপরই বেসামরিক বিমানগুলোকে সামরিক বিমানে পরিণত করা হয়। ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে চলে বৈমানিকদের নিবিড় প্রশিক্ষণের কাজ।

৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে হামলা চালালে রাতে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের তেলের ডিপোতে প্রথম উড়োজাহাজ হামলা চালান অপারেশন কিলো ফ্লাইটের অধিনায়ক স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম।

একই রাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উড়োজাহাজ হামলা চালান অপারেশন কিলোফ্লাইটের সদস্য ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম। একইরাতে গুরুত্বপূর্ণ দুটি জ্বালানি তেলের মজুতস্থানে হামলা চালানোর ফলে ধ্বংস হয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনীর সিংহভাগ জ্বালানি তেল।

মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইং গঠনের অন্যতম প্রস্তাবক ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার বীর প্রতীক বলেন, 'অপারেশন কিলো ফ্লাইটের মাধ্যমেই পাকিস্তানিদের চূড়ান্ত ভাগ্য নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারি আর নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সমস্ত জ্বালানি তেলের প্রধান মজুত। আমরা যখন বিমান থেকে বোমা ফেলে ওই দুটি কারখানা আর ডিপো ধ্বংস করলাম, তখন ওরা জ্বালানির অভাবে উড়োজাহাজ উড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলল। বাংলার আকাশও মুক্ত হয়ে গেল।'

অপারেশন হটপ্যান্টস

স্থল ও আকাশ যুদ্ধের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে মোড় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল নৌ যুদ্ধও।

'মুক্তিযুদ্ধে নৌ সেনানী' বই থেকে জানা যায়, আগস্টে সংঘটিত অপারেশন জ্যাকপটের মতো আরেকটি দুঃসাহসিক নৌ অভিযান ছিল খুলনা অঞ্চলে পরিচালিত অপারেশন হটপ্যান্টস।

নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত পরিচালিত অপারেশন হটপ্যান্টসের মাধ্যমে সমুদ্রে মুক্তিবাহিনীর আধিপত্য পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

অপারেশন জ্যাকপটের পর ছোট ছোট অসংখ্য অপারেশন করলেও লিমপেট মাইন ও সামান্য এক্সপ্লোসিভ দিয়ে বড় ধরনের আক্রমণ করতে পারছিলেন না নৌযোদ্ধারা। সেই সময় তারা শত্রুর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করতে হলে গানবোটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন অপারেশন জ্যাকপটের উপদেষ্টা মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন।

জালাল উদ্দিনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা বন্দর ট্রাস্ট পরিত্যক্ত দুইটি টহল যান মুক্তিবাহিনীর নৌ ইউনিটকে দেয়। এরপর টহলযানকে গানবোটে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়। পরে গানবোট দুটির নাম হয় 'বিএনএস পদ্মা'ও 'বিএনএস পলাশ'।

১০ নভেম্বর গানবোট দুটি দিয়েই অপারেশন হটপ্যান্টসের অভিযান শুরু হয়। এদিন নৌযোদ্ধারা মংলা বন্দরের প্রবেশমুখে মাইন বসান।

সফল এই অভিযানের পর ১১ নভেম্বর নৌযোদ্ধারা গভীর সমুদ্রে করাচি থেকে মোংলাগামী ১০ হাজার টন খাদ্য, রসদ ও সমরাস্ত্রবাহী ব্রিটিশ জাহাজ 'দ্যা সিটি অফ সেইন্ট এলব্যান্স' আটক করেন। একইদিন জুলফিকার চ্যানেলে নৌযোদ্ধাদের মাইন বিস্ফোরণে পাকিস্তানি গানবোট 'তোফায়েল' ডুবে ৩৫ সেনা নিহত হয়।

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে হটপ্যান্টসের সদস্যদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে পাঁচটি বিদেশি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন শেষে ১০ ডিসেম্বর সকালে অপারেশন হটপ্যান্টসের সদস্যরা মোংলা পোর্ট দখল করেন। মোংলা বন্দর দখলের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জিত হয়।

অপারেশন হটপ্যান্টসের অন্যতম সদস্য ও অপারেশন জ্যাকপটের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জালাল উদ্দিন বীর উত্তম ডেইলি স্টারকে বলেন, '১১ নভেম্বর আমরা গভীর সমুদ্রে যে ব্রিটিশ জাহাজটি আটক করেছিলাম, সে জাহাজে দুই হাজার টন ভারী সমরাস্ত্র ছিল। এই জাহাজটি মোংলায় যদি খালাস হতো, তাহলে যুদ্ধ অনেক দীর্ঘায়িত হতো। একইসঙ্গে বিদেশি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। ফলে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল থাকা পাকিস্তানি সেনাদের সমুদ্রপথে সমস্ত রসদ আসা বন্ধ হয়ে গেল। ১০ ডিসেম্বর আমরা মোংলা পোর্ট দখল করলে বিজয় কেবল সময়ের অপেক্ষা ছিল।'

Comments