স্বাধীনতার স্বাদ ফিরে পাওয়া: অসংখ্য ফাঁদে পরিপূর্ণ এক অসামান্য সুযোগ

আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আমরা কীভাবে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করব।
ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে জনবিক্ষোভে একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের ঘটনা আমাকে সাবিনা ইয়াসমিনের একটি গানের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে—'সব কটা জানালা খুলে দাও না, আমি গাইবো, গাইবো বিজয়ের গান'। এই গানটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের হলেও আজকের দিনে গানের কথাগুলো আবারও মনে পড়ছে। হঠাৎ করেই আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করতে শুরু করেছি, যেখানে স্বাধীনভাবে চিন্তা করা যাচ্ছে। আমরা অনেকেই বাকস্বাধীনতার চর্চা ভুলে গেছি। শাসক গোষ্ঠীর নজরদারি এড়াতে আমরা হয় মোবাইল বন্ধ কিংবা পাশের কক্ষে রাখতাম। অবচেতন মনেই সেলফ-সেন্সরশিপের অভ্যাস আমাদের মজ্জাগত হয়ে পড়েছে।

যখন দেশের সংবাদমাধ্যমের একটি ছোট অংশ ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা চালিয়ে গেছে, তখন বাকিরা নতজানু থাকার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে ক্ষমতাবানদের আরও কাছে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। 'অতন্দ্র প্রহরীর' ভূমিকায় না থেকে 'আজ্ঞাবহ' সাংবাদিকতার চর্চা করেছেন তারা। যেকোনো মত প্রকাশের ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত পরোক্ষভাবে বলতে হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই আতঙ্কজনক ছিল যে, খুব কাছের মানুষ ছাড়া অন্যদের সঙ্গে অকপটে কেউ কথাও বলত না। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রেও প্রায় সবাই চাইতো 'নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক' থাকতে।

গত ১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনা বা তার পরিবারের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কিছুই বলা যায়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে 'সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী'সহ এ ধরনের আরও কিছু শব্দাংশের ব্যবহার হতো। জাতির জনকের প্রতি সম্মান দেখানোর অজুহাতে এমন একটি আইন পাস হয়েছিল, যার ফলে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের যেকোনো সদস্যের সামান্য সমালোচনাকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত করা হয়। মেয়াদের পুরো সময়জুড়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, তার বোন, ছেলে, মেয়ে, ভাগ্নে ও ভাগিনাকে নিয়ে কোনো ধরনের কার্টুন আঁকা কিংবা কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করা যেত না, সেটা যতই তথ্যপ্রমাণভিত্তিক হোক না কেন। এগুলো করলে কারাদণ্ডসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আমাদের লেখায় ওই 'পরিবার' ছাড়া বাকি সব কিছুই স্থান পেত।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচনে কারচুপি করেও শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পার পেয়ে যাওয়ার বিষয়টি ছিল আমাদের মনোবল ভেঙে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের মনের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে, তা সেই গণতন্ত্র যতই ত্রুটিপূর্ণ হোক না কেন। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। হয়তো আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন ছিল। বারবার নির্বাচনে কারচুপি করায় হাসিনা সরকার জনগণের চিন্তাধারার প্রকৃত প্রতিফলন সম্পর্কে জানতে পারেনি, যা সাধারণত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন থেকে জানা যায়। এর বড় প্রমাণ ভারতের সবশেষ নির্বাচনের ফল। নির্বাচনে কারচুপি করে শেখ হাসিনা, তার সরকার ও তার দল কখনোই আসল বার্তাটি পায়নি এবং সেই কারণেই যখন শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ শুরু হলো, হঠাৎ করেই তাদের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়।

আমার মনে যে প্রশ্নটি বারবার আসছে, তা হলো—কীভাবে আমরা এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছালাম? কেন আমরা তা প্রতিরোধ করতে পারিনি? যখন আমাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছিল, আমরা কি প্রতিবাদ জানিয়েছি? এর মাধ্যমেই বোঝা যায় যে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কী পরিমাণ নৈতিক স্খলন ঘটেছে। শেখ হাসিনা যত বেশি করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাইলেন, আমরাও তত বেশি আপসের পথে হাঁটলাম।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে বেশ কয়েকজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদ ছিলেন। এই রাজনীতিবিদরা তাদের পুরোটা জীবন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যুক্ত থেকেছেন। দরিদ্রদের অধিকার, নারী অধিকার আদায়, উগ্রবাদ-বিরোধিতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে লড়েছেন। কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের জোটের অংশ হয়ে তারা সবাই বিশেষ সুযোগ-সুবিধা, বিত্ত ও ক্ষমতার বেড়াজালে আটকে গেছেন। এই নেতারা টের পেলেন না যে তাদের মধ্যেও নৈতিকতার অবক্ষয় শুরু হয়েছে?

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের মেয়াদে সরকার কিংবা এর বাইরে থেকে একজনও পদত্যাগ করেছেন, এমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কোনো মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, উপাচার্য অথবা বিচারকের সেই নৈতিক সাহসটুকু ছিল না যে স্রোতের বিপরীতে যেয়ে বলবেন, 'যথেষ্ট হয়েছে। আমি আর এগুলো নিতে পারছি না এবং এখন থেকে আমার বিবেক আমাকে যে পথে নেয়, আমি সে পথে চলব।'

তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে সরিয়ে দিতে যেভাবে আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিচারকরা একতাবদ্ধ হয়েছিলেন, সেটা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বাহী বিভাগের কাছে বিচার বিভাগের সবচেয়ে লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ। আপিল বিভাগের সব বিচারককে প্রেসিডেন্ট ডেকেছিলেন। তার সঙ্গে দেখা করে এসে বিচারকরা সম্মিলিত কণ্ঠে জানালেন, তারা এই বিচারপতির উপস্থিতিতে কোনো ধরনের আইনি কার্যক্রমে অংশ নেবেন না। সব বিচারক প্রধান বিচারপতির প্রতি 'অনাস্থা' প্রকাশ করেন। কিন্তু তাদের যুক্তি কী ছিল? এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

এই ঘটনায় বোঝা যায় যে, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারকের চাকরিও চলে যায়। এক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ বিচারকদের কেউই সামান্য ক্ষোভও প্রকাশ করেননি। এই ঘটনা ভবিষ্যতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পাওয়ার সম্ভাবনাকেও ধূলিসাৎ করে দেয়। কিন্তু এর জন্য বিচারকরা নিজেরাই দায়ী। সেই সময় একজন বিচারকও কি পারতেন না বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষায় পদত্যাগ করতে?

যখন বিচার বিভাগের কেউ কোনো ধরনের প্রতিবাদ না করেই নতজানু হলেন, তখন বাকি সব প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্টরাও আশা ছেড়ে দিলেন। একে একে সবগুলো প্রতিষ্ঠান ধসে পড়ল এবং অনেক ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই এই প্রক্রিয়ায় অংশ হয়েছি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই বিক্ষোভকে আমাদের দ্বিতীয় 'স্বাধীনতা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যা একেবারেই যথার্থ। এখন আমাদের সামনে আছে মৌলিক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের সম্ভাবনা, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

শিক্ষার্থীদের গণআন্দোলন সব ধরনের শোষণমূলক কাঠামো ভেঙে দিয়েছে। আমাদের সবাইকে নতুন করে স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। বাতাসে স্বাধীনতার সুবাতাস বইছে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরে এসেছে। শিক্ষার্থীরা আমাদের কখনো হাল না ছাড়তে শিখিয়েছে। শিক্ষার্থীরা সব প্রতিবন্ধকতাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সব বন্ধ দরজা খুলে দিয়েছে। দেশজুড়ে বইছে পরিবর্তনের নতুন হাওয়া। নতুন আশা, নতুন প্রত্যাশা ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নতুন সম্ভাবনা আসছে আমাদের সামনে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করা, স্বৈরাচারের পতন ঘটানো ও সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফেরানোর ক্ষেত্রে আমাদের যেমন খ্যাতি রয়েছে, তেমনি যেসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য সেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়েছি, সেগুলো অর্জনে আমাদের ব্যর্থতার দুঃখজনক রেকর্ডও রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল গঠনের মতো মারাত্মক ভুল করলেন এবং তাকে নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করা হলো, এর মাধ্যমে আমরা একবার সোনার বাংলা গড়ার সুযোগ হারালাম। এ ঘটনার সূত্রেই শাসক হিসেবে সামরিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে।

দ্বিতীয়বারের মতো আমরা সুযোগটি হারাই যখন জেনারেল এরশাদের পতন হয় এবং একটি নির্বাচিত ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা পায়। এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাতের জন্য যেসব রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েছিল, তাদের কাছে একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় এলো, সেই পরিকল্পনাটিকে অবজ্ঞা করা হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগও একই কাজ করে। যার ফলে একতা, উন্নয়ন ও শান্তির রাজনীতির বদলে আমরা 'বেগমদের যুদ্ধে' (দ্য ইকোনমিস্ট) অবতীর্ণ হই।

এখন আমরা তৃতীয়বারের মতো সুযোগ পেলাম। সাধারণত কোনো দেশ এতটা সৌভাগ্যবান হয় না। আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আমরা কীভাবে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করব। সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো জাতিকে একতাবদ্ধ করে তোলা। জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে দলীয় স্বার্থ সিদ্ধি এবং দলের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নেতার স্বার্থ সিদ্ধির ধ্বংসাত্মক সংস্কৃতিকে কোনোভাবেই ফিরতে দেওয়া যাবে না। এই সংস্কৃতি আমাদের চরম ভোগান্তির কারণ হয়েছে বারবার।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments