রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ৫ দিন ট্রেন আটকে রাখা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়

এতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের এবং চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে ময়মনসিংহসহ পুরো উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল।
পাঘাচং রেলস্টেশন। ছবি: স্টার

রাজধানী ঢাকা কিংবা বিভাগীয় শহরগুলো ছাড়া পূর্ববঙ্গের শহর-গঞ্জে ভাষা আন্দোলনের চাবিকাঠি ছিল মূলত স্কুল শিক্ষার্থীদের হাতে। রেলপথ অবরোধ, ধর্মঘট ও মিছিলের মাধ্যমে আন্দোলনে যোগ দেয় শিক্ষার্থীরা।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার খবরটি সেদিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছায়। এরপর ৫ দিন এ জেলার ওপর দিয়ে যাওয়া ট্রেন আটকে রাখেন শিক্ষার্থীরা। ভাষা আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সবচেয়ে আলোড়ন তোলা ঘটনা ছিল এটি।

সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অদূরে সদর উপজেলার পাঘাচং রেলস্টেশনে রেললাইন উপড়ে তৎকালীন বাহাদুরাবাদ মেইল ট্রেন আটকে রাখে একদল ছাত্র। এতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের এবং চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে ময়মনসিংহসহ পুরো উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল।

সেদিনের আন্দোলনের একজন সৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার চাঁন্দপুর গ্রামের নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া। এখনো বেঁচে আছেন এই ভাষাসৈনিক। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা।

এলাকায় 'নাসির স্যার' নামে পরিচিত নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের নিয়াজ মুহাম্মদ হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন ১৯৫২ সালে। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে সেদিনের ভাষা আন্দোলনের কথা বলেছেন তিনি।

নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, '১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছয় কিলোমিটার দুরের গ্রামের বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার পর খবর পেলাম ঢাকায় ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমার সহপাঠী আব্দুল কুদ্দুস মাখন (পরবর্তীতে ডাকসুর জিএস ও সংসদ সদস্য) জানালো, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন করায় বহু ছাত্রকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।'

'তখন আমরা কেন বসে থাকব, ভেবে আমরাও "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" শ্লোগান দিয়ে নেমে পড়লাম। মুহূর্তে সব ক্লাস থেকে ছাত্ররা বেরিয়ে যুক্ত হলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে। আমরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেন আটকানোর,' বলেন তিনি।

নাসির স্যার বলেন, 'সিদ্ধান্ত হলো ৩টা দলে ভাগ হয়ে আমরা রেলপথ অবরোধ করব। একটা দল থাকবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার ভাদুঘরে, আরেক গ্রুপ সদর উপজেলার কোড্ডা এলাকায় এবং আরেকটা আখাউড়াতে।'

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পরদিন বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে জানান তিনি। পরিকল্পনা করা হয় স্টেশনে ট্রেন আটকানোর।

ভাষাসৈনিক নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া। ছবি: স্টার

তিনি বলেন, 'কিন্তু পুলিশ-ইপিআরের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কিংবা আখাউড়ায় ট্রেন আটকানো সম্ভব হবে না ভেবে আমাদের অঞ্চলের ছেলেরা তৎকালীন ছাত্রনেতা আলী আজম ভূঁইয়া, লুৎফুল হাই সাচ্চু (পরবর্তীতে সংসদ সদস্য), সিরাজুল হক বাচ্চু (বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হুদা ভূঁঞার সঙ্গে পরামর্শ করে গ্রামে চলে আসি।'

সেদিন নিজ এলাকায় রেলপথ অবরোধের স্মৃতি রোমন্থন করে এই ভাষাসৈনিক বলেন, 'আমাদের গ্রামের পাশে পাঘাচং রেলস্টেশন। বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট এবং চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে ময়মনসিংহসহ উত্তরবঙ্গের রেলপথ। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল নয়টায় আমরা বেশ কয়েকজন কিশোর-তরুণ পাঘাচং স্টেশনে গিয়ে উত্তরবঙ্গগামী
বাহাদুরাবাদ মেইল ট্রেন আটকে দেই।'

'তবে স্টেশনে আটকে পড়া যাত্রীদের বেশিরভাগকেই ট্রেন এপার-ওপার করে পাঠিয়ে দেই। আর যারা ছিলেন তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করি। দেশের প্রধান রেলপথে যোগাযোগ বন্ধ থাকায় দেশজুড়ে নাড়া পড়ে তখন। রেললাইন অবরোধের সময় বিভিন্ন গ্রামের মানুষ আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ঘটনার পাঁচ দিন পর ২৭ ফেব্রুয়ারি ট্রেন ছাড়া হয়,' বলেন তিনি।

নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল নিয়াজ মুহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের সামনেই বিশালাকার মাঠ। মাঠের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ ভবন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিল বের হতো এই কলেজ থেকে। এই মিছিলের জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কেল্লা চাই'।

এমন স্লোগানের যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, 'বায়ান্নের ২১ ফেব্রুয়ারির হরতাল কর্মসূচি বানচাল করতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নুরুল আমীন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। এই নুরুল আমীন ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামের বাসিন্দা। ফলে এটা মেনে নিতে পারেনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ। তাই তার ওপর ক্ষোভ ছিল সবচেয়ে বেশি।'

নাসির উদ্দিন আরও বলেন, 'বায়ান্নর আগে ১৯৪৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেক সূর্য‌সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি তোলেন। সেটা আমরা জানতাম। এজন্য আমাদের ভেতর ভাষা আন্দোলন নিয়ে একটা অহংবোধ কাজ করত।'

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'যেহেতু ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ, সেহেতু নিয়াজ মুহাম্মদ স্কুলের মাঠ থেকে মিছিল বের হতো। ঢাকায় ছাত্রদের বুকে গুলি চালানোর খবর পাওয়ার পর যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে মিছিল বের করা হয়, তখন পুলিশ-মিলিটারি এসে মিছিলের শেষ পর্যায়ে কিছু ছাত্রকে ধরে ফেলে। এরপর আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি।'

Comments