খুলনা: অনেক হারানো এক ‘মায়ানগরের’ ১৪৩ বছর

সাতচল্লিশের দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের খুলনায় আসা বাংলা সাহিত্যের অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক লিখেছিলেন, 'এ দেশে চলে এলাম। তখন আমার বয়স ১৬ কি ১৭। এ দেশে আসার পর যেন জন্মান্তর ঘটে গেল আমার। সবুজ-শ্যামল মায়ায় ঘেরা দেশ। প্রথম যৌবনেই এক নদীবহুল, জমাট বাঁধা সবুজ রঙের হিরের মতো দেশে এলাম খুলনা শহরে। আমরা থাকতাম ভৈরব নদীর পারে।'
ভৈরব-রূপসার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম নগর খুলনা 'শিল্পশহরের' মর্যাদা হারিয়েছে অনেক আগেই। শহরের বুকে জালের মতো ছড়িয়ে থাকার খালগুলোর বেশিরভাগ এখন মৃত কিংবা মৃতপ্রায়। শহরের 'জমাট বাঁধা সবুজ' রঙও ফিকে হয়েছে অনেকটা। আছে নাগরিক সুবিধার অভাব।
কিন্তু এই 'আত্মঘাতী উন্নয়নের কালে' বাসযোগ্যতার প্রশ্নে এখনো এ শহরের প্রতিদ্বন্দ্বী বিরল। এখানে এখনো প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ আছে। আছে মাছের প্রাচুর্য। আছে মায়া।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গৌরবময় এ শহর খুলনার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ ২৫ এপ্রিল। ১৮৮২ সালের এই দিনে যশোর জেলার খুলনা ও বাগেরহাট এবং চব্বিশ পরগনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমা নিয়ে খুলনা জেলা সৃষ্টির নোটিশ জারি হয়।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হিসেবে গড়ে ওঠা এই জনপদের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ, বহুস্তরবিশিষ্ট আর বর্ণিল।

খুলনার যে অঞ্চল একসময় সুন্দরবনের অংশ ছিল, সেখানে ধীরে ধীরে বসতি গড়ে ওঠে বনভূমি কেটে। সেই বসতির বিস্তারে বড় ভূমিকা ছিল সুফি সাধক হজরত খানজাহান আলীর। তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই এলাকাটিতে বসতির বিস্তার ঘটে। অবশ্য, তার সময়ে বিকশিত এলাকাটি বাগেরহাট ও এর আশপাশের এলাকা ছিল। ওই সময়ে এলাকাটির নাম ছিল খলিফাতাবাদ।
ইংরেজ আমলে খুলনা প্রশাসনিকভাবে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। কীভাবে খুলনা জেলার সৃষ্টি হলো—সে সম্পর্কে লিখেছেন স্থানীয় সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী। তিনি লিখেছেন, 'এক সময় খুলনার এই জনপদ ছিল যশোর জেলার অধীন। ১৮৪২ সালে যশোর জেলার প্রথম মহাকুমা সৃষ্টি হয় খুলনা নামে, যা ছিল বাংলার প্রথম মহকুমাও। ওই মহাকুমার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পরবর্তীতে তিনি খুলনার এসডিও হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। গড়ে তোলেন ভৈরবের পূর্বপাড়ে তার অফিস তথা বাংলো। যা আজও জেলা প্রশাসকের বাংলো।'
১৮৬৩ সালে বাগেরহাট মহকুমার সৃষ্টি। আর এর দুই বছর আগে ১৮৬১ সালে সাতক্ষীরা মহকুমার সৃষ্টি। যা ছিল বর্তমান ভারতের ২৪ পরগণা জেলার আওতাভুক্ত।
১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিল খুলনা জেলার সৃষ্টির নোটিশ জারি হলেও এর কাজ শুরু হয় ১ জুন। জেলা সদর হয় খুলনা। তখন অবশ্য খুলনা শহরের পূর্ব দিকে মধুমতি নদীর ওপারেও খুলনা জেলার বিস্তৃতি ছিল।
তখন খুলনা জনসংখ্যা ছিল ৪৩ হাজার ৫০০ জন। আয়তন ছিল ৪ হাজার ৬৩০ বর্গমাইল। এখানকার প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ব্রিটিশ কর্মকর্তা ডাব্লিউ এম ক্লে।
জেলা প্রতিষ্ঠা দুই বছর পর ১৮৮৪ সালে গঠিত হয় খুলনা পৌরসভা; যা একশ বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালে সিটি করপোরেশনে (কেসিসি) উন্নীত হয়।

এই পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন রেফারেন্ড গাগন চন্দ্র দত্ত।
১৯১৩ সালে মধুমতি নদীকে সীমানা বিভাজনকারী নদী হিসেবে চিহ্নিত করে খুলনা জেলার এলাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
খুলনার নামকরণের পেছনে প্রচলিত আছে নানা মত।
কথিত আছে, ধনপতি সওদাগরের দ্বিতীয় স্ত্রী 'খুলনার' নামে নির্মিত খুলনেশ্বরী মন্দির থেকেই নামটি এসেছে। কেউ কেউ বলেন, 'কিসমত খুলনা' নামক মৌজা থেকে এসেছে খুলনা নাম।
আবার কেউ বলেন, ১৭৬৬ সালে 'ফলমাউথ' জাহাজের নাবিকদের উদ্ধার নিয়ে করা এক রেকর্ডে 'Culnea' শব্দটি উল্লেখ ছিল—সেটির উচ্চারণ বদলে হয়ে যায় খুলনা। ব্রিটিশ আমলের ম্যাপেও 'Jessore-Culna' লেখা ছিল।
একসময় খুলনা ছিল ভৈরব-রূপসার তীরঘেঁষা লম্বাকৃতির ছোট এক শহর। অনেক পুরোনোর সঙ্গে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর নানা ধরনের ভবনসহ সেই শহর এখন আয়তনে অনেকটা বিস্তৃত।
খালিশপুর, দৌলতপুর, মহেশ্বরপাশা—এই এলাকাগুলোতে একসময় গড়ে উঠেছিল পাটকল, কাগজকল, হার্ডবোর্ড মিল। পরিকল্পিত এই শিল্পনগরী লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিল। সুন্দরবনের গাওয়া কাঠের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল।

খুলনা নগরের বিভিন্ন জায়গার নাম শুনলেই বোঝা যায় এক সময় এখানে সুন্দরবন ছিল। প্রাণীর নামে নামকরণ করা বাগমারা, হরিণ টানা, লবণ চরা, বানরগাতী নামগুলো এ সাক্ষ্য দেয়।
শহরের পুরাতন ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা 'ময়লাপোতা মোড়'। শহরের উঁচু ভবনগুলোর বেশিরভাগই এ এলাকায়। শহরটির সীমানা এখন রূপসা, গল্লামারী, শের-এ-বাংলা রোড পেরিয়ে আরও অনেক দূরে ছড়িয়ে গেছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন খুলনা শহর ছিল পাকবাহিনীর দখলে। গল্লামারী, সার্কিট হাউস, রেডিও সেন্টারের মতো পরিণত হয়েছিল ভয়ংকর নির্যাতনকেন্দ্রে। ময়লাপোতা থেকে রেডিও সেন্টার পর্যন্ত দীর্ঘ সড়ক ধরেই নির্যাতিত মানুষদের নিয়ে যাওয়া হতো হত্যা করতে।
গল্লামারী গণকবর, সার্কিট হাউসের ফলক, রেডিও সেন্টারের দালান এখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ।
ভৈরবের তীরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে নির্মিত জেটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা চার, পাঁচ ও ছয় নম্বর ঘাট এলাকা এখন বাণিজ্যিক কার্যক্রমের পাশাপাশি বেড়ানোর জন্য নগরবাসীর কাছে জনপ্রিয় গন্তব্য। শিল্প ও বন্দর নগর হিসেবে খুলনার পরিচিতি তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে এ ঘাটগুলোর ভূমিকা আছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে যখন রাজধানীকেন্দ্রিক উন্নয়ন দৌড়ে একের পর এক অঞ্চল ঢেলে সাজানো হয়েছে, খুলনা সেই গতিতে এগোতে পারেনি। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও এ অঞ্চল ছিল দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও পুঁজির মূল স্রোতের বাইরে।
গত শতকের ষাটের দশকে আইয়ুব খানের তথাকথিত 'উন্নয়ন দশক'-এ খুলনা-মংলা রেলপথ নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ হলেও প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। বহু দশক পর, অবশেষে এখন সেই রেলপথ বাস্তবে রূপ পেয়েছে। এখন দিনে একটি মাত্র ট্রেন চলে এই পথে। অথচ এর মাঝখানে বদলে গেছে দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা। হারিয়ে গেছে খুলনার অনেক শিল্প সম্ভাবনা।
পাটশিল্প ছিল খুলনার এক সময়কার প্রাণ। খালিশপুর, দৌলতপুর, প্লাটিনাম জুট মিল—এইসব নাম এক সময় গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হতো। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের চাহিদা কমে যাওয়া, আর্থিক সংস্থাগুলোর কড়াকড়ি শর্ত ও বেসরকারিকরণের জোয়ারে একে একে বন্ধ হয়ে যায় সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন এসব পাটকল। বন্ধ হয়ে গেছে নিউজপ্রিন্ট মিল, হার্ডবোর্ড মিল, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি। পুঁজি আসে, কিন্তু টেকে না। শ্রমিকের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে আসে, জেগে থাকে শুধু দীর্ঘশ্বাস।

তবুও সময়ের বদলে খুলনা এখন আবার সম্ভাবনার কথা বলছে।
বিগত এক দশকে খুলনায় আবাসন খাতে উল্লেখযোগ্য পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে। গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, উন্নয়ন হচ্ছে নগর অবকাঠামোর। পদ্মা সেতু খুলনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সংযোগকে দৃঢ় করেছে।
রাষ্ট্র এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় মনোযোগী হয়েছে। আন্তঃদেশীয় ও আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্যপথ নির্মাণের মহাপরিকল্পনা এই অঞ্চলকেই কেন্দ্র করে এগোচ্ছে। জ্বালানি ও যোগাযোগ—এই দুই খাতের উন্নয়নে নতুন নতুন প্রকল্পের ছোঁয়া লাগছে খুলনায়।
এই শহরকে ঘিরে সম্ভাবনার যে নদী একসময় কেবল নিঃশব্দে বয়ে চলত, আজ তার বুকে ভবিষ্যতের তরঙ্গ। যে খাল এক সময় রূপচাঁদ সাহা নিজের উদ্যোগে কাটিয়ে দিয়েছিলেন—ভৈরব আর কাজীবাছাকে যুক্ত করে—সেই খাল এখন রূপসা নদী। তার উপর অনেক আগেই গড়ে উঠেছে সেতু, যা ইতিহাস আর উন্নয়নের মেলবন্ধন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, যদি পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের পথে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক দক্ষতা থাকে, তবে অদূর ভবিষ্যতে খুলনা শুধু দেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে পরিণত হওয়াটাও অসম্ভব নয়।
Comments