আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র মেধাবানদের টেনে নিয়েছে

বিশ্ববিদ্যালয়ের যা অর্জন তা কেবল যে শিক্ষকদের কারণেই ঘটে এমন নয়; ছাত্রদের কাজটাও এখানে খুবই জরুরী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা যেমন ছাত্রদেরকে গড়ে তুলেছেন, ছাত্ররাও তেমনি শিক্ষকদেরকে শিক্ষাগ্রহণের মধ্য দিয়ে উদ্দীপ্ত করেছে, এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যে চরিতার্থতা তার বোধটাও শিক্ষকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে যখন সঙ্কটাদি দেখা দিয়েছে তখন ছাত্ররাই প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ছাত্রদের এই যে সংবেদনশীলতা ও অধিকার-চেতনা ছিল একটি চালিকাশক্তি।

শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। বহু আগে শ্রেণিকক্ষ থেকে অবসর নিলেও বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃত উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র করে তোলার জন্য তার ভাবনা ও কর্মে কখনো ছেদ পড়েনি। একাধিকবার উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। মনোযোগী হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি প্রকৃত জ্ঞান উৎপাদন ও চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য।

সমাজ-রূপান্তর অধ্যায়ন কেন্দ্রের উদ্যোগে গত ৭ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে অধ্যাপক আহমদ কবির প্রথম স্মারক বক্তৃতা দেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বক্তৃতার বিষয় ছিল 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ: বিচারের দুই নিরিখে'।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এই স্মারক বক্তৃতার কথাগুলো ৭ পর্বে প্রকাশিত হচ্ছে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায়। আজ প্রকাশিত হলো ষষ্ঠ পর্ব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যা অর্জন তা কেবল যে শিক্ষকদের কারণেই ঘটে এমন নয়; ছাত্রদের কাজটাও এখানে খুবই জরুরী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা যেমন ছাত্রদেরকে গড়ে তুলেছেন, ছাত্ররাও তেমনি শিক্ষকদেরকে শিক্ষাগ্রহণের মধ্য দিয়ে উদ্দীপ্ত করেছে, এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যে চরিতার্থতা তার বোধটাও শিক্ষকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে যখন সঙ্কটাদি দেখা দিয়েছে তখন ছাত্ররাই প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ছাত্রদের এই যে সংবেদনশীলতা ও অধিকার-চেতনা ছিল একটি চালিকাশক্তি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতিতে কর্মচারীদের ভূমিকাটি ভুলবার নয়। শিক্ষকদের মতোই কর্মচারীদেরও অনেকে তাঁদের কর্মজীবনের অধিকাংশটাই এখানেই কাটিয়েছেন এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মেরও অনেকে এখানে নানা স্তরের কাজে নিয়োগ পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক জীবনে শিক্ষক ও ছাত্রদের সঙ্গে কর্মচারীদেরও একটি বিশেষ ধরনের ভূমিকা ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সমাবর্তনও একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সমাবর্তন নিয়মিত হয় নি। ১৯৪৭-এ হয় নি; ১৯৪৭ থেকে পরবর্তী ২৩ বছরে সমাবর্তন হয়েছে মোট ১৫টি; বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংখ্যা আরও কমে গেছে, ৫০ বছরে সমাবর্তন হয়েছে মাত্র ১৩টি। না-হবার কারণটা রাজনৈতিক।

শিক্ষকদের মানের ওপর শিক্ষার মানের নির্ভরশীলতার ব্যাপারে তো কোনো সংশয়ই নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধাবানদেরকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে এসেছে, যে জন্য এখানে জ্ঞানের চর্চা ও অগ্রগমন এক সময়ে উল্লেখযোগ্য ছিল। কিন্তু পাকিস্তান আমলে পরিবর্তন দেখা গেছে; প্রথম দিকেই একটা শূন্যতা তৈরী হয়েছিল, পরে অবশ্য সেটা থাকেনি; তবে দেখা গেছে যে শিক্ষকদের একটা অংশ রাষ্ট্রীয় কাজে চলে গেছেন। কেউ গেছেন সাময়িক ভাবে, অনেকেই চলে গেছেন স্থায়ীভাবে। এর কারণ রাষ্ট্রীয় কাজে সুযোগসুবিধার প্রতিশ্রুতি। রাষ্ট্র ছিল আমলাতান্ত্রিক; আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র মেধাবানদের টেনে নিয়েছে, তাতে রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থার সুবিধা হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও দেখা গেছে মেধাবানদের অনেকেই রাষ্ট্রীয় নিয়োগকেই পছন্দ করেছেন; বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে পারতেন এমন বহু মেধাবী বিদেশে চলে গেছেন, নবীন শিক্ষকদের কেউ কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে আর ফেরত আসেননি। এই ঘটনাকে মেধাপাচার বলাটা অন্যায্য হবে না। মেধাপাচারও আসলে পুঁজিবাদেরই অনুষঙ্গ। কিন্তু এর দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, দায়িত্ব রাষ্ট্রের ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার।

অভিযোগ রয়েছে যে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান উঁচুতে নয়। র‌্যাঙ্কিং-এর মূল্যায়ন যেভাবে হয় তাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়-দায়িত্ব পালনের দিকটা বিবেচনায় আসে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওই দায়-দায়িত্ব নিয়মিত পালন করেছে এবং পালন করতে গিয়ে যে পরিমাণ বৈরিতার মুখোমুখি হয়েছে তা তুলনাবিহীন। জ্ঞানের চর্চার সঙ্গে সঙ্গে তার ছিল টিকে থাকবার সংগ্রামও, গরীব ঘরের মেধাবান বিদ্যোৎসাহী ছাত্রটির মতোই। জ্ঞানের আহরণ, সৃষ্টি ও বিতরণের ক্ষেত্রে কাজ করার পাশাপাশি ও কাজের ভেতর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়িত্ব নিতে হয়েছে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবারও। এবং উভয় ক্ষেত্রেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্যপালন অত্যন্ত উঁচু মানের। বলাই বাহুল্য যে কথিত একাডেমিক র‌্যাঙ্কিং-এর মাপকাঠিতে এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবদানটা ধরা পড়বার কথা নয়; ধরা পড়েও না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পেছনে ঘোষিত আকাঙ্ক্ষাটা ছিল পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু দারিদ্র্যর কারণে মুসলমান পরিবার থেকে শিক্ষার্থীরা তেমন আসতে পারেনি। শুরুতে তারা ছিল শতকরা বিশ জনেরও কম। সুবিধা তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদেরই বেশী হয়েছে। তবে ওই সম্প্রদায়েও কৃষক ছিল, দরিদ্র মানুষও ছিল; বিশ্ববিদ্যালয়ে আসাটা তাদের জন্যও  মোটেই সহজ ছিল না। হিন্দু সমাজে আরেকটা সমস্যা ছিল; সেটি বর্ণবিভাজনের। উচ্চবর্ণের লোকেরা নিম্নবর্ণের মানুষকে দূরে রাখতে চাইতো, ক্ষেত্রবিশেষে এমনকি স্পর্শযোগ্যও বিবেচনা করতো না। উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের শিক্ষার্থীরা এক সঙ্গে একই ছাত্রাবাসে থাকবে, শুধু থাকবে নয়, একই রান্নায় এক সঙ্গে বসে আহারও করবে, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অকল্পনীয় ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু সেটাই ঘটিয়েছে, ছাত্রাবাসে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ, ছুৎ-অচ্ছুৎ সবাইকে একত্রে রেখেছে, এবং একসঙ্গে একই পাচকের রান্না খাদ্য গ্রহণ সম্ভব করে দিয়েছে। উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণীর ব্যবধান মুসলমান সমাজেও ছিল, সেখানেও আশরাফরা আতরাফদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে চাইতো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রাবাসে সেই ব্যবধান ভেঙে গিয়েছিল।

খুব বড় রকমের উপকার হতো হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় যদি একসঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের যে শত্রুতা তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এগুতে পারতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে পরিবেশটা সেই সহযোগিতারই ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা পুরোপুরি টিকে থাকতে পারে নি। সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও রাষ্ট্রীয় বৈরিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমষ্টিগত অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছে। ১৯৩৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক এ এফ রহমান; তিনিই প্রথম মুসলিম উপাচার্য। এ এফ রহমান স্যার উপাধি পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর প্রথম সমাবর্তন বক্তৃতায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কমানোর কথা বলেছিলেন, এবং এই লক্ষ্যে যা প্রয়োজন তাকে এভাবে চিহ্নিত করেছিলেন : 'a sympathetic appreciation of the contribution of the two great communities to her (India's) culture and history.' (Dhaka University Convocation Speeches, vol II, p 305)

ওদিকে ১৯৩৬-এর বক্তৃতায় তিনি আবার ছাত্রদেরকে সতর্ক করেছেন তারা যেন বিভিন্ন 'রংস'-এর পাল্লায় না পড়ে। তাঁর ভাষায়, 'Terms and phrases like "Capital", "Labour", "Socialism", "Communalism" produce the armaments of Political conflict.' (H, vol. II, p 294)

এই ধরনের মনোভাব অবশ্য ছাত্রদের ভেতর থাকবার কথা নয়। আর সে জন্যই হয়তো কথাটা বলা। সমস্যাটা ছিল Communalism নিয়েই, Labour বা Socialism নিয়ে নয়। সাম্প্রদায়িকতা ততোদিনে প্রবল হয়ে উঠেছে, এবং সেটা যে দেশের মানুষকে কোন পরিণতিতে নিয়ে যাবে রাজনৈতিক নেতারা তা বুঝতে পারেন নি; বুদ্ধিজীবীরাও গুরুত্ব দিয়ে ভাবেন নি। সমঝোতার কথা অনেকে ভেবেছেন; যেমন উপাচার্য এ এফ রহমানও ভেবেছেন; কিন্তু সমঝোতা নয়, সংস্কারও নয়, প্রয়োজন ছিল যে মৌলিক পরিবর্তনের সেটা কেউ কেউ নিশ্চয়ই বুঝতেন; কিন্তু তা নিয়ে আলোচনা তেমন হতো না। আলোচনা হলে Capital I Labour  যে এক নয়, এবং Socialism I Communalism যে এক সঙ্গে যায় না, তা পরিষ্কারভাবে জানানো সহজ হতো।

Comments