নূর হোসেনের দেশে আমাদের গণতান্ত্রিক মন

শহীদ নূর হোসেন। যার বুকে ও পিঠে লেখা ছিল, ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’ শামসুর রাহমান তাকে নিয়ে লিখেছিলেন অমর কবিতা, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়।’ নূর হোসেন কেবল একটা নাম নয়। কেবল একটা পোস্টার নয়, বাঙালির গণতান্ত্রিক মন, মনন ও বোধের প্রতীক। নূর হোসেনই বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে গণতন্ত্রকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক বাংলাদেশ। নূর হোসেন হচ্ছে সেই বাংলাদেশের সকল মানুষের গণতান্ত্রিক আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ও প্রতিভূ।

শহীদ নূর হোসেন। যার বুকে ও পিঠে লেখা ছিল, 'স্বৈরাচার নীপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।' শামসুর রাহমান তাকে নিয়ে লিখেছিলেন অমর কবিতা, 'বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়।' নূর হোসেন কেবল একটা নাম নয়। কেবল একটা পোস্টার নয়, বাঙালির গণতান্ত্রিক মন, মনন ও বোধের প্রতীক। নূর হোসেনই বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে গণতন্ত্রকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক বাংলাদেশ। নূর হোসেন হচ্ছে সেই বাংলাদেশের সকল মানুষের গণতান্ত্রিক আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ও প্রতিভূ।

যদিও যে গণতন্ত্রের জন্য নূর হোসেন শহীদ হয়েছেন সেই গণতন্ত্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশে এখনও দেখা পায়নি নূর হোসেনের আকাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের। এর দায় কার? এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত একটাই। দায়টা বড়দের। সমাজ ও রাষ্ট্রের বড় বাড় জায়গায় যারা রয়েছেন, তারা নিজেদের দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করতে পারেননি বলেই প্রত্যাশিত গণতন্ত্র আজও রয়ে গেছে অধরা। অথচ বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিকবোধে রয়েছে গণতন্ত্রের উপস্থিতি, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সে গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারিনি। 

প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এখানে প্রবল। অথচ গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় প্রাতিষ্ঠানিকতার কোনো বিকল্প নেই। প্রশ্ন হল, যে জাতির সর্বজনীন মন গণতন্ত্রের প্রতি নিবেদিত ও আকাঙ্ক্ষিত সেই জাতির গণতন্ত্র কেন বাধাগ্রস্ত। এর জন্য কেবলই কি রাজনীতিবিদরা দায়ী। নাকি তার কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অধ্যাপক, আইনজীবীসহ সকল পেশাজীবীরা দায়ী। বিশেষ করে তারা, যারা উপরতলায় এবং উঁচুপদে রয়েছেন। উনারা নূর হোসেনের গণতান্ত্রিক মন ও দেশপ্রেমের প্রতি কতোটা দায়বদ্ধ সেই প্রশ্ন উচ্চারণও হয় না। এমনকি নূর হোসেন দিবসেও না। এবারের নূর হোসেন দিবসেও যার ব্যত্যয় ঘটেনি। 'নূর হোসেন ও আমাদের গণতান্ত্রিক মন' এসব প্রশ্নের উত্তরা খোঁজার নিমিত্তেই লেখা

বাঙালির বিশেষত বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের আম মানুষের মধ্যে একটা গণতান্ত্রিক মন আছে বলেই এদের মধ্যে থেকে আবির্ভূত হয়েছিল একজন নূর হোসেন। একটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে গণতান্ত্রিক আশা আকাঙ্ক্ষা কতোটা তীব্রভাবে থাকলে এরকম একটা পোস্টার-পুরো জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরূপে হাজির হয়, তা সহজেই অনুমেয়। বেদনার হল, পুরো জাতি গোষ্ঠিকে যারা পরিচালনা করে, নেতৃত্ব দেয় তাদের গণতান্ত্রিক মন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আদৌ কি তাদের গণতান্ত্রিক মন রয়েছে? গণতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাত, ভাললাগা, ভালবাসা কি রয়েছে? গণতন্ত্রের প্রতি দুর্বলতার কোনো প্রকাশ কি খুঁজে পাওয়া গেছে তাদের জ্ঞানকাণ্ড ও কর্ম পরিচালন প্রক্রিয়ায়। এই প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না-এ সীমাবদ্ধ নেই। এমনকি বিশদে বললেও প্রাপ্ত উত্তরে স্বস্তি ও সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই।

বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের পক্ষে পূর্ববঙ্গের মানুষের মাঝে যে জনজোয়ার সৃষ্টি হল তার পেছনে শক্তিশালী কারণও ছিল। কারণ ততদিনে এই অঞ্চলের গুটিকয়েক মানুষ ব্যতীত প্রায় সকলেই বাংলা ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছিল। ভাষা ও সাহিত্যের শক্তির দিকটা উন্মোচিত হয়ে গেছে। এই ভাষা যে হঠাৎ আবির্ভূত নয়। এমনকি খেলো ও উপেক্ষণীয় নয় তার অতীত ঐতিহ্য সেটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে। যদি মনে করা হয় বাংলা ভাষার গৌরবের অতীত একটাই এই ভাষার একজন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাও আবার 'গীতাঞ্জলী' কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য। ব্যস এইটুকু পর্যন্তই দৌড় বাংলার। ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তি তো এই ভাষার বড় অর্জন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সবার আগে মনে রাখতে হবে, এই ভাষা হাজার বছরের পুরনো। বিংশ শতকের শুরুতেই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ দরবার থেকে আবিষ্কার করেন বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন। চর্যাপদের আবিষ্কারে বাংলা ভাষার ইতিহাস যে হাজার বছরের পুরনো সেটা প্রমাণিত হয়ে যায়। যদিও আমরা জানি, গৌতম বুদ্ধ অর্থাৎ রাজকুমার সিদ্ধার্থ শৈশবে 'বঙ্গলিপি' পাঠ করেছিলেন। যে ভাষার লিপি এতপুরনো সেই ভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্যও নিশ্চয় সেই রকম পুরনো ও ঐশ্বরযশালী হবে। অবশ্য, এই পর্ব এখনও গবেষণার আলোয় উন্মীলিত হয়নি। কিন্তু চর্যাপদের আবিষ্কৃত হয়েছে। চর্যাপদের কবি ভুসুকু জোর গলায় উচ্চারণ করেছেন, 'আজি ভুসুকু বঙ্গালি ভইলি'। সেই ভাষাকে যে কেউ চাইলেই পদদলিত করতে পারে, টুটি চেপে ধরতে পারে, তা কি কখনো হওয়ার? নিশ্চয় হওয়ার নয়। এ কারণেই সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে।

আমাদের বিশেষভাবে স্মরণে রাখতে হবে যে, এই ভাষায় মধ্য যুগে লেখা হয়েছে অমূল্য সব সাহিত্য সম্পদ। চাঁদ সওদাগরের মতো চরিত্র এই ভাষাতেই সৃজিত হয়েছে। মধ্যযুগে এরকম একটা চরিত্রতো বাঙালির শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবার অতীত ইতিহাসের সত্যকেই হাজির করে। যে ভাষার সাহিত্যে একজন চাঁদ সওদাগর রয়েছে, সেই ভাষাতো ঠুনকো আঘাতে ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাওয়ার নয়। সেই ভাষা হাওয়ার ফুৎকারে উড়িয়ে যাওয়ারও নয়। চাঁদ সওদাগর আমাদের শিক্ষা দেয় উজানে কীভাবে তরী বাইতে হয়। প্রতিকূল সময়েও কীভাবে বজায় রাখতে হয় জাত্যাভিমান।  

কবি আবদুল হাকিম সপ্তদশ শতকেই লিখেছেন, 'যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী ।/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ।।/ দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়।/ নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায়'।।/ মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি। দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।' যে ভাষার কবি অষ্টাদশ শতকে লিখেছেন অমর সেই পংক্তি, 'নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা।'

এ সব রত্নরাজি যে ভাষায় সৃজিত হয়েছে সেই ভাষাকে বন্দুকের গুলিতে, রক্ত ঝরিয়ে দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এই ভাষায় ততদিনে ঘটে গেছে ঢাকার নবজাগরণ। পূর্ববঙ্গের কেন্দ্রভূমিতে স্থাপিত হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে শুরু হয়েছে ঢাকার রেনেসাঁ বা ঢাকার নবজাগরণ। তৈরি হয়েছে মুসলিম সাহিত্য সমাজের মতো সংগঠন। ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র ছিল 'শিখা'। যার শ্লোগান ছিল, 'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।'

যে জনপদ, যে জনগোষ্ঠী, যে সমাজ এরকমের চেতনায় শানিত ও ঋদ্ধ তাদেরকে যে পরাভূত ও পরাজিত করা সম্ভব নয় তা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুঝে উঠতে পারিনি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই সম্পদ ও ধারাবাহিক ইতিহাস সম্পর্কে তারা সম্ভবত ওয়াকিবহাল ছিল না। একারষেণ বায়ান্নোর একুশে এবং তার আগে ভাষার প্রশ্নে তারা যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা-তাদের সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত ও অভিসন্ধির অংশ হলেও পুরো বিষয়টা যে হঠকারি সিদ্ধান্ত ছিল তা পরবর্তীতে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ও তাদের বৌদ্ধিক পরামর্শকদের বাঙালি ও বাংলা ভাষার অতীত সম্পর্কে কোনো ধারনাই ছিল না। তারা না জানতো এই ভাষা ও সাহিত্যের গর্ব ও গৌরবের পরম্পরা। না জানতো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ সম্পর্কে। না জানতো মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল মনুসর আহমদ, সৈয়দ মুজতবা আলী সম্পর্কে। অর্থাৎ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির বর্তমান ও অতীত সম্পর্কে তাদের কোনো ধারনায় ছিল না। কল্পনা করাও সম্ভব হয়নি, বায়ান্নোর একুশের সেদিনের সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাঙালির জাতীয়তাবোধ জেগে উঠবে। এবং ভাষাভিত্তিক এই জাতীয়তাবোধই পরবর্তীতে জন্ম দেবে একটি স্বাধীন দেশের। বায়ান্নোর একুশের ঘটনায় রচিত হবে অমর পংক্তি, 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।' এক বছরের মধ্যেই প্রকাশিত হবে 'একুশের সংকলন'র মতো ঐতিহাসিক সংকলন। এসব তাদের কল্পনাতেও ছিল না, এমনকি গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও না।

বাঙালির মন ও মননে ভাষা ও সাহিত্যের জন্য পক্ষপাত ও সহজাত দুর্বলতা ছিল, থাকবে ভবিষ্যতেও। এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত কিংবা সংশয়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেননা বাঙালির জিনে এটা রয়েছে। তার অতীত সেসবের সাক্ষ্য দেয়। বিষয়টা পরিস্কারভাবে বোঝার জন্য নীরদচন্দ্র চৌধুরীর লেখা 'পুর্ববঙ্গের সমস্যা' প্রবন্ধটা পাঠ করা যেতে পারে। ১৯৬৬ সালে লিখিত ওই প্রবন্ধে কিছুটা আকারে-ইংগিতে এবং কোথাও কোথাও স্পষ্ট করেই বলা হয়েছিল, পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হবে। যুক্তি দিয়ে তিনি এই ভবিষ্যদ্বাণীর পক্ষে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। এবং মোটাদাগে তিনি যে বিষয়টা চিহ্নিত করেছেন তা বেশ চিত্তাকর্ষক ও কৌতূহলকর। তিনি বলছেন, ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে, এই জনপদ স্বাধীন থাকতে পছন্দ করে। তার অতীত ইতিহাস সেই সত্যেরই সাক্ষ্য দেয়।

এখানকার মাটি, প্রকৃতি, আবহাওয়া, জলের ধর্ম,সমাজের গড়ন, মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সবকিছুতেই তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের সাক্ষ্য দেয়। একারণে তার অতীতের হাজার বছরের ইতিহাসে কিংবা তারও আগে কখনই উত্তরাপথের সঙ্গে দীর্ঘদিন একত্রে থাকার কোনো নজির নেই। এমনকি যে সময়টুকু একত্রে ছিল সেই সময়েও তার স্বতান্ত্রিকতা বজায় রেখেছিল। পরিস্থিতির কারণে দিল্লীর বশ্যতা স্বীকার করলেও সে স্বশাসিত ছিল। ব্যক্তি মানুষের অনেককিছু কিংবা প্রায় পুরোটাই যেমন জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কিংবা জিনের ধারাবাহিকতায় পরিচালিত। ঠিক তেমনি জিনগত বৈশিষ্ট্যের বৈজ্ঞানিক এই সত্যকে যদি কোনো জনপদের ওপর প্রতিস্থাপন করা যায়, তাহলে আমরা দেখব এই জনপদের জিনগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই রয়েছে তার স্বাধীন ও সার্বভৈৗম সত্ত্বা। একই কথা প্রযোজ্য তার গণতান্তিক মনের ক্ষেত্রেও।

এই জনপদের মানুষের গণতন্ত্রের প্রতি রয়েছে অপার দুর্বলতা ও সহজাত পক্ষপাত। এবং সেটা তার হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের মধ্যেও গভীরভাবে নিহিত রয়েছে। বিষয়টা তাৎপর্যবাহীতো বটেই, উদাহরণ জাগানিয়াও। এই জনপদ ইতিহাসের কঠিনতম দুঃসময়ে তার গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছে।

শশাঙ্কের (৬০০-৬২৫খ্রি.) মৃত্যুর পর বঙ্গে বড়ো রকমের বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। সম্রাট হর্ষবর্ধনের (৬০৬-৬৪৬ খ্রি) মৃত্যুর পর তার রাজ্যেও দেখা দেয় নৈরাজ্য। একক ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাবে বিচ্ছিন্নভাবে আঞ্চলিক শক্তিসমূহ জেগে ওঠে। মন্ত্রীরাও বলপূর্বক বিভিন্ন জায়গার কতৃত্ব নেয়। ৬৫০ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের এক শতক ব্যাপী সময় কালে বঙ্গ-গৌড়ের ইতিহাস অস্পষ্ট। কারণ সমগ্র জনপদে মাৎস্যনায় দেখা দেয়। পুরো এলাকা খণ্ড খণ্ড অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বাইরের আক্রমণ বেড়ে যায়। এমনকি কাশ্মীর থেকেও বাংলায় উপরযুপরি আক্রমণ করা হয়। জনগণের দুঃখ ‍দুর্দশা বেড়ে যায় এবং অনিরাপদ হয়ে ওঠেন। এই অবস্থায় দেশ ও জনতাকে রক্ষা করেন। পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল। তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বিশৃঙ্খলা দূর করেন এবং মাৎস্যন্যায়ের অবসান ঘটানা।

গোপাল কীভাবে ক্ষমতায় আসেন তার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয় এ অঞ্চলের মানুষের গণতান্ত্রিক মনের জিনগত বৈশিষ্ট্য। সর্বজন সম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, জনগণ গোপালকে রাজা নির্বাচিত করেন। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতে, 'প্রকৃতপক্ষে সত্যকার বাঙালিত্ব প্রকট হইবার বহু আগেই রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য দেখা দিয়াছিল। যেদিন মাৎস্যন্যায় হইতে পরিত্রাণ পাইবার জন্য বাংলার লোক গোপালকে সিংহাসনে বসাইয়াছিল, সেই দিন হইতে বাংলার রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের আরম্ভ। তখনও বাংলা ভাষা জন্মায় নাই, বাংলার বিশিষ্ট সংস্কৃতিও বিকশিত হয় নাই। তবু বাংলা উত্তরাপথের সহিত যুক্ত থাকিতে পারে নাই। ইহার পর গুর্জন-প্রতীহার সম্রাটদের সহিত বাংলার রাজার যুদ্ধও হইয়াছে। পালবংশের অনুবর্তনকারী সেনদের কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। বাঙালি সমাজের বিশিষ্ট রূপের হিসাব তখন  হইতেই আমরা ধরি।'

আমরা মনে করি নূর হোসেন যে আমাদের গণতান্ত্রিক মনের পোস্টার হয়ে উঠল তার পেছনে রয়েছে আমাদের গণতন্ত্রপ্রেমের হাজার বছরের ঐতিহ্য। গোপালের যুগ যেমন বাঙালির গণতন্ত্রবোধের শেকড় ঘর, তেমনি তার সাম্প্রতিক অতীতও কম গৌরবের নয়। ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যূত্থান সাক্ষ্য দেয় বাঙালির গণতান্ত্রিক মনের উৎসর্গীকৃত সত্ত্বার কথা। আইয়ুবশাহীর মতো সামরিক স্বৈরশাহীর পতনতো ঘটিয়েছিল এই বাঙালিই। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য করেছিল বাঙালি তার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই। 

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয়েছে গণতান্ত্রিক পথে। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম নজির দ্বিতীয়টি নেই যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একটা জাতি তার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করেছে। বাঙালি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য গণ অভ্যুত্থান করেছে। এবং সেই গণঅভ্যুত্থানের ফসল অবাধ-সুষ্ঠু-উৎসবমুখর-নিরপেক্ষ নির্বাচন। যে নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে ভোটের লড়াইয়ে তারা নিশ্চিত করেছে পাকিস্তানে তাদের নির্বাচিত নেতা ও রাজনৈতিক দলই শাসন ক্ষমতা পরিচালনার দাবিদার। গণতান্ত্রিক এই দাবি পুরণ না করে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালির ওপর অসম অন্যায় এক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। যা বাঙালি তথা পূর্ব বঙ্গের মানুষের কাছে পরিগণিত হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তির যুদ্ধ হিসেবে। এই সংগ্রামে বাঙালি তার বিজয় নিশ্চিত করে, কারণ তার রয়েছে একটা গণতান্ত্রিক মন, যার অতীত ঐতিহ্য হাজার বছরেরও পুরনো। 

কোনো প্রকার দ্বিধা বা সংশয় প্রকাশ ব্যতিরেকে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাঙালির গণতান্ত্রিক মন রয়েছে বলেছে দুই দশক পেরোতেই তারা দ্বিতীয় বারের মতো গণ অভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছে এবং জনতার বিজয় সুনিশ্চিত করেছে। প্রথম গণ অভ্যুত্থাণ সংঘটিত হয় পরাধীন দেশে। দ্বিতীয় গণ অভ্যুত্থাণ সংঘটিত হয় স্বাধীন দেশে। তার ঠিক তিন বছর আগে গণতন্ত্রের পোস্টার হিসেবে আবির্ভুত হন নূর হোসেন।

গোপাল যেভাবে রাজা নির্বাচিত হয়েছিলেন তার নজির পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিরল। বলা হয়, ৯০ এর গণ অভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী যেভাবে সরকার গঠিত হয়েছিল। ১৯৯৬ এ যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা গঠন ও বাস্তবায়ন হয়, সেসবে গোপালের রাজা নির্বাচিত হওয়ার ছাপই প্রকারান্তরে দৃশ্যমান হয়েছিল। গণতন্ত্রের এমন দৃষ্টান্ত থাকার পরও সেই অর্থে আমাদের গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারিনি। যে জাতির জিনেই গণতন্ত্রের পরম্পরা রয়েছে সেই জাতির কেন কেবল গণতন্ত্রের পোস্টার থাকবে। সেই প্রশ্নের সুরাহা হওয়া জরুরি।

Comments