নির্বাচিত সরকার বনাম আমলাতন্ত্র: দেশ চালাচ্ছেন কে

দেশ কে চালাচ্ছেন, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু কার মাধ্যমে তিনি দেশ পরিচালনা করছেন? সংসদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে? নাকি আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে? আমরা এই কলামে সেই প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছি।
ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

দেশ কে চালাচ্ছেন, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু কার মাধ্যমে তিনি দেশ পরিচালনা করছেন? সংসদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে? নাকি আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে? আমরা এই কলামে সেই প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছি।

একটি কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচিত রাজনীতিবিদ যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন অনির্বাচিত সরকারি কর্মচারী। জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে রাজনীতিবিদদের অবস্থান পরিবর্তন হলেও অনির্বাচিত সরকারি কর্মচারীরা স্থায়ী। রাজনীতিবিদরা নীতিমালা তৈরি করেন, আর আমলারা তা বাস্তবায়ন করেন। রাজনীতিবিদরা স্বাভাবিক প্রবণতায় জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেন, আর আমলাদের দায়িত্ব নিয়ম-নীতি নিশ্চিত করা। রাজনীতিবিদরা জনগণের সমর্থনে চলেন, আর আমলাদের খরচ নির্বাহ করা হয় করদাতাদের অর্থ দিয়ে—এর থেকেই সম্ভবত 'পাবলিক সার্ভেন্ট' কথাটি এসেছে।

সুশাসন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও 'অপরিবর্তনীয়' সরকারি কাঠামোর সমন্বয়। অর্থাৎ, এই দুইয়ের সুষ্ঠু ভারসাম্যে নিশ্চিত হয় সুশাসন।

তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা তা অনেকাংশে নষ্ট করে ফেলেছি। আর সেটা হয়েছে উভয়পক্ষ থেকেই। রাজনীতিবিদরা আমলাদের রাজনীতিকরণ করেছে এবং এরপর আমলারা রাজনীতির আমলাতান্ত্রিকরণ করেছে। উভয়েই একে অপরের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, যেখানে উপেক্ষিত থেকেছেন সাধারণ মানুষ। কারণ সাধারণ মানুষের চাহিদা নিয়ে লড়াই করার আর কেউ নেই।

এর ফলে আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে যে প্রান্তিককরণ দেখা দিয়েছে, সেটা শুধু করুণই নয়, একইসঙ্গে বিপজ্জনক। কারণ রাজনীতিবিদরা যতই পথভ্রষ্ট হন না কেন, জনগণের কাছে তাদেরকে কিছুটা হলেও জবাবদিহি করতে হয় রাজনৈতিক দল এবং স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু আমলাদের জবাবদিহি করতে হয় শুধুমাত্র তাদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কাছে, যা কালের প্রবাহে কেবল নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

বর্তমান সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বভার আরও বেশি করে ন্যস্ত হচ্ছে সেইসব শীর্ষ আমলাদের হাতে, যাদের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি। গত বেশ কয়েক বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের চেয়ে আমলাদের ওপর বেশি ভরসা করছেন।

রাজনীতিবিদরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জায়গায় আমলাদের কাছে পরাজিত হয়েছেন সেটা হচ্ছে, সংসদ। রাজনীতিবিদদের কারণেই সংসদের ক্ষমতা, কার্যকারিতা, প্রাসঙ্গিকতা ও সম্মান হারিয়েছে। যখন সংসদের ভূমিকা সংকুচিত হতে হতে কেবল আত্মপ্রশংসা ও বিরোধীদলের সমালোচনায় এসে ঠেকে, সেই সময়ে রাজনীতিবিদরা ক্ষমতাসীন দলের হন কিংবা বিরোধীদলের, সবাই সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা হারান। বর্তমান সময়ে সার্বিক নীতিমালা প্রণয়ন বা দেশের দৈনন্দিন দেখভালের প্রক্রিয়ায় আমাদের সংসদ সদস্যদের ভূমিকা প্রায় শূন্যের কোঠায়। তারা যখন কোনো কথা বলেন, তাতে আমাদের মনোযোগ তেমন একটা থাকে না। কারণ তাদের মন্তব্যের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই বললেই চলে।

সংসদে কোনো উল্লেখযোগ্য বিষয়ে বিতর্ক হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি না হলেও অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ চিহ্নিত হলেও, এ বিষয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সংসদে হয় না। মহামারি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, অর্থপাচার, খেলাপি ঋণ, মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক দুর্ঘটনায় শীর্ষে থাকার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কোনোটিই আমাদের সংসদ সদস্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি।

সরকারে সামরিক বাহিনীর অবৈধ হস্তক্ষেপ এবং স্বভাবতই আমলাতন্ত্রের ওপর তাদের নির্ভরতায় দেশের রাজনৈতিক আবহে আমলাদের ক্ষমতা অনেক বেশি বেড়ে যায়।

গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের আধা-সামরিক ও একনায়কতান্ত্রিক সরকারকে শান্তিপূর্ণভাবে উৎখাতের পর আমাদের সামনে সুবর্ণ সুযোগ ছিল সবকিছু ঢেলে সাজিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছিল, যা দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা দেয় (১৯৯১ সালের ১৪ জানুয়ারি দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত লেখকের 'Dreams Reborn' কলাম দেখুন)। তবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার বৈরিতায় এই মহাজোট দুর্বল হতে থাকে এবং তাদের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়। ফলে আমলারা আবারও তাদের হারানো ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রভাব ফিরে পান।

সম্ভবত এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক রূপটি তখন সামনে এসেছিল, যখন মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রধান ও ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ সচিবালয়ের সামনে 'জনতার মঞ্চ' গঠন করেছিলেন। সেখানে যোগ দিয়ে অসংখ্য আমলা খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। প্রথমবারের মতো—কোন দল ক্ষমতায় আসবে তা নির্ধারণে আমলারা প্রকাশ্যে আবির্ভূত হলেন। এই ঘটনার পর তারা আর পেছনে ফিরে তাকাননি।

এই মুহূর্তে আমলাতন্ত্রের ক্ষমতাবানদের দেখতে চাইলে চোখ রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে। কেননা, শুধুমাত্র জ্যেষ্ঠ আমলারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কাজ করেন। মুখ্যসচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব এবং মন্ত্রীপরিষদ সচিবের সমন্বিত জোট প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন। তাদের সঙ্গে যদি অর্থসচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর (২ জনই আমলা) এবং আরও ২-১ জন সচিবকে যোগ করি, তাহলেই দেশ পরিচালনায় ক্ষমতা অবকাঠামোর মোটামুটি চিত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বেশিরভাগ দেশে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা হিসেবে মন্ত্রিসভা (কেবিনেট) থাকলেও আমাদের মন্ত্রিসভা শুধু রাবার স্ট্যাম্পের ভূমিকা পালন ছাড়া আর কিছুই করছে না। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সামনেও সুপারিশগুলো আমলারা তৈরি করে দেন এবং কমিটির সদস্যদের কার্যত সেখানে তেমন কিছুই করার থাকে না।

আমলাতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার বিষয়টি পুরোপুরি বুঝতে হলে আমাদেরকে রাজনীতিবিদদের ক্ষয়িষ্ণু গুণগত মান, বিশেষত তাদের নৈতিকতার মানদণ্ডের অবনতির বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে। রাজনীতিবিদদের মানদণ্ড কখনোই তাদের একাডেমিক 'ডিগ্রি' দিয়ে নির্ধারণ করা হয়নি। তাদের ক্ষেত্রে মানদণ্ড ছিল মানুষের আশা ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং জনগণের সেবায় অঙ্গীকারের মাত্রা বিবেচনা। কিন্তু যখন অর্থকড়ি, স্থানীয় মাস্তানদের অর্থায়ন, সহিংসতার মাত্রা (বিশেষত, প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে) এবং অর্থের বিনিময়ে দলের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পাওয়াই মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়, তখন স্বভাবতই সার্বিকভাবে তাদের সম্মান ও নৈতিকভিত্তি কমে যায়। বর্তমান সময়ের সরকারি কর্মকর্তারা ধরেই নেন যে একজন সংসদ সদস্য বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা অন্য যে কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যে উন্নয়ন তহবিল পাবেন, তার পুরো অংশ বরাদ্দকৃত খাতে ব্যয় হবে না। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে আরও কঠোর আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আসে এবং কর্মকর্তাদের দিকেই ক্ষমতা ঝুঁকে যায়। সম্প্রতি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে মহামারির সময়ে সহায়তা বণ্টন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি বরাদ্দ, ত্রাণ ও অন্যান্য সরকারি প্রণোদনা বণ্টন রাজনৈতিক দল-নেতার প্রতি বিশ্বাসের অভাবের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

'আমলাতন্ত্র' বলতে আমরা সাধারণত প্রশাসনিক ক্যাডার বুঝি। কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতের ক্যাডারদের অন্তর্ভুক্ত করলে, বিশেষত, পুলিশ ও অন্যান্য গোয়েন্দা শাখাকে বিবেচনায় নিলে আমরা এর সুবিশাল কাঠামো সম্পর্কে ধারণা পাই, যাদের হাতে রয়েছে অপরিসীম ক্ষমতা। জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে এমন সব কাঠামো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় তাদের এই ক্ষমতা অসীম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর সঙ্গে আমলাদের নিয়ন্ত্রণাধীন বার্ষিক বাজেটের বিপুল বরাদ্দ ও মেগাপ্রকল্পগুলো যোগ হয়ে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও তহবিল বরাদ্দের ক্ষমতা অকল্পনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

এমন কর্তৃত্ব ও অসীম ক্ষমতা এবং সেইসঙ্গে আনুষঙ্গিক সুবিধার কথা তো বলাই বাহুল্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার তাদেরকে নিজেদের পক্ষে রাখতে উঠেপড়ে লেগেছে। কেন? কারণ, বর্তমানে আমাদের রাজনীতি অনেকাংশেই আমলা নির্ভর, বিশেষত নির্বাচনের দিক থেকে। এই বিষয়টি আমাদের আমলাতন্ত্রকে চূড়ান্ত ক্ষমতা দিয়েছে। আগামীতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে আমলাতন্ত্রের এই ক্ষমতা বাড়তেই থাকবে এবং আমাদের রাজনীতিবিদদের ভাবমূর্তি, সম্মান ও ক্ষমতা কেবল কমতেই থাকবে, যা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments