সায়ীদ আহমেদ বীর প্রতীকের নেতৃত্বে মুকুন্দপুর বিজয়
মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস দেশজুড়ে প্রায় প্রতিটি জেলায় সংঘটিত হয়েছে সম্মুখ যুদ্ধ, এসেছে বিজয়। তার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫ সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিয়ে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমার প্রায় ১০ লাখ মানুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের প্রধান জহুর আহমেদ চৌধুরী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুরাতন কাচারী ভবন সংলগ্ন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। এরই মাঝে বর্তমান বিজয়নগর উপজেলার মেরাশানী, সিঙ্গারবিল, মুকুন্দপুর, হরষপুর, আখাউড়া উপজেলার আজমপুর, রাজাপুর এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে ১৯ নভেম্বরের মধ্যে। এই বিজয়ের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল (অব) সায়ীদ আহমেদ। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অসীম সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করেন।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো সামরিক অভিযান ছিল না; ছিল সাধারণ শোষিত মানুষের মুক্তির অকুতোভয় সংগ্রাম। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে চালানো নির্মম নৃশংসতার বিপরীতে আমরা ছিলাম অসহায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিরোধ যুদ্ধগুলো হচ্ছিলো সমন্বয়হীনভাবে। এমতাবস্থায় এসব স্বাধীনতাকামী, সাধারণ জনগণ মানুষ, ছাত্র শিক্ষক, বাঙালি ইউনিট আর 'বিদ্রোহী' সামরিক সদস্যদের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করাটা জরুরি হয়ে পড়ে। যে যার জায়গা থেকে গুরুত্ব দিয়ে তাই করেছেন।
যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ব্রাহ্মণবাড়ির প্রথম মুক্ত অঞ্চল শালদা নদীর পরে সদরের পাহাড়পুরের একাংশ। ১৯ নভেম্বর মুক্ত হয় মুকুন্দপুর। এটি বর্তমানে বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নে। ভারত সীমান্তের কাছে জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম মুকুন্দপুর। রেলপথে আখাউড়া থেকে সিলেট যাবার সময় আজমপুর রেলস্টেশন পেরিয়ে সিংগারবিল, এর পরের ষ্টেশন মুকুন্দপুর। সীমান্তের ৫০০ গজ পশ্চিমের এই ষ্টেশনটি মুকুন্দপুরের উল্লেখযোগ্য নীরব স্থান। মাঝে মাঝে দু'একটি লোকাল ট্রেন এখানে থেমে মুকুন্দপুরের নিস্তব্ধতায় নাড়া দিয়ে যায়। যেমন নাড়া দিয়েছে একাত্তরের এই অঞ্চলে লাল সবুজের পতাকা।
ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করতে ৩২জন বীর সেনানীর নেতৃত্ব দেয় মেজর জেনারেল সায়ীদ আহমেদ। এরা সবাই ঐতিহাসিক মুকুন্দপুর যুদ্ধের বীর সেনানী। নিজেদের সীমিত ক্ষমতাকে সীমাহীন উচ্চতায় উজাড় করে দিয়েছিলেন জন্মভূমিকে মুক্ত করতে। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে এলাকাবাসীর সহযোগিতা তো আছেই। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ভূমিকা রাখে একজন। যার অসাধারণ সাহায্যে বিজয় হয়েছে সহজ। এর মধ্যে প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশের একাত্তরের যুদ্ধ কতটা ঘটেছে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা। বলা যায় অসামান্য আন্তরিক চরিত্র সায়রা বেগম। একাত্তরে সে ছিল ১৫-১৬ বছরের কিশোরী।
বিষয়টি আর একটু পরিষ্কার করি- সে সময় ডানপিটে স্বভাবের সায়রার দিকে নজর পড়ে পাকিস্তানি হানাদারদের। একপর্যায়ে তাকে ক্যাম্পে যেতে বাধ্য করা হয়। সেখানে তার ওপর চালানো হয় নির্যাতন। যতই দিন যেতে থাকে, নরপশুদের প্রতি তার ঘৃণাও তীব্র হতে থাকে। নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিজেদের প্রয়োজনেও তাকে কাছে নেয়। সে তথ্য পৌঁছে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে এবং পরিপূর্ণ পরিকল্পনায়, সবার সমন্বয়ে নভেম্বরের ১৮ ও ১৯ তারিখের যুদ্ধে মুকুন্দপুরকে মুক্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। দুঃসাহসিক এ ভূমিকার কথা জানা যায় বীরযোদ্ধা মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার 'জনযুদ্ধে গণযোদ্ধা' বই থেকে।
মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের মুকুন্দপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সায়ীদ আহমেদ বিপি (অব.) (তৎকালীন লে.) মুকুন্দপুর মুক্ত দিবসে ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের এক পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে ঐতিহাসিক মুকুন্দপুর যুদ্ধে ছায়েরা বেগমের এ ভূমিকা তুলে ধরার আগ পর্যন্ত তার এ অবদানের কথা কেউ জানতে পারেননি। গবেষক সাইদুল ইসলাম বলেন, গোয়াল নগরের মেয়ে সায়রা স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজ প্রাণ বিপন্ন করে পাকিস্তানিদের অস্ত্র শস্ত্র এবং অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে এ কোম্পানিকে সহযোগিতা করে।
প্রসঙ্গত ছায়েরা বেগম বলেন, বাবার কাজের সুবাদে একাত্তরে আমাকেও ক্যাম্পে যেতে হতো। এক সময় তাদের কোম্পানি কমান্ডার আমার ওপর নির্যাতন চালায়। এর প্রতিশোধ নিতে সুযোগ খুঁজতে থাকি। এক সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তাদের গোয়ালনগরে থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানসহ গোলাবারুদের খবর দিতাম। কোথায় তাদের বাংকার এবং অস্ত্র ও গুলি রাখা হয়েছে, সেসবও জানিয়ে দিতাম।
আড়ালের আর একটি তথ্য পাই মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার বয়ানে, গোয়ালনগর গ্রামের 'নষ্টা' মেয়ে সায়রা হঠাত করেই আর নষ্টা রইল না। বাবা আজিজ চৌকিদার নামকরা রাজাকার। ঘরে সৎ মা। বাবা আজিজ চৌকিদার নিজেই মেয়ে সায়রাকে মুকুন্দপুর পাকিস্তানি ক্যাম্পে দিয়ে আসে। সায়রার করার কিছুই ছিল না। সায়রার সঙ্গে 'মুতা' বিয়ের নাম করে রাত কাটায় পশুগুলো। এই সুযোগে সায়রা তার নষ্টামির নতুন আঙ্গিক আবিষ্কার করল। শত্রুর অবস্থান ঘুরে ঘুরে শত্রুর বাংকারগুলোর অবস্থান, দুই ঠ্যাংঅলা অস্ত্র (হালকা মেশিনগান) তিন ঠ্যাংঅলা অস্ত্র (ভারি মেশিনগান) কোথায় বসানো এবং কোন দিক লক্ষ্য করে লাগানো একদিন লুকিয়ে এসে সায়ীদদের সব বলে দিল। সায়ীদ, মজুমদার, রফিক, তাজুল, মোজাম্মেল, এলু এবং মোতালেবরা তাদের আক্রমণ পরিকল্পনার শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলল।
সে পরিকল্পনাসহ এই বিষয়ে মেজর জেনারেল (অব.) সায়ীদ আহমেদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯ নভেম্বর একটি বিশেষ দিন। এ দিনটি আমার জীবনের বিশেষ করে আমার সৈনিক জীবনেরও উল্লেখযোগ্য দিন। এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানিকে নেতৃত্ব দেওয়া এবং লে. কর্নেল ভার্মার নেতৃত্বে ১৮ রাজপুত ব্যাটালিয়নের সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমে মুকুন্দপুরকে মুক্ত করতে সক্ষম হই।
তিনি আরও বলেন, ১৮ নভেম্বর পরিকল্পনা অনুযায়ী আঁধার রাতে আমরা যার যার সৈন্যদল কোম্পানি নিয়ে মুকুন্দপুরে অনুপ্রবেশ করে ট্রেঞ্চ নির্মাণ শুরু করি। রাত চারটার মধ্যে প্রত্যেকের ট্রেঞ্চ নির্মাণ শেষ হয়। আমি ভোর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে সবার অবস্থান দেখি। ভোরের আলো ফুটলে দেখা যায় শত্রুর বাংকার। আমি ট্রেঞ্চে। সঙ্গে রফিক, মোজাম্মেল ও ওয়্যারলেস অপারেটর। পাকিস্তানি বাহিনীর চারটি বাংকারের মুখোমুখি আমরা। অতিরিক্ত ১৮ রাজপুত কোম্পানিটি গোয়ালনগরে যেতে অস্বীকার করে আমার কোম্পানির সঙ্গে অবস্থান করতে চায়। তারা আমার কোম্পানির অবস্থান উঁচু ঢাল ঘেঁষে উত্তর-পশ্চিম মুখ করে অবস্থান নেয়।
শত্রুরা আমাদের অবস্থান টের পেয়ে গোলাগুলি শুরু করে। আমরাও পাল্টা গুলি ছুড়ি। আমাদের সৈনিকেরা যেভাবে গুলি ছুড়তে থাকে, তাতে তাঁদের কাছে থাকা ৬০-৭০টি গুলি অল্প সময়েই শেষ হয়ে যাবে। আমি দ্রুত অধিনায়ক লে. মনছুরুল ইসলাম মজুমদার ও অধিনায়ক সুবেদার মান্নাফকে তাঁদের প্লাটুনের সৈন্যদের গুলি ছোড়া নিয়ন্ত্রণ করতে বলি। আমার কোম্পানির অবস্থান শত্রুর অবস্থানের এত কাছে ছিল, আমাদের নিজস্ব আর্টিলারির গোলা আমাদের কোম্পানির সামনে ও পেছনে পড়ছিল।
ঘণ্টাখানেক পর গোলাগুলি স্তিমিত হয়ে এলে আমি রানারকে নিয়ে আমার অবস্থানের পশ্চিম দিকটা দেখতে যাই। ওখানে একটি বাড়িতে একজন বয়স্ক পুরুষ ও একজন নারী ছিলেন, তাঁরা আমাদের পান্তাভাত খাওয়ান। সকাল ১০টার দিকে দেখতে পাই, আমাদের অবস্থানের পশ্চিমে গোয়ালনগর গ্রামের কিনারায় আমাদের দিকে মুখ করে বিভিন্ন গাছের নিচে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান নিচ্ছে। এটা দেখে আমার বাঁয়ের রাজপুত কোম্পানির অধিনায়কের কাছে যাই। দেখতে পাই, গোয়ালনগর গ্রাম থেকে খাকি হাফপ্যান্ট পরা অস্ত্রহীন দুই ব্যক্তি মাথায় হাত তুলে আমাদের দিকে আসছে। আমরা তাদের আসতে দিই, তারা আমাদের জানায়, হাবিলদার গোলাপ খান তার সৈন্যদলসহ আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায়। আমরা তাদের বলি, দুপুর ১২টার মধ্যে আসতে হবে। তারা আসবে দুজন দুজন করে মাথার ওপর অস্ত্র তুলে ধরে। আমি তাদের একজনকে রেখে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রাজপুত অধিনায়ক তাদের দুজনকে ছেড়ে দিতে বলেন। সময়সীমা গড়িয়ে গেল, গোলাপ খানের সৈন্যদল আত্মসমর্পণ করতে না এলে আমরা গোয়ালনগরে তাদের অবস্থানের ওপর গুলি চালাই এবং আর্টিলারি গোলাবর্ষণ করি। এরপর গোয়ালনগরে শত্রুর আর নড়াচড়া দেখতে পাইনি। আমাদের গোলাগুলিতে তারা পিছু হটে যায়।
আমার কোম্পানির সৈন্যদের যখন নিয়ন্ত্রণ করছি, তখন বেলা তিনটার দিকে ওয়্যারলেসে কর্নেল একে ভার্মা জানান, তাঁর যুদ্ধ পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আমার কোম্পানি নয়, শত্রুর ডান দিক থেকে ১৮ রাজপুত বাহিনীর ক্যাপ্টেন প্রিতম তাঁর কোম্পানি নিয়ে শত্রুর ওপর আক্রমণ করবে। কর্নেল ভার্মার বক্তব্য আমার সৈন্যদের নিরাশ করে। পরিবর্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ শুরু হয়। ওই সময় দেখি কিছু পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের ডান দিক থেকে পালাচ্ছে, আমার কিছু সৈন্য নিয়ে আমি তাদের তাড়া করি। ওদের দুজন গুলি খেয়ে রেললাইনের ওপর পড়ে যায়। এরপর দক্ষিণ দিকে সার্চ করে কিছু না পেয়ে আমরা নিজ অবস্থানে ফিরে আসি। সন্ধ্যার আগেই পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় বরণ করে। ২৮ জন পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ১৯ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয়।
৩ নং সেক্টরের মেজর জেনারেল কে. এম. শফিউল্লাহ প্রসঙ্গত তার বইতে লিখেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু ভালোভাবে এগোয় এবং ১৯ নভেম্বর প্রভাত-কালীন হামলা শুরু হয়। পাকিস্তানীরা তাদের ফাঁড়ি থেকে বেপরোয়া গতিতে আমাদের হামলা করে। অদূরবর্তী ফাঁড়িসমূহ থেকে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য আক্রান্ত ফাঁড়ির সাহায্যে জানার জন্যে চেষ্টা চালায়। কিন্তু বন্ধ অবস্থান নিয়োজিত আমাদের সৈন্যরা তাদেরকে প্রতিরোধ করে। পর্যন্ত যুদ্ধাহত থাকে। শেষ পর্যন্ত ল. সায়ীদ মুকুন্দপুর দখল করে।
সায়ীদ আহমেদের সহযোদ্ধা মতিউল আলম ভূইয়া বলেন, ১৯ নভেম্বর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয় সুবেদার মোনাফের অধিনে। সেই এক বুলেট বৃষ্টি। গোলাগুলির শব্দে মনে হয় যেন রোজ কেয়ামতের আলামত। মহাপ্রলয় শুরু হয়ে গেছে। এটাই আমার প্রথম প্রথাগত যুদ্ধ। পূর্বের যুদ্ধগুলি ছিলো "হিট এন্ড রান। দুপুরের পর লে. সায়ীদ ক্লরিং করে সব ব্যাংকারের খবর নেন। বলেন মতিউল, স্যার- মনোবল শক্ত রেখো। শত্রুকে দেখে গুলি ছুড়তে হবে।
প্রায় দু'ঘণ্টা পরে একজন বাজউর স্কাউটকে ধাওয়া করি। এদিকে আমার পিছনে করম আলী ও আরেকজন সৈন্যকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। পরে সেই সৈনিকটি পেছন থেকে আমাকে ধরে ফেলে এবং করম আলীর সামনে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। করম আলী বলে শূয়রের বাচ্চা তাকে ছেড়ে দে।
এই ভাবে চার পাঁচ মিনিট চলে। রাজপুত ওস্তাদ ধারামপালের প্রশিক্ষণের কথা মনে পড়ে যায়। আমার সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে ডান হাতের কনুই দিয়ে সৈনিকটির অণ্ডকোষে সজোরে আঘাত করি। সৈনিকটি মাটিতে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে করম আলী তার ঝ.খ.জ এর বেয়নেট সৈনিকটির পেটে ঢুকিয়ে দেয়। ফিনকী দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। মনে হয় সদ্য জবাইকৃত কোন গবাদিপশু কাতরাচ্ছে। করম আলী তার হাতের নতুন ফেভারলোভা ঘড়িটি নিয়ে যায়। পরে অবশ্য যুদ্ধক্ষেত্রেই এটি হারিয়ে যায়। আমি মৃত সৈনিকটির স্টিল হেলমেটটি মাথায় দিয়ে রাখি। যা এখন মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘরে আমার নামে স্মারক হিসেবে আছে।
গ্রুফ কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা দবির আহম্মেদ ভূঁইয়া বলেন, সায়ীদ আহমেদ দায়িত্ব নিয়েই মুকুন্দপুর পাকিস্তান ঘাটি আক্রমণ ও মুকুন্দপুর দখল করার জন্য পরিকল্পনা করেন। মনোবল-সহস নিয়ে একদিন বললেন, মুকুন্দপুর মুক্ত করা তার জন্য কঠিন ব্যাপার নয়। সেই সাহসে সবাই এক সঙ্গে থাকি।
এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যতম মো. রফিকুল ইসলাম গবেষক জয়দুল হোসেনকে জানান, রাত চারটার মধ্যে প্রত্যেকের স্ব-স্ব ট্রেঞ্চ তৈরি হয়ে গেল। লে. সায়ীদ আক্রমণের অধিনায়ক হিসেবে ভোর পর্যন্ত আমাদের সকলের অবস্থান ঘুরে ঘুরে দেখলেন। সবাই প্রস্তুত। এখন শুধু অপেক্ষা, কখন ভোর হবে। কখন শত্রু লক্ষ্যবস্তু হবে। কখন শুরু হবে প্রতীক্ষিত যুদ্ধ। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়লো। এই তো দেখা যাচ্ছে শত্রুর ক্যাম্প, বাংকার। আমাদের মধ্যে টান টান উত্তেজনা। ঠিক তখনই শীতের কুয়াশা চারদিক ঢেকে দিল। আবার ঘণ্টাখানেক সময় নিল কুয়াশা কাটতে। সূর্যের আলোয় চারদিকে ফর্সা হয়ে গেল।
লে. সায়ীদের সাথে একই ট্রেঞ্চে অবস্থান নিয়েছি আমি, মোজাম্মেল ও অয়্যারলেস অপারেটর। পাকিস্তান বাহিনীর চারটি বাংকার আমাদের চোখের সামনে, আমরা মুখোমুখি। লে. সায়ীদ প্রথম গুলি চালালেন। সঙ্গে সঙ্গে জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে গর্জে উঠল আমাদের সকল অস্ত্র। শুরু হলো প্রচণ্ড যুদ্ধ। উভয় পক্ষের গুলি, আর্টিলারির বিস্ফোরণ আর জয়বাংলা ধ্বনিতে সমস্ত এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠতে লাগলো। বেলা তিনটা পর্যন্ত প্রচণ্ড সংঘর্ষ চললো। শেষ পর্যন্ত অনেক হতাহতের পর ২৮জন পাকিস্তান সেনা আত্মসমর্পণ করলো। এ যুদ্ধে বহু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের দখলে আসলো। পাকিস্তানরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করলো। আর মুকুন্দপুর মুক্ত হলো।
সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়নগর উপজেলার রয়েছে অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ভাষ্য অনুযায়ী বলা যায়, এই যুদ্ধের পর থেকে বৃহত্তর যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত তারা মুকুন্দপুরকে মুক্ত রেখেছিল। এ বিজয় তাদেরকে বৃহত্তর যুদ্ধে এগিয়ে যাবার সাহসও যুগিয়েছে। একাত্তরে মুকুন্দপুর এই যুদ্ধ কতটা অনুপ্রেরণার- নিশ্চয় তা কল্পনা করা যায়। ১৯ নভেম্বর পাহাড়পুর ইউনিয়নের মুকুন্দপুর এলাকাটি অন্যতম মুক্ত এলাকা। এইদিনটিকে মুকুন্দপুর দিবস হিসেবে প্রতি বছর পালন করা হয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ জন বন্দী হয়। হস্তগত হয় ২৭ টি রাইফেল, ২টি স্টেনগান, ২টি এলএমজি এবং ১'৩ ইঞ্চি মর্টার।
উল্লেখ্য মুকুন্দপুরের বিজয়ে অধিনায়ক মেজর জেনারেল সায়ীদ আহমেদ, মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক একে লে. কর্নেল ভার্মা। গ্রুফ কমান্ডার মো. রফিকুল ইসলাম ও ২য় কমান্ডার দবির আহমেদ ভূঁইয়া এবং একমাত্র নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সায়রা বেগম। এই ছাড়া আরও যুক্ত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম, আবদুল বাছির, আলী আজগর ভূঁইয়া, ফুল মিয়া, আবদুল জব্বার (মৃত্যু), বেনু মিয়া, আব্দুল মোতালেব (মৃত্যু), ফিরোজ মিয়া (মৃত্যু), বজলুর রহমান (মৃত্যু), মস্তু মিয়া, শহিদ ভূঁইয়া, আবদুল খালেক ভূঁইয়া (মৃত্যু), নুরুল ইসলাম (মৃত্যু), নুর মিয়া শেখ, হামদু চৌধুরী, হরমুজ আলী, ধন মিয়া (মৃত্যু), নুরুল ইসলাম, শামসুদ্দিন ভূঁইয়া (মৃত্যু), আবদুল মোতালিব (মৃত্যু), আবদুল জব্বার (মৃত্যু), ফিরোজ মিয়া (মৃত্যু), ধন মিয়া (মৃত্যু), তাজুল ইসলাম (এলু), কুদ্দুস মিয়া (মৃত্যু), জয়নাল আবেদীন (মৃত্যু), মোজাম্মেল হক (মৃত্যু), জয়নাল আবেদিন (মৃত্যু), মোজাম্মেল হক (মৃত্যু) ও শাসছু মিয়া।
Comments