কেমন ছিল শতবছর পূর্বের ঈদ
বাংলাদেশের বৃহত্তম উৎসব ঈদুল ফিতর। এটি রোজার ঈদ নামেও পরিচিত। ঈদ ইসলামী শরীয়তের একটি বিধান, ফলে ঈদের ইতিহাস মানেই মুসলমানদের ইতিহাস। বাংলায় ইসলামের বয়স যত, ঈদের বয়স তারচেয়ে কম না। কিন্তু সবসময় তো উৎসবের ধরণ এক থাকে না। প্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত রূপে পালিত হয় বিভিন্ন উৎসব।
এখন আমরা যেভাবে ঈদুল ফিতর উদযাপন করি আমাদের পূর্ব পুরুষরা অবশ্যই এভাবে করতেন না; তাদের সময়ে উদযাপনের ভঙ্গি ছিল আলাদা। শতবছর যে কোনো বিষয়ের জন্যই মাইলফলক। এই মাইলফলক সামনে রেখে যদি প্রশ্ন করি: শতবছর পূর্বে রমজানের ঈদ উদযাপনের রীতিনীতি কেমন ছিল? কিভাবে পালন করতেন আমাদের পূর্বপুরুষরা? উত্তর মেলানোর চেষ্টা করেছি গুণীজনদের স্মৃতিকথার সহায়তায়। কারণ, স্মৃতিকথা সমকালীন সমাজের দলিল।
শতবছর পূর্বের ঈদ নিয়ে পেয়েছি তিনজনের স্মৃতি— আবুল মনসুর আহমদ, আবু রুশদ এবং সৈয়দ মুস্তাফা আলী।
আবুল মনসুর আহমদ (১৯৯৮-১৯৭৯) ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানিখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে উঠেছেন সেখানেই। তার দেখা ঈদের চিত্র: "সাধ্যমতো নতুন কাপড়-চোপড় পরিয়া লোকেরা বেদম গান-বাজনা করিত। সারারাত ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইত। প্রায় বাড়ি বাড়ি ঢোল-ডগর দেখা যাইত।" (আবুল মনসুর আহমদ, ২০১৪, ২৮) অর্থাৎ, হাল আমলে ঈদের উৎসবমুখর পরিবেশে বাজনার যে ভূমিকা দেখা যায় তা নতুন নয়। শতবর্ষ পূর্বে ময়মনসিংহের ত্রিশালেও ছিল ঈদের দিন বাদ্য বাজানোর রেওয়াজ।
কথাসাহিত্যিক আবু রুশদ (১৯১৯-২০১০) বর্ণনা করেছেন তৎকালীন কলকাতায় দেখা ঈদের দৃশ্য: "যেদিন ঈদের চাঁদ দেখা দিতো সেটা ছিল মহা স্ফূর্তির সময়। সাধারণত দুই ঈদের ব্যবধানে আমরা নতুন কাপড় ও জুতো পেতাম। খুব বাহারি কিছু নয়। পায়জামা ফুজি সিল্স এর পাঞ্জাবী আর চপ্পল। সেগুলি কিনতাম তখনকার মধ্যবিত্তদের জন্য খুব চালু ডিপার্টমেন্ট স্টোর ওয়াছেল মোল্লা থেকে। নতুন কাপড় পেলে উৎসাহের পরিমাণ অবশ্য অনেক বেড়ে যেতো। আমার নিজেরটা আমি নিজেই সাবান দিয়ে খুব যত্নের সঙ্গে কাঁচতাম তারপরে ইস্ত্রি করিয়ে রাখতাম। নতুন স্যাণ্ডেল হলে তাতেও কালি লাগিয়ে ব্রাশ ও পুরানো গরম কাপড়ের টুকরো দিয়ে তা পরিষ্কার করে স্যাণ্ডেলটাকে ঝকঝকে তকতকে করে তুলতাম। ওসব ব্যাপারে আমার হাত খুলতো ভাল। এ-ব্যাপারে আমার পথ-প্রদর্শক ছিলেন চাচা, তাকে নিজের দামী জুতো নিজের হাতে সাফ করতে দেখেছি, তবে কালি দেবার আগে তিনি জুতোটাকে কাগজী লেবুর ছিলকে দিয়ে আগে ভালো করে ঘষে নিতেন।
ঈদের দিনে নামাজ পড়তে যেতাম হয় খানকা পাক কিম্বা গড়ের মাঠে। খানকাপাকের জমায়েৎ স্বাভাবিক কারণেই গড়ের মাঠ বা নাখোদা মসজিদের জমায়েৎ-এর মতো জমজমাট হতো না, যদিও প্রত্যেক জায়গাতেই নামাজীরা পার্শ্ববর্তী সব রাস্তায় উপচিয়ে পড়তো। গড়ের মাঠের জমায়েৎটা আমাকে বিশেষভাবে অভিভূত করতো। খোলা আকাশের নীচে বিশাল উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে লক্ষাধিক নামাজী যখন এক সঙ্গে সিজদা করতো—আশে পাশে ও দূরে মহানগরীর দৈনন্দিন জীবন-যাত্রা অনেকটা ক্ষীয়মাণ হলেও চালু আছে—তখনকার দৃশ্য বিদেশী পর্যটকরা নিজেদের ক্যামেরায় তুলে রাখতো আর আমার সিজদা দিতে একটু দেরী হলে বা আমি মাথাটা একটু আগে তুললে সেই ঐক্য ও শৃঙ্খলার ছবি আমার বিমুগ্ধ কিশোর মনে গভীরভাবে গাঁথা হয়ে যেতো।
আচকান পাগড়ী জুতো রুমাল ছিল কতো ধরনের কতো আকৃতির কত বর্ণের আর নামাজ শেষে কোলাকুলির মধ্যে মনে হতো নির্মল প্রশান্তির এক হিল্লোল খেলে যাচ্ছে। নতুন কাপড় পরা ছোট ছোট ছেলেমেয়ের মুখে যে হাসির আভা ফুটে উঠতো তা মনে করতাম বেহেস্তের খুশী ও নেয়ামৎ বয়ে এনেছে। নামাজ শেষ করে খাওয়া দাওয়া সেরে ঈদের বকশিস-এর আশায় আত্মীয়-মহলে আনাগোনা শুরু হয়ে যেতো। এক আনা দু'আনা করে, এক বিশেষ আত্মীয়া একটা সিকিও দিতেন, আমার নসীবে এক টাকার উপর জুটে যেতো। ছয় আনা দিয়ে ট্রামের ফার্স্ট ক্লাস ডেইজ কনশেসন টিকিট কিনে ট্রামে করে শহরটা চষে বেড়াতাম। বাগবাজার শ্যামবাজার নিমতলী কালীঘাট টালিগঞ্জ বালিগঞ্জ হ্যারিসন রোড বেলগাছি খিদিরপুর কলকাতার পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ কোনটাই আমার ঘুরবার আওতার বাইরে থাকতো না। যেখানেই মসজিদ বা মুসলমানদের বসতি সেখানেই কাওয়ালী গীত, হোটেলের পাশে ফুটপাত-এর উপরে তাঁবু টাঙ্গিয়ে আর 'ভেনস্তো' চেয়ার ছড়িয়ে পরাটা কাবাব ভুনা গোস্ত সেমাই ও ফিরনির পর্যাপ্ত আয়োজন আর উদ্দীপ্ত ভঙ্গীতে কথোপকথনের অবিরাম স্রোত।" (আবু রুশদ, ১৯৮৯, ৭৮-৯)
আবু রুশদের এই স্মৃতিকথা থেকে তিনটি বিষয় স্পষ্ট। ১. ঈদ উপলক্ষে নতুন কাপড়-চোপড় কেনার রেওয়াজ তখনো ছিল। মনে রাখতে হবে, কলকাতা তৎকালীন বাংলার প্রধান শহর; ফলে শহরের এই চিত্র সবখানে ছিল তা ভাবার প্রশ্নই উঠে না। ২. ঈদের দিন কাওয়ালী হতো, কলকাতার বিভিন্ন মুসলিম এলাকায়। ৩. বড়দেরকে সালাম করবার পর ছোটদেরকে সালামি দেওয়ার যে রেওয়াজ তা নতুন নয়, ছিল শতবছর পূর্বেও। সালামির রেওয়াজ পাওয়া যায় ত্রিশের দশকে কলকাতায় বেড়ে উঠা জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের স্মৃতিকথায়: "বড়দেরকে সালাম করবার পর তখনকার দিনেও ছিল সালামি উপহার দেওয়ার রেওয়াজ। এখন বেশ মজাই লাগে ভাবতে—পুলিশের নিচের পদের হাবিলদার সাবেরা সালামি দিতেন ডবল পয়সা। মাথায় মুকুট কুইন ভিক্টোরিয়া অথবা সম্রাট পঞ্চম জর্জের ছাপঅলা তামার ডবল পয়সা। সেই যে কত ছিল!" (মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ২০১৯, ২৬)
সৈয়দ মুজতবা আলীর জ্যেষ্ঠ সহোদর সৈয়দ মুস্তফা আলী (১৯৭৭) শৈশব কাটিয়েছেন পিত্রালয় সিলেট জেলার করিমগঞ্জে। তিনি লিখেছেন: "শীতের দিনে রোযা শুরু হয়েছে। সমস্ত দিনের কর্মসূচি পালটিয়েছে। মা খুব ভোরে উঠে আমাদের খাইয়ে দাইয়ে রোদে বসেছেন। আমরা সকলে শিউলী ফুলের পাপড়ি ছাড়িয়ে লাল বোঁটা একত্র করছি। মা পাশে বসে সেমাই তৈরি করছেন। সেমাই ডালার উপর রেখে মা রৌদ্রে শুকোতে দিলেন। শিউলির বোঁটাও রৌদ্রে দিলেন। তারপর মা কাপড় কেটে পাজামার মাপ নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গায়ের জামার মাপ। আমাদের কি আনন্দ! পয়লা রোযা হ'তে নিত্য চললো ঈদের প্রস্তুতি। পঞ্চাশ বছর পূর্বের (১৯১৮) কথা বলছি। সন্ধ্যার সময় শিউলীর বোঁটা উঠিয়ে মা একটি বোতলের ভেতর রাখলেন আর সেমাই ভর্তি করলেন বিস্কুটের টিনে। ঈদের দিন মা রাঁধবেন কোরমা পোলাও। আর জরদাতে দিবেন ঐ শিউলী ফুলের বোঁটার রং— তাতে জরদার শুধু যে রং খোলতাই হবে তা নয়— চমৎকার ঘ্রাণও বেরুবে। আর সেমাই তৈরি হবে—যে সেমাই মা নিজের হাতে সারা মাস ভর করেছেন; আমাদের গায়ে উঠবে মার নিজের হাতে সেলাই জামা পাজামা। মাকে নিয়েই ঈদ আর ঈদের খুশীর সব, তাতে রয়েছে মার হাতের স্নেহের পরশ। এ খুশী ভুলবার নয়!" (সৈয়দ মুস্তফা আলী, ১৯৬৮, ৯-১০)
এই স্মৃতিকথাতে কলকাতা শহরের মতো সিলেটেও ঈদ উপলক্ষে নতুন কাপড়-চোপড়ের আনন্দ দেখা যাচ্ছে। আরও দেখা যাচ্ছে, পহেলা রোজা থেকেই ঈদ উদযাপনের জন্য বাড়িতে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। যেটি আমরা হাল আমলে নিজেদের মধ্যে দেখতে পাই।
সৈয়দ মুস্তফা আলীর স্মৃতিকথায় ফরিদপুরের ঈদের একটি চিত্র পাওয়া যায়। ফরিদপুরে থাকাবস্থায় ঈদের দিন ভোরে দুই তিনজন লোক মুস্তফা আলীর বাসায় এসে ডাকাডাকি করলেন। তাদের খাঞ্চায় পোলাও কোরমা। তারা জিজ্ঞেস করলো, "আর কোনো বাসা হতে এসেছে কি? না, আসেনি। তাহলে আমরাই ফার্স্ট হলাম। তাদের কি খুশী—তখনও ফজরের আজান হয়নি। আমাদেরকে এক খাঞ্চা দিয়ে গেল। পরে শুনেছিলাম তাদের দেশে নাকি এই রেওয়াজ—ঈদের দিন কে কার আগে নাস্তা পাঠাতে পারে। এই নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে এক হৃদ্যতামূলক প্রতিযোগিতা চালু আছে।" (প্রাগুক্ত, ২৬) শতবছর পূর্বের ফরিদপুরে ঈদ উপলক্ষে এমন রেওয়াজ চালু ছিল, যা আমরা শতবছর পরও চিন্তা করতে পারি না।
সবমিলিয়ে শতবছর পূর্বের ঈদ-উৎসবের এমন একটি চিত্র আমরা পেয়েছি, যাকে 'কমন' বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ, আবুল মনসুর আহমদ ময়মনসিংহে ঈদের দিন ঢোল-বাদ্য বাজানোর যে চিত্র তুলে ধরেছেন তার সঙ্গে মিল পাচ্ছি আবু রুশদের চিত্রের— যেখানে কলকাতার মুসলিম এলাকাগুলোতে কাওয়ালী আয়োজনের কথা আছে। বলাবাহুল্য, বাজনা ছাড়া কাওয়ালী কল্পনাও করা যায় না।
ঈদ উপলক্ষে নতুন কাপড়-চোপড়ের কথা তিনজনের স্মৃতিতেই স্পষ্ট। আর সালামির রেওয়াজটা তৎকালীন কলকাতার বলে মনে হয়— আবু রুশদ এবং মুস্তাফা নূরউল ইসলাম দুইজনেরই শৈশব কেটেছে কলকাতায়। নামাজ ঈদের প্রধান একটি অংশ। এই প্রধান অংশটির আয়োজনে যে শতবছর পূর্বেও কোনো কমতি ছিল না তা আবু রুশদের হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা থেকেই বোঝা যায়।
জেনে রাখা ভালো যে, বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম ঈদ নিয়ে কবিতা লেখা হয়েছে ঢাকায়, লিখেছেন সৈয়দ এমদাদ আলী, ১৯০৩ সালে। ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় থাকাবস্থায় তিনি পরপর দুই বছর ঈদ নিয়ে দুইটি কবিতা লিখেন। এর আগে বাংলা ভাষায় ঈদ নিয়ে লেখা কোনো কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়নি। পাঠকের জন্য প্রথম আট লাইন উপস্থাপন করা হলো।
ঈদ
সৈয়দ এমদাদ আলী
কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে
তরুণ অরুণ উঠিছে ধীরে
রাঙিয়া প্রতি তরুর শিরে
আজ কি হর্ষ ভরে!
আজি প্রভাতের মৃদুল বায়
রঙ্গে নাচিয়া যেন ক'য়ে যায়
মুস্লিম জাহান আজি একতায়
দেখ কত বল ধরে। (সৈয়দ এমদাদ আলী : ১৯৬৬, ২)
গ্রন্থপঞ্জি:
১. আত্মকথা: আবুল মনসুর আহমদ, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ২০১৪
২. জীবন ক্রমশ : আবু রুশদ, হাক্কানী পাবলিশার্স, ১৯৮৯
৩. কিশোরবেলা : মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, শুদ্ধপ্রকাশ, ২০১৯
৪. আত্মকথা : সৈয়দ মুস্তফা আলী, ঢাকা, ১৯৬৮
৫. ডালি : সৈয়দ এমদাদ আলী, বাঙ্লা একাডেমী, বর্ধমান হাউস, ১৯৬৬
Comments