আহমদ ছফা যাদের কাছে উপেক্ষিত
আহমদ ছফা দেশের উচ্চশ্রেণীতে উপেক্ষিত, নির্বাসিতও বলা যায়। এক্ষেত্রে তার ভাগ্য অনেকটা কাজী নজরুল ইসলাম- জসীম উদদীন, কিংবা আল মাহমুদের মতো। তিনজনের দুজন মোটা দাগে বলা যায় উনিশ শতকের ইউরোপীয় শিল্পবয়ানকে অনুসরণ না করায় চাপা পড়ে গেছেন গ্রান্ড ন্যারেটিভ থেকে। আর আল মাহমুদ চাপা পড়েছেন অন্যবিধ কারণে। সে বিষয় এখানে আলোচ্য নয়।
দীপেশ চক্রবর্তী বলেছেন, পশ্চিম আমাদের অনেক দিয়েছে, তবে তার কারণে আমরা হারিয়ে ফেলেছি ঢের বেশি। যে জায়গায় পশ্চিমের সঙ্গে আমাদের বিরোধ সে জায়গায় আমাদের বয়ানগুলো ভেঙে চুরে প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠেছে। এভাবেই হয়তো আমরা এসব চিন্তাশীলদের পাচ্ছি।
প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ আজম বলছেন, আমাদের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে মূল বয়ান থেকে সরে এসে বৈপ্লবিক কিছু বলেননি ছফা। তবুও প্রতিষ্ঠিত এলিট বুদ্ধিজীবী সমাজের সঙ্গে তার বিরোধ। এর কারণ তিনি বলছেন, "সাহিত্যই করতেন তিনি; কিন্তু তার সমবয়সী ঢাকার বিপুল-অধিকাংশ সাহিত্যিক তিরিশি নন্দনতত্ত্বের জোয়ারে যেভাবে ভেসে গিয়েছিলেন, ছফার ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। সাহিত্যকে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত কোনো নান্দনিক লোকের চর্চা মনে করতেন না।" এটা একটা কারণ। আর একটা কারণ আমাদের বুদ্ধিজীবিতার সংকটের সঙ্গে জড়িত। জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক একবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, 'কথিত'
বেঙ্গল রেনেসাঁ শুরু হবার ৫৭বছর পর সিপাহী বিদ্রোহ হয়। তখন মধ্যবিত্ত বা অভিজাত শ্রেণির ভূমিকা কী ছিলো? আমরা চট্টগ্রামের হাবিলদার রজব আলী খানের নাম জানি কিন্তু দিল্লীর অভিজাত মধ্যবিত্তের নাম পাই না। রণজিৎ গুহ নীলদর্পণের আলোচনায় বলতে চেষ্টা করেছেন সেকালের উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছিলো নীলদর্পণ। তার কারণ নিজেদের মুখ রক্ষার চেষ্টায় নিহিত।
আহমদ ছফা মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বের বছর 'স্বদেশ' নামের একটা পত্রিকা বের করেছিলেন। অল্প কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সে সংখ্যাগুলো এখন পাওয়া যায়। পত্রিকার সংখ্যাগুলোর কেবল সূচিপত্রে চোখ বুলালে বিষয়টি পরিষ্কার হয়। একটা লেখাতেও নজরে পড়ে না কয়েক মাস পরে রক্তক্ষয়ী একটা মুক্তিযুদ্ধ হবে। জন্ম হবে একটি নতুন দেশের। যে দেশের জন্মকে ছফা দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে পলায়নপর একটি নারীর পথে গগনবিদারী প্রসব বেদনার মধ্যে দিয়ে একটি শিশুর জন্মে। সে গল্পটি পাঠকের গল্প। বুদ্ধিজীবিতার এ ধরেনর সংকটের বিরুদ্ধে আহমদ ছফার প্রচণ্ড রাগ ও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে সময়ে সময়ে।
আমাদের প্রতিষ্ঠিত এলিট বয়ানে আহমদ ছফা অনেকটা অনুপস্থিত। কিন্তু জনমনস্তত্ত্বে ছফার তুলনারহিত অবস্থান। তার প্রিয় শিক্ষক আনিসুজ্জামান কিংবা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো জ্ঞানীরা তাঁকে নিয়ে দুকলম লিখেছেন বলে মনে পড়ে না। তিনি আজীবন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করেছেন, প্রতিষ্ঠানও তাকে উপেক্ষা করেছে। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাননি। তিনি বলেছেন, 'বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, এখন স্বাধীনতার পরেও তাঁদের মত অনুযায়ী চললে বাংলাদেশের উন্নতি হবে না।' এ উক্তির তাৎপর্য কম নয়। বাস্তবতাও অস্বীকার করা যায় না। ওপরের উদাহরণগুলোতো এর পরিচয় পাওয়া সম্ভব।
দুই
আহমদ ছফা নামের বানানের আধুনিকীকরণ করতে চেয়েছিলেন, ধ্বনিবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই। ছফা তখন বলেন, আমার বাপ গরু জবাই করে আকিকার মাধ্যমে আমার নাম রেখেছিলেন, সেটা আপনার ধ্বনিবিজ্ঞানের আলোকে পরিবর্তন যোগ্য নয়।
এ মন্তব্যের রসিকতায় প্রতিস্পর্ধী আহমদ ছফাকে পাওয়া গেলেও তাঁর ভাষা চিন্তার একটি দিকও প্রকাশিত। তিনি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করেছেন জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে। তিন বছর বাংলা বিভাগে পড়ে অনার্স ফাইনাল না দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যান ডিগ্রি পাশ করার জন্য। জীবনে একবারই প্রতিষ্ঠান তাঁর প্রতি আনুকূল্য দেখিয়েছিলো। সেটা ছিলো রাজনীতি বিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করার আগেই বাংলা একাডেমির বৃত্তিতে পিএইচডি করার অনুমতি পাওয়া। স্কলারশিপকে তিনি ডিগ্রি করার কাজে ব্যবহার করেন নি। বরং রুটি রুজির সংস্থান হিসেবে ব্যবহার করছিলেন এটিকে। ফলে তার ডিগ্রি হয়নি।
তিন
তার উপন্যাসগুলো পড়লে বোঝা যায় যাপিত-জীবনের বাস্তবতাকে তিনি উপন্যাসে তুলে এনেছেন। এজন্য বেশিরভাগ রচনা আত্মজৈবনিক। একারণে এগুলোকে এতো জীবন্তও মনে হয়। ভালো লেখার একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে একাত্ম হওয়া যায়। পাঠক পড়তে পড়তে মনে করতে থাকেন, আরে! এতো আমারই গল্প। আহমদ ছফার উপন্যাস পড়লে বিষয়টি সহজে উপলব্ধি করা সম্ভব। একজন কেনান আলীতে মন্ত্রী, গাভী বিত্তান্তের আবু জুনায়েদ, কিংবা অলাতচক্রের দানিয়েলের মাধ্যমে দেখা যুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানরত একখণ্ড বাংলাদেশের ছবি— সবটাতে আত্মজৈবনিকের ধাবমান চেহারা ফুটে ওঠে। আহমদ ছফার ভাষাটাও বুঝে নেওয়ার ব্যাপার আছে। গাভী বিত্তান্তের এটা ছোট নমুনা আমরা দেবো।
আসসালামু আলাইকুম জুনায়েদ সাহেব। মাসখানেক আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতে পারিনি, মাফ করবেন।
আবু জুনায়েদ বললেন— আরে মাওলানা সাহেব আসেন আসেন, কয়েকদিন থেকে মনে মনে আমি আপনাকেই খুঁজছিলাম। আবু জুনায়েদ নেপিয়র ঘাসের চুপড়িটা গরুর সামনে রেখে উত্তর দিকের শেডটার বাতি অন করলেন। ঝলমল করে আলো জ্বলে উঠতেই গরুটা মাওলানার নজরে পড়লো। এক ঝলক দেখেই মওলানার কণ্ঠ দিয়ে বিস্ময়সূচক একটি ধ্বনিই বেরুলো :
—মাশাল্লাহ, এই সুন্দর জিনিস আপনি পেলেন কেমন করে? পিঠে দুইখানি পাখা থাকলে অনায়াসে বলা যেতে পারতো এটা বুররাক।
আবু জুনায়েদ বললেন, আল্লাহ দেনেঅলা, তিনিই মিলিয়ে দিয়েছেন।
মওলানা সাহেব কোরানের একটি আয়াত আবৃত্তি করলেন। তার অর্থ দাঁড়াবে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছে দান করেন, যাকে ইচ্ছে কেড়ে নেন। যাকে ইচ্ছে সম্মানিত করেন, যাকে ইচ্ছে লাঞ্ছিত করেন। তারপর দুহাতে আলগোছে দাড়ি মুঠি করে বললেন, —আপনি সঠিক পথটি বেছে নিয়েছেন। বেবাক দেশ খবিশ এবং খান্নাসের আওলঅদ, নাতি পুতিতে ভরে গেছে। এই জাতির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করার চাইতে হাইওয়ানের মহব্বত অনেক বেহেতর। আপনার গরুটি সম্পর্কে তাই একটি কথাই বলবো। আপনার গরুটির চেহারা সুরত যে রকম, কোরআন মজিদের সুরা বাকারায় এই রকম একটা গরুর কথা বলঅ হয়েছে। কেবল দুইটা তাফাত। সুরা বাকারায় যে গরুটির উল্লেখ আছে, সেটির গায়ের রং উজ্জ্বল হলুদ আর আপনার গরুটির রং লাল। আর আপনার গরুর গায়ে চাকা চাকা দাগ আছে। সুরা বাকারার গরুটিতে তেমন দাগের কথা উল্লেখ নেই।
আবু জুনায়েদ বললেন— মওলানা সাহেব গরুর ভাগ্য আর আপনার এলেমের তেজ।
এ বিবরণের ভাষা-সংস্কৃতি আমাদের অজানা নয়। দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কথোপকথন। একজন ভিসি অন্যজন তাঁর প্রতিবেশি। যে গরু নিয়ে এতো আলাপ সেটি ভিসি মহোদয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকাদারের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে পেয়েছেন। অভিজাত মধ্যবিত্তের এ রুচি-সংস্কৃতি আয়োজন তার জীবন যাপনের মধ্যেই থাকে। প্রশ্ন হলো আমরা এটা তুলে ধরবো কি না? মধ্যবিত্তের এই নিকৃষ্টতাতো গোপনীয় বিষয়। এটা প্রকাশ পেয়ে যাক এটা সে চায় না। আহমদ ছফা এটাই প্রকাশ করে দেন। তাই তার প্রতি এতো রাগ, এতো বিতৃষ্ণা আর এতো উপেক্ষা। সেটা জীবনকালে যেমন, মরণোত্তরও তেমন।
ইতিহাসবিদ আহমদ কামাল এক লেখায় বলেছেন, জনা চল্লিশ/ পঞ্চাশেক মানুষ বৃষ্টির মাঝে আহমদ ছফাকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে রেখে আসেন তখন তাঁর মনে হয়েছিলো ইউরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী সঙ্গীতজ্ঞ মোসার্টের কথা। তাঁকেও একইভাবে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রেখে আসা হয়। আহমদ ছফা নিঃসঙ্গ নন, যে রচনাগুলো নিয়ে তিনি অহংকারী ছিলেন সে রচনা সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটাই আহমদ ছফার অর্জন। মোর্সাটেরও এমনই হয়েছে।
Comments