১০ম মৃত্যুদিন

‘তিতাশ চৌধুরীর মতো লেখকদের মূল্যায়ন না হওয়া সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা’

তিতাশ চৌধুরী, ছবি: পরিবার থেকে সংগৃহীত

তিতাশ চৌধুরীর মতো লেখকদের মূল্যায়ন না হওয়া আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা। তিনি ঢাকার বাহিরে থাকতেন কিন্তু দেশের মূল সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করতেন। তার অলক্ত পুরষ্কার আমিসহ অনেকে পেয়েছে, সাহিত্য সমাজে হয়েছেন এর মাধ্যমে পরিচিত। তার লেখা পাঠে আমিও উপকৃত হয়েছি।

আজ কবি ও শিক্ষাবিদ তিতাশ চৌধুরীর ১০ম মৃত্যুদিন প্রসঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী উল্লেখিত কথাগুলো বলেন। তিতাশ চৌধুরী ২০১৪ সালে ২ ডিসেম্বর ঢাকায় নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন। তিনি ১৯৪৫ সালের ১৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদরে সিন্দুরউরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে কবি, সম্পাদক, গবেষক ও অনুবাদক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।

তিতাশ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হন। বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনার পর সর্বশেষে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। 

১৯৭২ সাল থেকে সম্পাদনা করেন সাহিত্য পত্রিকা অলক্ত। এই নামে পুরষ্কারও চালু করেন। অলক্ত পত্রিকা প্রায় ৪৫টি সংখ্যা প্রকাশ করেন এবং ১৯৮১ সাল থেকে অলক্ত স্বর্ণ পদক চালু করেন। এতে দেশের পঞ্চাশের অধিক কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক পুরস্কৃত হয়েছেন। কিন্তু এক জীবনে তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়িত হন নাই। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, দেশের অনেক কবি সাহিত্যিকদের অলক্ত পুরষ্কারকে ঘিরে আনন্দের স্মৃতি আছে। আছে তাঁর কাগজে লেখার প্রেরণা। তার রচনা ও সম্পাদনা পাঠে আগ্রহ তৈরি করে। এমন গুণীজনদের মূল্যায়ন না হওয়া সমাজের পশ্চাদগামী ইঙ্গিত করে। আমি তার মূল্যায়ন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানাই। 

তিতাশ চৌধুরী শিক্ষকতা ও সম্পাদনার পাশাপাশি বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িক পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫০ এর অধিক। কবিতার মধ্যে রয়েছে দুঃস্বপ্নের রাজকুমারী, তুমি সুখেই আছো নন্দিনী, তোমাদের জন্য ভালোবাসা। গবেষণা ও সাহিত্যালোচনার মধ্যে রয়েছে নিষিদ্ধ নজরুল ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, জসীমউদ্দীন : কবিতা, গদ্য ও স্মৃতি, মোতাহের হোসেন চৌধুরী : জীবন ও সাহিত্য, কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতি প্রেম ও পরিণয়, নজরুলের নানাদিক, অন্য বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ, অন্যরকম রবীন্দ্রনাথ, কুমিল্লার সংবাদপত্র ও সাময়িকী, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের জনক মেজর আব্দুল গণি : জীবন ও কর্ম ভুবন, আমাদের মুক্তিসংগ্রামে নজরুল সঙ্গীতের ভূমিকা, উনিশ শতকের সাময়িকপত্র ঊষায় জীবন ও সমাজ, কুমিল্লা জেলার লোকসাহিত্য, দরবেশ ও দরগার কথা, বৈশাখ ও আমাদের ঐতিহ্য চেতনা, লোকসাহিত্যের নানাদিক ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস' উল্লেখযোগ্য। স্মৃতিকথা বিষয়ক বই দেখা অদেখার স্মৃতি।

ছবি: অলক্ত তিতাশ চৌধুরী সংখ্যা থেকে।

শিশুসাহিত্যের মধ্যে রয়েছে ষাটগম্বুজের আযান ধ্বনি, রসহস্যময় বাড়ি, শেকড়ের সন্ধানে, বিন্নি ধানের খই, তা ধিন ধিন। অনুবাদ বই হচ্ছে ত্রিবেণী ও অন্যস্বর। সম্পাদনা করেছেন আবদুর রশীদের শ্রেষ্ঠ গল্প, কুমিল্লা জেলার ইতিহাস (যৌথ), রবীন্দ্রনাথের পুনশ্চ, দ্যা ব্লুম (যৌথ), একজন কে জি মোস্তফা, লেখকের পত্রাবলি।

সম্মাননা ও পুরস্কার হিসেবে পান পশ্চিমবঙ্গ থেকে 'অলক্ত' পত্রিকা সম্পাদনার জন্য শ্রেষ্ঠ সম্পাদক হিসেবে পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ (১৯৭৮), কুমিল্লা জেলার ইতিহাস রচনা ও সম্পাদনার জন্য স্বর্ণপদক (১৯৮৪) এবং বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক ১৯৯৬ লাভ করেন।

তিতাশ চৌধুরী কবিতায় উপমা-রূপক-চিত্রকল্পের ব্যবহারে একধরনের স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। ভিন্নতার সৃষ্টির মাধ্যমে আধুনিক বাংলা কাব্যে রং ও কল্পনার বিন্যাসে অভিনবত্ব সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। কবিতার বইতে দেখা যায় কবিতায় ব্যক্তিগত অনুভূতির অন্তরঙ্গ প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এক কথায় প্রেম ও প্রকৃতিকে আশ্রয় করে তিতাশ চৌধুরী অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। মৃত্যুর পূর্বে কয়েক বছর নানা রোগে আক্রান্ত থাকলেও পরিণত বয়সে জীবনের শেষাবধি তিনি সাহিত্য চর্চায় পরিপূর্ণরূপে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এখনো তার বহু সংখ্যক গ্রন্থ অপ্রকাশিত রয়েছে।

তার সহধর্মিণী অধ্যাপক রাশিদা তাহির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তিতাশ চৌধুরী সারাজীবন সাহিত্য সমাজকে দিয়ে গেছেন, কখনো নেওয়ার কথা ভাবেননি। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অলক্ত পুরষ্কার দিয়েছেন, তারাও কোনদিন তার অবদানের কথা যথাযথভাবে বলেননি না নজরে আনেননি। অথচ তাঁর সাহিত্য সংস্কৃতি ও সম্পাদনার ভূমিকা নিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।

তার স্বীকৃতির বিষয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, হ্যাঁ, তিতাশ চৌধুরীকে চিনতাম। কিছু বই পড়েছি। তার মতো অনেকে পুরষ্কার পাননি। এখন আর কি করা যাবে, যারা দেওয়ার তারা দেননি।

Comments

The Daily Star  | English

The consensus to keep women out

The project of egalitarianism cannot be subcontracted to the very custodians of inequality.

8h ago