‘মেমসাহেব’ স্রষ্টার মৃত্যুদিন

জনপ্রিয়তা কি মন্দ কিছু?

‘মেমসাহেব’ কি লেখকের আত্মজৈবনিক উপন্যাস? হবে হয়তো। সকল লেখায় নাকি লেখকের আত্মজৈবনিক লেখা, সত্যিই কি তাই?
নিমাই ভট্টাচার্য (১০ এপ্রিল ১৯৩১ - ২৫ জুন ২০২০)

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরে বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক নিমাই ভট্টাচার্য। ২০২০ সালে আজকের দিনে চুকে যায় তার ইহজাগতিক পর্ব। বিশেষ করে 'মেমসাহেব' উপন্যাসের জনপ্রিয়তা পৌঁছেছিল কিংবদন্তীর পর্যায়ে। আজও বোধ করি রয়েছে কিছুটা রেশ। এরকম একজন ঔপন্যাসিকের মৃত্যুদিন নীরবে-নিভৃতে পার হয়ে যাচ্ছে, ব্যাপারটা কেবল বিস্ময়ের নয়, ভাবনারও। এটা কি জনপ্রিয়তার রুঢ় বাস্তবতা? 

এ ধরণের লেখকদের ক্ষেত্রে একটা সত্য কখনও উপেক্ষণীয় নয়। যদি তাদের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে, কিংবা একবার শেষ হয়ে যায়, তা হলে উনারা হারিয়ে যান। কিন্তু এর ব্যতিক্রম হলে, টিকে যান কালান্তরের হাত ধরে। লম্বা সময় পর্যন্ত জানান দেন নিজেদের অস্তিত্ব ও সোনা ফলানো ঐশ্বর্যের কথা। জনপ্রিয়দের নিজেদেরকেই সলতে জ্বালিয়ে রাখতে হয়। অন্যদের ক্ষেত্রে সময় জ্বালিয়ে রাখে অথবা, পাঠকই মাঝে মাঝে তালাশ করে জ্বালিয়ে নেন। এ কারণে জনপ্রিয়দের হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি যতটা থাকে, অন্যদের ততটা নয়। নিমাই ভট্টাচার্য কি সেই ঝুঁকিতে পড়েছেন?

'মেমসাহেব' উপন্যাসের সঙ্গে আমার স্মৃতি ও সখ্য একেবারে স্বতান্ত্রিক ও অন্যরকম। পারিবারিক সংগ্রহ থেকে কৈশোর বয়সেই পাঠ করা হয় এই উপন্যাস। নিউজপ্রিন্টের কাগজে বাঁধা ও ছাপা সেই বই ছিল একেবারে হালকা পাতলা। তখন শরৎ বাবুর দাপুটে সময়। ফাল্গুনি কাঁদিয়ে চলেছেন বালিশ ভিজিয়ে। 'চিতা বহ্নিমান', আর 'শাপ-মোচন' বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে যায়। এর মধ্যে রয়েছেন যাযাবর, বিমল মিত্র, নীহাররঞ্জন, আশুতোষ, কৃষণ চন্দর প্রমুখেরা। অন্যদিকে রয়েছে সেবার বই, দস্যু বনহুর সিরিজ। আমরা যারা থ্রিলার, রহস্যোপন্যাস, তিন গোয়েন্দার অতটা ভক্ত ছিলাম না। পড়তাম কবিতার বই বলতে সুকান্তের 'ছাড়পত্র', কাজী নজরুলের কালো মলাটের 'সঞ্চিতা', রবীন্দ্রনাথের সবুজ মলাটের 'সঞ্চয়িতা'। 

মা'র পুঁথির ভাণ্ডার থেকে 'গাজী কালু চম্পাবতীর কিতাব', 'সোনাভানের পুঁথি'সহ আরও কী কী যেন। মার সংগ্রহে ছিল মীর মশাররফের 'বিষাদ সিন্ধু'। মার সংগৃহীত বইগুলো সব সাদা কাপড়ে মোড়ানো থাকত। মা কাঠের রেহালে রেখে পড়তেন সেসব। কিছু বই পড়া হয়েছিল শুনে শুনে। মার বইপাঠ শুনতে আশেপাশের মেয়েরা তো আসতেনই, মুরুব্বী চাচারাও থাকতেন হাজির। অবশ্য মুরুব্বী সেদিন বেশি থাকতো যেদিন আব্বা পাঠ করতেন। এরকমভাবে বই পাঠের ফাঁকে একদিন দেখা মিললো 'মেমসাহেব' এর। অন্যরকম এক ভাললাগায় ভরে গেল তনু মন। কিছুটা বুঁদ হয়ে গেলাম। দোলা বৌদি যেন দুলিয়ে দিল আমাকেও। মনে মনে আমি হয়ে গেলাম বাচ্চু। নিমাইয়ের ডাকনামও বাচ্চু, তিনিও রিপোর্টার। 

আচ্ছা, 'মেমসাহেব' কি লেখকের আত্মজৈবনিক উপন্যাস? হবে হয়তো। সকল লেখায় নাকি লেখকের আত্মজৈবনিক লেখা, সত্যিই কি তাই? 'মেমসাহেব' পাঠান্তে ভাবলাম, আহা আমারও যদি একজন দোলা বৌদি থাকতো, আমিও তা হলে লিখে ফেলতাম এরকম এক পত্রোপন্যাস। তখনও ভাবি আসেননি আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে। বৌদিদের রঙ্গ টের পেতাম কিছুটা-কালেভদ্রে। কিন্তু সেভাবে বুঝতাম না কিছুই। দোলা বৌদি প্রথম আমাকে বৌদিদের সম্পর্কে ভাবতে শেখাল, দৃষ্টি রাখতেও। এই প্রথম কোন বই পাঠান্তে বাস্তব আর অবাস্তবকে মেলানোর চেষ্টা আচ্ছন্ন করলো আমাকে। একজন ঔপন্যাসিকের শক্তি বুঝি এখানেই সে ঘোর লাগাতে পারে, খুলে দিতে পারে দেখার চোখ। ভাবাতে পারে চারপাশকে।

এরই মধ্যে লেখালেখি পেয়ে বসেছে আমাকে, সাংবাদিকতার প্রতি তৈরি হয়েছে প্রবল পক্ষপাত আর সীমাহীন দুর্বলতা। ব্যাপারটা টের পেয়ে গেলেন অনেকেই। যা দৃশ্যমান হল অচিরেই। আমাদের মেজবোন আমাকে একটা 'মেমসাহেব' উপন্যাস উপহার দিলেন, সম্ভবত কোন এক নব বৈশাখে। ততদিনে বইটির বাঁধাই হার্ডকভারের হয়েছে, কাগজও  নিউজপ্রিন্ট ছেড়ে সাদা। দেখতে বেশ সুন্দর। অদ্ভুত এক ভাললাগায় আপ্লুত হলাম মেজ আপার থেকে এই উপহার পেয়ে। এর আগে শরৎ, জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বই উপহার পেয়েছি। এই প্রথম পেলাম একটা উপন্যাস, তাও আবার নিমাইয়ের বিখ্যাত 'মেমসাহেব'।

আমি কি তখন অনেক বড় হয়ে গেছিলাম? বিস্ময় আরও অপেক্ষা করছিল, যখন দেখলাম কিছুদিন পর ঈদ উপলক্ষে বড়ভাই আমাকে একটা বই উপহার দিলেন। এবং সেটা আর কোনও বই নয়, নিমাইয়ের 'মেমসাহেব'। অতীতের এসব ফিরিস্তি টানার কারণ একটাই। 'মেমসাহেব' সেই সময় জনপ্রিয়তায় কতটা প্রভাববিস্তারী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল, তার গভীরতা ফিরে দেখা।

কথাসাহিত্যে 'দেবদাস' এর পরে 'মেমসাহেব' সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস। এ কেবল কথার কথা নয়, বিভিন্ন জরিপ ও জুরিবোর্ডের রায়ে উন্মোচিত হয়েছে এই সত্য। 'দেবদাস' এর সৌভাগ্য হল কেবল উপন্যাস হিসেবে নয় চলচ্চিত্রেও সে জনপ্রিয় হয়। ভারতবর্ষের একাধিক ভাষার সেলুলয়েডে ধারণ করা হয়েছে তার চলচ্চিত্ররূপ। এমনকি একই ভাষায় একাধিকবার চলচ্চিত্রায়িত হওয়ার রেকর্ডও রয়েছে তার ঝুলিতে। 'দেবদাস' এর এই চলচ্চিত্রায়ন উপন্যাসটিকে বারংবার দান করেছে পুনর্জীবন । ফলে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই উপন্যাস তার সত্তাকে রেখেছে প্রবহমান ও প্রাণময়।

'মেমসাহেব' হয়েছে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এরও চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে, সেখানেও উত্তম কুমার-অপর্ণা সেনের মতো ডাকসাঁইটে অভিনয় শিল্পীরা অভিনয়ও করেছেন। কিন্তু সেটা ওই একবারই। বারংবার চলচ্চিত্রায়িত হওয়ার মতো আবেদন 'মেমসাহেব' -এ নেই, যেটা রয়েছে 'দেবদাস'-এ। এটা কি পত্রোপন্যাসের সীমাবদ্ধতা, নাকি এর শক্তি পিনাকী মুখোপাধ্যায় পরবর্তীতে আর কেউ বুঝে উঠতে চাননি, কিংবা পারেননি।

সাংবাদিকতার সঙ্গে সাহিত্যের একটা বোঝাপড়া ও পারস্পরিক সহাবস্থানের জায়গা রয়েছে। একে অপরের পরিপূরক বলার প্রশস্তি গীতও চাউর রয়েছে একাধিক তরফে। এসব কি আদৌ সত্য, নাকি কিন্তু রয়ে গেছে? যেখানকার পালে হাওয়া দিয়েছে সিন্দাবাদের দৈত্য।

নিমাই ভট্টাচার্য সাংবাদিক ছিলেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে যেমন তিনি জনপ্রিয় ছিলেন সাংবাদিক হিসেবেও নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্যরকম এক উচ্চতায়। বিশেষ করে রিপোর্টার হিসেবে। কেবল ভারতের নয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অনেক ক্ষমতাধর ও গ্ল্যামার্স ব্যক্তির সফরসঙ্গী, সান্নিধ্য ও সখ্য পাওয়ার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিলেন। রিপোর্টারের সংবাদ লেখার মতো করে কথাসাহিত্য রচনায়ও তিনি ছিলেন সাবলীল ও গতিময়। একসঙ্গে দুটোকেই চালিয়ে নিতে পারতেন।

এসব প্রসঙ্গ নিজে হাজির করেছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে। বলা হয়, সাংবাদিকতার সঙ্গে সাহিত্যের একটা বোঝাপড়া ও পারস্পরিক সহাবস্থানের জায়গা রয়েছে। একে অপরের পরিপূরক বলার প্রশস্তি গীতও চাউর রয়েছে একাধিক তরফে। এসব কি আদৌ সত্য, নাকি কিন্তু রয়ে গেছে? যেখানকার পালে হাওয়া দিয়েছে সিন্দাবাদের দৈত্য।

সংবাদপত্রে কাজ করলেই আমরা সবাইকে সাংবাদিক বলি । কিন্তু এখানে দুটো ধারা রয়েছে। রিপোর্টার আর সাব এডিটর। রিপোর্টারের কাজ সংবাদ সংগ্রহ। আর সাব এডিটরের বা সহ সম্পাদকের কাজ সংগৃহীত রিপোর্ট বা খবরটি ছাপার উপযোগী করা। এক্ষেত্রে সহ সম্পাদককে অনেকগুলো বিষয়কে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়েই গুরু এই দায়িত্বটা সম্পাদন করতে হয়। রিপোর্টার, সাব এডিটর দু'জনেই সাংবাদিক। কিন্তু প্রকৃতার্থে দুজনের কাজের তফাৎ ও পার্থক্যটা কেমন, সেটা বোঝা গেল নিশ্চয়।

পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকদের অনেকেই সাংবাদিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, মারিও বার্গাস ইয়োসা প্রমুখ। কার্ল মার্কসও একজন সাংবাদিক। নিমাই ভট্টাচার্যও একজন সাংবাদিক। কিন্তু সাংবাদিকতার ধরনে রয়েছে যোজন যোজন ফারাক। একজন রিপোর্টারকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রতিদিনই ছুটতে হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যে, উদ্দিষ্ট সূত্রে। পায়ের তলায় সর্ষে থাকা এই দায়িত্বে থেকে আদৌ কি সম্ভব গভীরতল থেকে কিছু দেখার, পরিপার্শ্বকে গভীরভাবে বোঝাপড়া করার?

জনপ্রিয়তা কেবলই অন্দরমহলকে আবিষ্ট করলো। আমাদের জ্ঞান চর্চাকে বঞ্চিত করলো বিলোড়িত হওয়ার সম্ভাবনা ও সুযোগ থেকে। এ কারণেই কি নীরবে পেরিয়ে যাচ্ছে 'মেমসাহেব' স্রষ্টার মৃত্যুদিন?

নিমাই ভট্টাচার্য উপন্যাস লিখেছেন প্রায় দেড়শ'র মতো। লিখেছেন 'বিপ্লবী বিবেকানন্দ' নামের লেখাও। কবিতাও লিখেছেন, বেরিয়েছে কাব্যগ্রন্থও। বাঙালি জীবনের এক সময়ের বই পাঠকে রাঙিয়েছেন তিনি। 'মেমসাহেব' তো বটেই 'রাজধানী এক্সপ্রেস', 'এডিসি', 'গোধূলিয়া'র মতো উপন্যাস লিখে আমাদের বই পাঠ সংস্কৃতিকে করেছিলেন বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য।

এরকম একজন ঔপন্যাসিককে আমরা কেন ভুলে গেলাম অতি দ্রুত এবং খুব সহজেই? তা কি কেবলই জনপ্রিয় বলে? তা হলে জনপ্রিয়তা কি মন্দ কিছু, দোষ বিশেষ? তা হলে জনপ্রিয়তার পেছনে কেন ছুটছে সবাই, অশ্বগতিতে? জনপ্রিয়তার কতিপয় বৈশিষ্ট্যের কথা বললেই ব্যাপারটা মনে হয় খোলতাই হবে।

এক. জনপ্রিয়তার বৈশিষ্ট্য হল সে কেবল সময় অর্থাৎ মুহূর্তকে ধরতে ও বুঝতে চাই, কালকে নয়। ফলে, তার প্রয়োজনীয়তাও মুহূর্ত বিশেষ, কাল নিরপেক্ষ নয়। এ কারণে মুহূর্ত অর্থাৎ সমসময় শেষ হলেই তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়।

দুই. জনপ্রিয়তা হল রেসের ঘোড়া, সে কেবলই ছুটতে চায়। রেসের ঘোড়া কোন কিছু দেখে না, শুধু তার লক্ষ্য-পানে কেবলই দৌড়ায়। ফলে, তাতে সমগ্র ধরা পড়ে না, এরকম কোন কোশেশও তার মধ্যে দেখা যায় না।

তিন. জনপ্রিয়তার পেছনে ছুটতে গিয়ে শরৎচন্দ্রের মতো প্রবল প্রভাবশালী কথাসাহিত্যিকও কাল নিরপেক্ষ হয়ে উঠতে পারেননি। তিনি জীবদ্দশায় যতটা জনপ্রিয় ছিলেন এবং পরবর্তী সময়েও। বর্তমানে এসে দেখা যাচ্ছে তিনি হারিয়ে গেছেন কিংবা আড়ালে পড়ে রয়েছেন। যেটুকু আছেন উনার রাজ করার কাছে তা তুল্যমূল্যে কোন বিচারের মধ্যেই পড়ে না।

চার. ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকও হারিয়ে গেছেন। নতুন প্রজন্ম উনার নামটাও জানে কিনা সন্দেহ। কারণ তিনি সাহিত্যে জনপ্রিয়তার সাধনা করেছেন। ফলে, জনপ্রিয়তা শেষ তিনিও এখন বিস্মৃত এক নাম।

পাঁচ. জনপ্রিয়তা ক্ষণিকের- কথাটি জনপ্রিয়রা বুঝেননা, বুঝলেও নানারকম যুক্তি হাজির করেন। জনপ্রিয়তা মোটিভেশনাল স্পিকারের বক্তব্যের মতোই। তার তাৎক্ষণিকতা ভাল লাগে, আদতে কোন কাজের কিছু নয়।

নিমাই ভট্টাচার্য 'মেমসাহেব' লিখে যেভাবে হাত মকশো করেছিলেন, চাইলে পরবর্তীতে সোনা ফলাতে পারতেন। তাতে দেশ, জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতি উপকৃত হতো। যে পাঠক একবার বুঁদ হয়েছিলেন দোলা বৌদি আর বাচ্চুর রসায়নে তারা বৃহৎ এক আকাশ দেখার সুযোগ পেতেন। কিন্তু জনপ্রিয়তা কেবলই অন্দরমহলকে আবিষ্ট করলো। আমাদের জ্ঞান চর্চাকে বঞ্চিত করলো বিলোড়িত হওয়ার সম্ভাবনা ও সুযোগ থেকে। এ কারণেই কি নীরবে পেরিয়ে যাচ্ছে 'মেমসাহেব' স্রষ্টার মৃত্যুদিন?

Comments