কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনের আম ‘গৌরমতি’

'গৌরমতি বিক্রিই শুরু হয় ৬ হাজার টাকা থেকে এবং শেষ হয় ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা মণ পর্যন্ত।'
গৌরমতি আম। ছবি:সোহেল রানা

নাবি জাতের আমের মধ্যে গৌরমতি আমের স্বাদ, মিষ্টতা এবং ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকরা এখন এই আম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। যারা গৌরমতি চাষ করেছেন তারা অন্যান্য জাতের আমের চেয়ে ৪-৫ গুণ বেশি দামে বিক্রি করছেন বলে জানিয়েছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গৌরমতি প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভাবিত একটি নতুন জাত যা ২০১২ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম পাওয়া যায়।

বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী এবং নাটোরে এই আমের চাষ স্বল্প পরিমাণে সম্প্রসারিত হয়েছে। গৌরমতি সাধারণত আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ১ মাস ধরে বাজারে পাওয়া যায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে এ বছর নওগাঁ জেলায় আমের চাষ হয়েছে ৩০ হাজার হেক্টর। গৌরমতি আমের আবাদ হয়েছে ১৪৫ হেক্টর।

নওগাঁ সাপাহার উপজেলার আম চাষি সোহেল রানা গৌরমতির চাষ করেছেন ৩৫ বিঘা জমিতে। গত বছর তিনি ফল পেয়েছিলেন ৩০০ মণ। 

লাভজনক হওয়ায় বাগানে গৌরমতি আম চাষ বাড়িয়েছেন কৃষকেরা।

সোহেল রানা বলেন, 'আমের মৌসুমে আমের দাম থাকে প্রতি মণ ১২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু গৌরমতি বিক্রিই শুরু হয় ৬ হাজার টাকা থেকে এবং শেষ হয় ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা মণ পর্যন্ত। অর্থাৎ এই আম চাষে কৃষক চার থেকে ৫ গুণ বেশি লাভ করতে পারছে।'

'অন্যদিকে যেকোনো আমের চেয়ে গৌরমতি আমের ফলন আমরা এই পর্যন্ত বেশি পেয়েছি। এক বিঘা জমিতে আমরূপালী, লেংড়া, খিরসা, হিমসাগর সাধারণত ৫০- থেকে ৬০ মণ ফলন দেয় কিন্তু গৌরমতির ফলন বিঘা প্রতি ৭০ থেকে ১০০ মণ পর্যন্ত হচ্ছে।'

'তবে যেহেতু এই আম বাগানে দীর্ঘ সময় ধরে থাকে এবং ব্যাগিং করতে হয় তাই বিঘা প্রতি খরচ অন্য আমের চেয়ে ১০ হাজার টাকা বেশি হয়', বলেন সোহেল।

গৌরমতি আম ব্যাগিং করতে হয়। তাই দাম বেশি পড়ে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের (আম গবেষণা কেন্দ্র নাম পরিচিত) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. কামরুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশে সাধারণত আমের মৌসুম মে থেকে জুলাই এ শেষ হয়। এর পরে নাবী জাতের আম বারি-৪ দিয়ে শুরু হয়। সর্বশেষ আশ্বিনা আম সেটাও শেষ হয় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে কিন্তু গৌরমতি বারি আম -১২ থাকে সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ পর্যন্ত। বাজারে ১ মাসের বেশি সময় ধরে থাকে এই গৌরমতি। অন্য কোনো আম এত সময় ধরে থাকে না।'

'গৌরমতির সাথে সাথে কাটিমন আমও বাজারে থাকে তবে সেটা খুব কম। এবং গৌরমতির মতো খেতে এত সুস্বাদু নয়। এই আম রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনা আছে,' বলেন কামরুল ইসলাম।

অনেকে মনে করেন বেশি মিষ্টতা এবং বেশি দামের জন্য এই আম রপ্তানির সম্ভাবনা কম।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশে নাবি জাতের আমের উৎপাদন ভালো হওয়ায় গত তিন-চার বছর ধরে আম আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত ভালো আম বাজারে থাকে ৬ মাস।'

'আগে এই সময় থাইল্যান্ড থেকে কিছু আম আমদানি করা হতো কিন্তু বেশি আমদানি শুল্ক দিয়ে আনা সেই আম আমাদের নিজেদের আমের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। বরং এ বছর পরিমাণে দ্বিগুণ আম আমরা রপ্তানি করেছি।'

বিশেষ পদ্ধতিতে নাবি জাতের আম চাষ করে খ্যাতি অর্জন করেছেন নওগাঁর পোরশা উপজেলার আম চাষি মো. রায়হান সিদ্দিক। এ বছর তিনি গৌরমতির চাষ করেছেন ৮০ বিঘা জমিতে। রায়হানের অনেক বাগান নতুন যে কারণে ফলন বেশি পাননি।

রায়হান বলেন, 'এ বছর খরার কারণে আমার আমের ফলন অর্ধেকে নেমে এসেছে। বাগান নতুন হওয়ায় প্রতি বিঘায় আমি ফলন পেয়েছি গড়ে ৪০ মণ। সর্বশেষ গত সপ্তাহে আম বিক্রি করেছি ৮৪০০ টাকা মণ।'

রায়হান বলেন, 'কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনের আমের নাম গৌরমতি। নতুন কৃষকদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে যদি আম চাষের জগতে ঠিক থাকতে চান তবে গৌরমতি আম অবশ্যই চাষ করতে হবে।'

নওগাঁর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দাম ভালো পাওয়ার কারণে কৃষকরা এখন নাবি জাতের আম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। লেট ভ্যারাইটির মধ্যে বারি-১১, বারি-৪, কাটিমন এবং গৌরমতি উল্লেখযোগ্য। তবে এসবের মধ্যে গৌরমতি বেশি সুস্বাদু এবং ফলন ভালো বলে দামও সবচেয়ে বেশি। সেকারণে এই আমের চাষ এখন গোটা জেলায় সম্প্রসারণ হচ্ছে।'

এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে মোট আমের আবাদ হয়েছে ৩৭ হাজার ৫৮৮ হেক্টর। নওগাঁর বাইরে এই জেলায় এ বছর গৌরমতি আমের চাষ হয়ে ১২৮ হেক্টর।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার আম চাষি রফিকুল ইসলাম। তিনি গোমস্তাপুর এবং নাচোলে প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে গৌরমতির চাষ করেছেন। ২০১৪ সালে প্রথমে তিনি পরীক্ষামূলক কিছু জমিতে এই আমের আবার করেন। ২০১৯-২০ সালে তিনি প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে এই আমের বাগান গড়ে তোলেন।

রফিকুল বলেন, 'এ বছর নতুন বাগানে বিঘায় ৩০ মণ এবং পুরোনো বাগানে ৬০ মণ আম পেয়েছেন। খরার কারণে এবার উৎপাদন কম হয়েছে তবুও এ বছর আমি প্রায় ২৫০০ মন গৌরমতি আম বিক্রি করেছি। গড়ে ৮ হাজার টাকা মণ আম বিক্রি করেছি। অন্য যেকোন আমের চেয়ে এই আমে অনেক বেশি লাভ, 'বলেন রফিকুল ইসলাম।

এই আম চাষে খরচ কেমন জানতে চাইলে রফিকুল জানান, 'প্রতি বিঘায় খরচ-৬০-৮০ হাজার টাকা। ব্যাগিং করতে হয় বলে এই আমের খরচ একটু বেশি। তবে এই আমে অন্য জাতের তুলনায় রোগ ব্যাধিও বেশি হয়। নতুন যারা এই আম চাষ করতে চান তাদের জন্য পরামর্শ হলো আগে অল্প করে চাষ করে এই আম সম্পর্কে ভালো ধারণা নিতে হবে। পরে বাগান সম্প্রসারণ করলে সফল হবেন।'

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. পলাশ সরকার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গৌরমতি আমাদের একটি স্থানীয় জাত। এটি প্রাকৃতিকভাবে হাইব্রিডেশন হয়েছে। এটি মূলত লেংড়া এবং আশ্বিনা আমের সংমিশ্রণ। চাঁপাইনবাবগঞ্জে যেহেতু আমের অনেক জাত সেই জন্য প্রাকৃতিকভাবে পরাগায়নের মাধ্যমে এই জাতের উদ্ভব হয়।'

'২০১২ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে এই জাতের উদ্ভব। তার পরে সারা দেশে এই আমের সম্প্রসারণ হয়েছে। পরে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এই আমাদের নাম দিয়েছে বাড়ি-১২। তবে গৌরমতি হিসাবেই বেশি পরিচিত', বলেন তিনি।

বছরব্যাপী ফল উৎপাদনে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. মেহেদী মাসুদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১২ সালে এই জাত শনাক্তের পরে আমরা নানাভাবে এই আমের চাষ সম্প্রসারণ করি। ২০১৫-১৬ সালে আমরা বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মধ্যে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৫০ হাজার ছাড়া উৎপাদন করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিই। এখন পর্যন্ত দেশে প্রায় ৫০০০ হেক্টর জমিতে এই আমের চাষ হয়েছে।'

এই আমে পোকা এবং রোগব্যাধি বিষয়ে মেহেদী মাসুদ বলেন, 'এই আমের গায়ে এক ধরনের ছোট ছোট ছিদ্র রয়েছে যার মাধ্যমে বাইরে থেকে খুব সহজেই রোগ-জীবাণু এই আমে প্রবেশ করতে পারে। সেই কারণে এই জাতের আমের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।'

বাংলাদেশ গবেষণা ইন্সটিটিউট এই আমের নাম দিয়েছে বারি আম-১২। নতুন করে নাম দেওয়ার আগে এই দুই জাতের আমের ক্রসিং করিয়ে গৌরমতির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া যেত বলে পরামর্শ দেন এই কৃষিবিদ।

জানতে চাইলে মো. কামরুল ইসলাম বলেন, 'বারি আম -১২ এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গত বছর থেকে আমরা গবেষণা করছি এবং নানা রকম জাতের সাথে এর ক্রসিং করছি।'

Comments