বাড়ছে ভুট্টার উৎপাদন, কমছে আমদানি নির্ভরতা

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার চর সানিয়াজানে ভুট্টা তুলছেন চাষিরা। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

দেশে প্রতিবছরই ভুট্টা উৎপাদন বাড়ছে। গত ১০ বছরে ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। ফলে বিদেশ থেকে ভুট্টা আমদানি কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশি মুনাফা ও আবাদ পদ্ধতি সহজ হওয়ায় কৃষকেরা ভুট্টাচাষে ঝুঁকছেন। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর ভুট্টার দাম কম হওয়ায় হতাশ চাষিরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুসারে, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ভুট্টা উৎপন্ন হয়েছিল ২৭ লাখ টন। জমির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৯০ হাজার হেক্টর।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্খবছরে দেশে ভুট্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭১ লাখ ৬০ হাজার টন। ভুট্টাচাষ হয়েছে ছয় লাখ ৫১ হাজার হেক্টর জমিতে। গত অর্থবছরে ৬৮ লাখ ৮৪ হাজার টন ভুট্টা উৎপাদন হয়েছিল ছয় লাখ ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে। দেশে ভুট্টার চাহিদা ৭০-৭৫ লাখ টন।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গেল বছর চার লাখ টন ভুট্টা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে। এ বছর আমদানি নির্ভরতা আরও কমবে। যতদিন পর্যন্ত চাহিদামতো ভুট্টা উৎপন্ন না হবে ততদিন চাষ বাড়াতেই হবে।'

আগামী দুই থেকে তিন বছর পর বিদেশ থেকে ভুট্টা আমদানি করতে হবে না, বলে মনে করেন তিনি।

তার মতে, 'ভুট্টার উৎপাদন বেশি হলে ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গেলে দেশের বাজারে ভুট্টার দাম কমতে পারে। তবে ভুট্টার নির্দিষ্ট বাজারদর থাকা দরকার। এতে কৃষকরা উপকৃত হবেন।'

দেশে ভুট্টা উৎপাদনে শীর্ষ ১০ জেলা হচ্ছে—লালমনিরহাট, দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঠাকুরগাঁও, রংপুর, পঞ্চগড়, নীলফামারী, ঝিনাইদহ, জামালপুর ও গাইবান্ধা। দেশের উত্তরাঞ্চলেই ভুট্টাচাষ হয় বেশি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে—রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফামারীতে এ বছর ভুট্টাচাষ হয়েছে এক লাখ ৪৭ হাজার ৪৫৯ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ লাখ ৬০ হাজার টন। প্রায় ৫০ শতাংশ ভুট্টা উৎপন্ন হচ্ছে চর এলাকায়।

লালমনিরহাট জেলার ব্র্যান্ডিং ফসলের নাম ভুট্টা। এ জেলায় এ বছর ভুট্টাচাষ হয়েছে ৩৯ হাজার ৫০৫ হেক্টর জমিতে। অধিকাংশ ভুট্টা চাষ হয় তিস্তার বালুচরে। ভুট্টাচাষ তিস্তাপাড়ের চাষিদের সচ্ছলতা এনেছে।

রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণত দেশে রবি বা শীত মৌসুমে ভুট্টাচাষ বেশি হয়। অক্টোবর-নভেম্বরে কৃষকেরা ভুট্টার বীজ রোপণ করেন। মার্চ-এপ্রিলে সেই ভুট্টা মাড়াই হয়। রবি মৌসুমে বেশি চাষের কারণ হলো, সে সময় আবহাওয়া ও জমি ভুট্টাচাষে উপযোগী থাকে। সাথী ফসলও করা যায়। অবশ্য খরিফ মৌসুমেও ভুট্টা চাষ হয়। তবে ফলন কম পাওয়া যায়।'

তার ভাষ্য, 'গমের তুলনায় ভুট্টা চাষে মুনাফা বেশি। এতে কম পরিচর্যা লাগে। উঁচু জায়গায় চাষ করা যায়। ফলন বেশি হয়। মাড়াই প্রক্রিয়াও বেশ সহজ। এ ছাড়াও, একই জমিতে সাথী ফসলও হয়। মূলত এসব সুবিধার কারণেই কৃষকেরা ভুট্টা চাষে এখন বেশি আগ্রহী।'

কৃষকেরা ডেইলি স্টারকে জানান, প্রতি বিঘায় ভুট্টাচাষে খরচ হয় ১৪-১৬ হাজার টাকা। জমি ইজারা নেওয়া বা অন্যান্য কারণে খরচ কমবেশি হতে পারে। সাধারণত এক বিঘা জমি থেকে ৩৫-৪৫ মন ভুট্টা পাওয়া যায়। প্রতি মন ভুট্টা কৃষকেরা এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি করেন। বিঘাপ্রতি তাদের ২৮-৩৪ হাজার টাকা মুনাফা থাকে।

লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও দিনাজপুরের কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে—গত বছরের তুলনায় এ বছর ভুট্টার দাম কম। গত বছর তারা প্রতি কেজি ভুট্টা বিক্রি করেছিলেন ৩০-৩২ টাকায়। এ বছর তা বিক্রি করতে হচ্ছে ২৮-২৯ টাকায়। এ বছর বেশি জমিতে ভুট্টাচাষ ও উৎপাদন প্রচুর হওয়ার কথা বলে ভুট্টা ব্যবসায়ীরা কম দামে ভুট্টা কিনছেন।

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার চর সানিয়াজানের কৃষক সহিদার রহমান (৬০) গত ১৫ বছর ধরে তিস্তার চরে দশ বিঘা বালু জমিতে ভুট্টাচাষ করছেন। ভুট্টাচাষের আগে এ জমিতে ফসল তেমন ফলতো না। প্রতিনিয়ত দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হতো তাকে। ভুট্টাচাষ শুরু করায় তার সংসারে সচ্ছলতা এসেছে।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় ১৫ বিঘার মধ্যে আট বিঘা জমির ভুট্টা মাড়াই করেছি। প্রতি বিঘায় ভুট্টার ফলন পেয়েছি ৪৩ মন। আমার ১৫ বিঘা জমিতে ভুট্টাচাষ করতে খরচ হয়েছে দুই লাখ আট হাজার টাকা।'

এই চরে ২৪০ পরিবারের সবাই ভুট্টাচাষ করে সচ্ছলতা এনেছে বলেও জানান তিনি।

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার তিস্তার চর ভোটমারী এলাকার কৃষক আফিয়ার রহমান (৬৫) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত বছরের তুলনায় এ বছর কেজিপ্রতি দুই থেকে তিন টাকা কম পাচ্ছি। এ জন্য হতাশ। গত বছরের মতো ভুট্টার দাম পেলে আরও বেশি মুনাফা হতো।'

তিনি বালুচরে আট বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করে পেয়েছেন ৩২৬ মন। খরচ হয়েছে এক লাখ ২৮ হাজার টাকা।

কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ভুট্টার পাইকার জামিলুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি কেজি ভুট্টা ২৭-২৮ টাকায় কিনে ফিড মিলে দিচ্ছি ২৯ টাকায়। পরিবহন খরচ বাদ দিলে আমরা খুব বেশি মুনাফা করতে পারছি না। এ বছর ভুট্টা চাষের জমি বেড়েছে। উৎপাদনও হয়েছে বেশি। বাজারে ভুট্টার সরবরাহ অনেক। এ কারণে কৃষকেরা কম দামে ভুট্টা বিক্রি করছেন।'

লালমনিরহাটের ভোটমারী এলাকার ভুট্টার পাইকার বাবলু মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চর থেকে ভুট্টা কিনে আনতে পরিবহন খরচ অনেক। চরের কৃষকদের কাছ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে ভুট্টা কিনছি। ফিড মিলে তা বিক্রি করছি ২৯ টাকা দরে। ভুট্টার ফলন এবার ভালো। মনে হচ্ছে, ভুট্টার দাম আরও কমবে।'

আফতাব ফিড মিলের ভুট্টা ক্রয় প্রতিনিধি আজিজার রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা পাইকার ও কৃষকদের কাছ থেকে ভুট্টা কিনছি। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দামের সামঞ্জস্য রেখেই ভুট্টা কিনছি। আন্তর্জাতিক বাজারে ভুট্টার দাম বাড়লে দেশের কৃষকরা বেশি দামে ভুট্টা বিক্রি করতে পারবেন। আমরা বিদেশ থেকে ভুট্টা আমদানির তুলনায় দেশে উৎপাদিত ভুট্টা কেনায় প্রাধান্য দিই।'

রংপুরের প্রাণিখাদ্য উৎপাদনকারী (ফিড প্রডিউসার) আফজাল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেশি পরিমাণে ভুট্টা উৎপাদন হয় এমন এলাকায় ফিড প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব সংগ্রহকেন্দ্র আছে। এখানে কৃষক ও পাইকারের কাছ থেকে ভুট্টা কেনা হয়। যেহেতু আমাদের জমি কম, সেহেতু আমদানি নির্ভরতা থাকবেই। দেশে ভুট্টার উৎপাদন বাড়লে দাম স্থিতিশীল থাকতে পারে। তবে বর্তমানে ব্যাংক সুদের হার, পরিসেবা ও অন্যান্য খরচ বেড়েছে এ কারণে ভুট্টা উৎপাদন বাড়লেও ফিডের দাম কমবে বলে মনে হয় না।'

বাংলাদেশ মেইজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র বাইস প্রেসিডেন্ট মিজানুর হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একসময় আমরা ভুট্টার বাজারদরটা নিয়ন্ত্রণ করতাম। তখন কৃষকরা ভুট্টার ন্যায্য দাম পেতেন। এখন ফিড মালিকরা সিন্ডিকেট করে ভুট্টার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন।'

'এখন আর আমরা ভুট্টার বাজারদর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এটা সত্য আন্তর্জাতিক বাজারে ভুট্টার দাম কম হলে এখানে এর প্রভাব পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমেছে। এটা ভুট্টার ওপর প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়াও, এ বছর ভুট্টা চাষের জমি ও উৎপাদন বেড়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Govt employees to get dearness allowance

The announcement may come in next budget

1h ago