শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিদেশে বসে ঢাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে
দেশের বাইরে বসেই বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি শীর্ষ সন্ত্রাসী দেশে তাদের অপরাধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন শহরে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে তারা তাদের নেটওয়ার্ক সক্রিয় রেখেছেন।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১ ডজনেরও বেশি শীর্ষ সন্ত্রাসী কয়েক দশক আগে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এবং তাদের অনেকেই বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। সরকারি অফিসের দরপত্র মাস্তানি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায়ের ঘটনায় প্রায়ই তাদের নাম শোনা যায়।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজ শিক্ষার্থী প্রীতি হত্যাকাণ্ডে জিসান আহমেদ ও জাফর আহমেদ মানিকের নাম সামনে আসে।
২০০৩ সালে মালিবাগের একটি হোটেলে গোয়েন্দা বিভাগের ২ কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যার পর সবার নজরে আসেন জিসান। তার বিরুদ্ধে ৬ জনকে হত্যার অভিযোগে ৮টি মামলা রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রায় ১ যুগ আগে ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর একটি তালিকা প্রকাশ করে। এই তালিকায় নাম রয়েছে জিসানের। সরকার এই সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে সহায়তা করতে পারে এমন যেকোনো তথ্যের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
মতিঝিলের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন মানিক। পুলিশ জানিয়েছে, তিনি ভারতে পালিয়ে যান এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন।
জিসান ও মানিক ছাড়াও, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, সুব্রত বাইন, খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, মোল্লা মাসুদ, নবি হোসেন, আমিনুর রাসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগরও এই ২৩ জনের তালিকায় আছেন। তাদের কয়েকজন ইন্টারপোলের লাল তালিকাতেও আছেন।
এই ২৩ সন্ত্রাসী ছাড়াও বিকাশ কুমার বিশ্বাস, নরোত্তম সাহা আশিক, শাহিন শিকদার, শাহাদাত হোসেন, রবিন, সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল, ডালিম ও মেহেদী দেশের বাইরে থেকে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে জানা যায়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) এক কর্মকর্তা জানান, বিদেশে বসে তারা চাঁদা দাবি করার পর কেউ যদি তা দিতে না চান, তাহলে তাদের স্থানীয় অনুগত সন্ত্রাসীরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে।
এই শীর্ষ সন্ত্রাসীরা যখন কোনো ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি করে ফোন করেন, কেউ তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানোরও সাহস পান না। বরং তারা চুপচাপ চাঁদার টাকা পরিশোধ করেন বলে জানান পুলিশের কর্মকর্তা।
পুলিশ ও র্যাবের যেসব কর্মকর্তা বহু বছর ধরে সন্ত্রাসদের ওপর নজর রাখছেন, তারা জানান, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ঢাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ প্রভাবশালীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। এমনকি, অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি দেশের বাইরে অপরাধীদের সঙ্গে দেখাও করে আসেন।
পুলিশের সূত্র জানায়, এই সন্ত্রাসীদের গতিবিধি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য না জানার কারণেই মূলত তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কর্মকর্তারা আরও জানান, ভিপিএনের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করার কারণে তাদের অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে এই সন্ত্রাসীদের বায়োমেট্রিক তথ্যও নেই। ফলে তাদেরকে বাংলাদেশি সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমাণ করার ক্ষেত্রেও তারা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে জানান কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশে ইন্টারপোলের ফোকাল পয়েন্ট ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) এক কর্মকর্তা জানান, তদন্তকারী সংস্থা বিদেশে সন্ত্রাসীদের গতিবিধি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারে না।
র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, তারা বিদেশে বাংলাদেশি সন্ত্রাসীদের ওপর নজরদারি করতে পারেন না। তাদেরকে সংশ্লিষ্ট দেশের সহায়তা নিতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, অনেক ক্ষেত্রেই দেশগুলো সহায়তা করতে খুব একটা আগ্রহী হয় না।
কর্মকর্তারা জানান, সন্ত্রাসীরা প্রযুক্তির সহায়তায় একটি তৃতীয় দেশের ফোন নম্বর থেকে কল করেন।
'উদাহরণস্বরূপ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থানরত একজন অপরাধী ভিপিএনের মাধ্যমে নেপালের একটি নম্বর থেকে ফোন করেন। ফলে তাদেরকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে', যোগ করেন তিনি।
কিছু কর্মকর্তা জানান, পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বিত ও দ্রুত উদ্যোগের অভাবে গ্রেপ্তারের পরেও এই সন্ত্রাসীদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না।
উদাহরণ হিসেবে ঢাকার ডিবি ও এনসিবির ২ কর্মকর্তা জানান, ২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে জিসানকে ইন্টারপোল গ্রেপ্তার করলেও তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়নি।
কর্মকর্তারা জানান, পুলিশের সদর দপ্তর সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে জিসানকে দেশে ফেরানোর জন্য একটি পুলিশ দল পাঠাতে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে দ্রুত অনুমোদন চায়।
কিন্তু জিসানকে ফেরাতে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র পেতে বেশ কিছুদিন লেগে যায়।
ডিবির এক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জানান, 'আমরা ছাড়পত্র পাওয়ার কয়েকদিন আগে জিসান আমিরাতের একটি আদালত থেকে জামিন পান। আমরা যদি সেখানে পৌঁছে আদালতের কাছে তার অপরাধের প্রমাণ দেখাতে পারতাম, তাহলে তাকে ফিরিয়ে আনা যেতো।'
জিসানের ভারতীয় পাসপোর্টের অনুলিপিতে দেখা গেছে, তিনি তার নাম বদলে আলি আকবর চৌধুরী করেছেন। যাচাই না করা এই অনুলিপিতে দেখা যায়, ১৯৭২ সালের ১৫ জুন তিনি আসামের শিলচর, কাচরে জন্ম নিয়েছেন।
ডিবির কর্মকর্তারা জানান, তার কাছে এখন ডমিনিকান প্রজাতন্ত্রের একটি পাসপোর্ট ও দুবাইতে বসবাস করার অনুমতি বা রেসিডেন্ট পারমিটও রয়েছে।
মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় নাম আসার পরই মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যান খন্দকার তানভীর ইসলাম জয়। জানা যায়, ২০০৩ সালের কোনো এক সময় তিনি কলকাতায় পৌঁছান এবং পরবর্তীতে মো. তারেক রানা নামে দেশটির নাগরিকত্ব নেন।
ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে অবাধে যাতায়াত করতে থাকেন। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ফোন করে বড় অংকের চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
২০০৬ সালের ১৪ মে তার অধীনস্থ সন্ত্রাসীরা রাজধানীর হাতিরপুলে অবস্থিত একটি মানবসম্পদ নিয়োগ সংস্থার কার্যালয়ে জোর করে ঢুকে ২ কর্মকর্তাকে হত্যা করে এবং অপর ৪ জনকে গুরুতর আহত করে। তাদের অপরাধ, সংস্থাটির মালিক ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
কানাডায় ব্যবসা রয়েছে জয়ের। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাকে গ্রেপ্তারে অনুরোধ জানানো হলে কানাডিয়ান রয়্যাল পুলিশ জয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে, তিনি 'বাংলাদেশি অপরাধী জয়' পরিচয় লুকিয়ে নিজেকে ভারতের নাগরিক তারেক রানা হিসেবে প্রমাণ করে ছাড়া পান।
'সেভেন স্টার' গ্রুপের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মাসুদ মোল্লাকে ভারতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানা যায়। ২ দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তি থাকলেও, আজও তাদেরকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ধারাবাহিক অভিযানের কারণে অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ফৌজদারি মামলার তদন্ত ও অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদে আমরা দেশের বাইরে থেকে অপরাধের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে পেরেছি।'
তিনি জানান, কোনো অপরাধের সঙ্গে এসব সন্ত্রাসীদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে পারলে পুলিশ সদর দপ্তরকে ইন্টারপোলে খবর দেওয়া বা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করেন তারা।
এনসিবির সহকারী মহাপরিচালক মহিউল ইসলাম জানান, বিভিন্ন দেশের এনসিবির সঙ্গে বাংলাদেশের এনসিবি সবসময় অভিযুক্তদের অপরাধের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান করছে, যাতে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়।
এ ছাড়া, অভিযুক্ত পলাতক আসামিদের বন্দি বিনিময় চুক্তি অথবা এমএলএ (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট) চুক্তির আওতায় ফিরিয়ে আনা হয়, যোগ করেন তিনি।
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments