‘তুলে নেওয়ার’ ৬ বছরেও খোঁজ মেলেনি নরসিংদীর ৪ আ. লীগ নেতা-কর্মীর

তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে চূড়ান্ত হতাশ হয়ে পড়া পরিবারের সদস্যরা এখন কেবল জানতে জান, তারা আদৌ বেঁচে আছেন কি না?
ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

প্রায় ৬ বছর আগে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার একটি গ্রাম থেকে আওয়ামী লীগের ৪ নেতা-কর্মীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ।

তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে চূড়ান্ত হতাশ হয়ে পড়া পরিবারের সদস্যরা এখন কেবল জানতে জান, তারা আদৌ বেঁচে আছেন কি না?

২০১৭ সালের ২৬ মে দুপুর আড়াইটার দিকে রায়পুরা থানা পুলিশের একটি দল তাদের আটক করে উপজেলার বাঁশগাড়ী পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত ১৩ জন এই তথ্য দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন।

আটক করার পরপরই তাদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেন স্থানীয়রা। এতে পুলিশের সঙ্গে প্রাণঘাতী সংঘর্ষে অন্তত ১ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি অনেকে আহত হন।

সেদিন সন্ধ্যায় ২ জন প্রত্যক্ষদর্শী রায়পুরা থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজহারুল ইসলাম সরকারের নেতৃত্বে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে করে তাদের শেষ বারের মতো সায়েদাবাদ ফেরিঘাটের দিকে নিয়ে নিয়ে যেতে দেখেন।

আজহারুল ইসলাম বর্তমানে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আটক ৪ জনকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।

সংঘর্ষের পর পুলিশের দায়ের করা মামলায় বলা হয়, বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহ-সভাপতি রূপ মিয়াকে পুলিশ ফৌজদারি অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর স্থানীয়রা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

পুলিশের দাবি, 'নিখোঁজ' বাকি ৩ জনকে তারা কখনো আটক করেনি। এরা হলেন- ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ক্রীড়া সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. জাকির হোসেন এবং ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল ইসলাম।

তারা সবাই প্রতিপক্ষের দায়ের করা একাধিক মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন।

এদিকে 'নিখোঁজ' ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা তাদের হদিশ জানতে পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেছেন। আবেদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী বরাবর। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।

সেদিন 'তুলে নেওয়া' আজিজুলের ৮০ বছর বয়সী মা নূর জাহান বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '৫ বছর ধরে আমি আমার ছেলের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি। এখন শুধু জানতে চাই যে, সে বেঁচে আছে কি না?'

২০১৭ সালের ২৬ মে যা ঘটেছিল

আক্তার মিয়া নামের সেদিনের ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, 'আমি সেদিন মাঠে খড় গোছাচ্ছিলাম। রাস্তায় গোলমালের শব্দ শুনে এগিয়ে গিয়ে পুলিশসহ আটক ৪ জনকে দেখতে পাই।'

পুলিশ সদস্যরা পায়ে হেঁটে তাদের বাঁশগাড়ী পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শাহেদ সরকার কয়েকজন অনুসারী নিয়ে ওই ৪ জনকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান।

পুলিশ তাদের ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানালে শাহেদের সমর্থকরা তাদের থামিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করেন। এ সময় পুলিশের গুলিতে মোস্তফা নামের এক ব্যক্তি নিহত হন।

এরপর পুলিশ ৪ জনকে বাঁশগাড়ীর ফাঁড়িতে নিয়ে যায়। ফাঁড়ির কাছেও পুলিশ ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

এই ঘটনার অন্য ১২ প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকেও একই রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। এদের একজন হলেন রায়পুরা ভূমি কার্যালয়ের কর্মচারী। সংঘর্ষের পর তিনি ও এক কর্মকর্তা পরিস্থিতি দেখতে মাইক্রোবাসে করে বাঁশগাড়ী এলাকায় যান।

তিনি জানান, বাঁশগাড়ী থেকে রায়পুরা শহরে ফেরার সময় তারা দেখতে পান যে, পুলিশ একটি পিকআপ ভ্যানে করে ওই ৪ জনকে বাঁশগাড়ী ফাঁড়ি থেকে সায়েদাবাদ ফেরিঘাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, 'আমাদের মাইক্রোবাস যখন পাগলা নদী অতিক্রম করে, তখনো পুলিশের গাড়ি ফেরিঘাটে ছিল।'

ভূমি কার্যালয়ের এই কর্মচারীর ভাষ্য, আটক ৪ জনই এলাকায় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে পরিচিত। তাদের সবাইকেই তিনি স্পষ্ট চিনতে পেরেছেন। তিনি বলেন, 'এক পুলিশ সদস্য আমাদের জানান যে, তারা রাজনগর এলাকায় একটি নৌকা থেকে ৪ জনকে আটক করেছেন।'

পুলিশ ভ্যানে থাকা ৪ জনের হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা ছিল জানিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ব্যক্তি বলেন, 'তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মতো হবে। বৃষ্টি হচ্ছিল।'

২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রায়পুরায় এক জনসভায় স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু বলেন, 'রূপ মিয়ার মতো বড় নেতারা কোথায়? পুলিশ জানে কীভাবে তারা তাদের গিলে ফেলেছে।'

সে সময় রাজিউদ্দিন আহমেদের বক্তব্যের একটি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র তার বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

আটক ৪ জনের সঙ্গে পুলিশের কি হয়েছিল জানতে চাইলে এই সংসদ সদস্য বলেন, ' রূপ মিয়াসহ অন্যরা প্রথমে পুলিশের ওপর বর্শা নিয়ে হামলা করলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে কি হয়েছে জানি না।'

জনসভায় দেওয়া তার বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সেখানে এ ধরনের কোনো বক্তব্য দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।

তার দাবি, নিখোঁজ ব্যক্তিরা গুমের শিকার হয়েছেন কি না, তা খুঁজে বের করতে তিনি পরিবারগুলোকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি।

যদিও রূপ মিয়ার স্ত্রী নাসিমা বেগম ও আজিজুলের বড় ভাই হারুন মিয়া জানান, নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারের সদস্যরা রাজুর সঙ্গে তার কার্যালয়ে দেখা করে সাহায্য চেয়েছেন।

ভুয়া সাক্ষী

সংঘর্ষের একদিন পর উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাইজুল আলম বাদী হয়ে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ২০০-৩০০ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

অভিযোগে বলা হয়, পুলিশের একটি দল রূপ মিয়াকে বাঁশগাড়ী ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় তার সমর্থকরা আগ্নেয়াস্ত্র, ককটেল ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় এবং তাকে হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নেয়।

মামলায় বেশ কয়েকজন সাক্ষীর নামও উল্লেখ করা হয়।

তবে এদের মধ্যে ২ জন- আমিনুল ইসলাম ওরফে খোকন ডাক্তার ও আব্দুস সামাদ ডেইলি স্টারকে জানান, তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিতই ছিলেন না। পুলিশ যে তাদের এই ঘটনার সাক্ষী করেছে, তাও তারা জানতেন না।

এই ২ জনের দাবি, সংঘর্ষের সময় তারা ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে রায়পুরা শহরে ছিলেন।

এদের মধ্যে আমিনুল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তার ভাষ্য, সাক্ষী হিসেবে তার নাম উল্লেখ করার বিষয়টি ভুল এবং এটি মিথ্যা।

আবদুস সামাদ জানান, সেদিন রাতে তিনি শহর থেকে বাড়ি ফিরে জানতে পারেন যে পুলিশ ৪ জনকে তুলে নিয়ে গেছে।

স্বজনদের হেনস্তা, পায়ে গুলি

আজিজুলের বড় ভাই হারুন মিয়া ও রূপ মিয়ার ভাগ্নে মঈন উদ্দিন অভিযোগ করেন, ঘটনার কয়েক মাস পর পুলিশ তাদের আটক করে পায়ে গুলি করে।

এরপর পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক বহনের মিথ্যা অভিযোগ আনে।

হারুন ও মঈন জানান, তাদের পা কেটে ফেলতে হয়েছে।

বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি হারুন অভিযোগ করেন, ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর রায়পুরার বাসা থেকে পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে যায়।

পুলিশ তাকে চোখ বেঁধে, হাত বেঁধে নিরিবিলি একটি জায়গায় নিয়ে যায় এবং পায়ে গুলি করে।

মঈন জানান, ২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার পথে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ইমিগ্রেশন পুলিশ। রায়পুরা থেকে আসা পুলিশের ৩ সদস্যের একটি দলের কাছে তাকে আমাকে হস্তান্তর করা হয়। পরে পুলিশ তার চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে করে রায়পুরায় নিয়ে যায়।

মঈন বলেন, 'আমার ডান পায়ে গুলি করা হয়। আমি যেহেতু কাঁদছিলাম, তাই তারা আমার চোখের বাঁধন খুলে দিয়েছিল। তখন আমি ওসিকে (আজহারুল) বন্দুক হাতে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।'

সে সময় নরসিংদীর পুলিশ সুপারের দায়িত্বে ছিলেন ডিআইজি আমেনা বেগম। তার ভাষ্য, যখন কয়েক হাজার লোক পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালায় এবং পুলিশের একজন সদস্য গুরুতর আহত হন, তখন তিনি স্থানীয় ওসি ও সার্কেল এএসপিকে 'জঘন্য অপরাধী' রূপ মিয়াকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ। তিনি বলেন, 'পুলিশ এখনো তাকে (রূপ মিয়া) খুঁজছে।'

রায়পুরার সাবেক ওসি আজহারুল ইসলাম কাউকে গুলি করার অভিযোগ অস্বীকার করেন।

এ ছাড়া নরসিংদীর বর্তমান পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজিম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments