জাহাজ ভাঙা: দুর্ঘটনায় ১৯ বছরে ২৫১ শ্রমিক নিহত

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার একটি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে আজ বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনায় একজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে শিপব্রেকিং ইয়ার্ড দুর্ঘটনায় গত ১৯ বছরে মোট ২৫১ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন।
চট্টগ্রাম, সীতাকুণ্ড, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড, দুর্ঘটনা, এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম,
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার একটি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার একটি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে আজ বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনায় একজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে শিপব্রেকিং ইয়ার্ড দুর্ঘটনায় গত ১৯ বছরে মোট ২৫১ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন।

এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই ১৮ বছরে সীতাকুণ্ডের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় মোট ২৪৯ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম একটি আন্তর্জাতিক এনজিও জোট, যারা পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ জাহাজ রিসাইক্লিংয়ের প্রচারণা নিয়ে কাজ করে।

এছাড়া সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের এ পর্যন্ত শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় ২ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। সবমিলিয়ে এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের ১৮ বছরের তথ্য ও চলতি বছরের এ পর্যন্ত ২ জনসহ মোট ২৫১ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) পুলিশ ক্যাম্পের উপ-পরিদর্শক নুরুল আলম আশেক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনায় নিহত আশরাফ মোল্লা (৬৬) নড়াইলের লোহাগাড়া উপজেলার বাসিন্দা। তিনি ইয়ার্ডে একটি জাহাজে পাইপ কাটতে গিয়ে বিস্ফোরণে দগ্ধ। পরে তাকে আহত অবস্থায় চমেক হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক সকাল ১১টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন।'

এর আগে, শনিবার উপজেলার সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হন। গত বছর ৪ জুন একই উপজেলায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে ৫১ জন নিহত এবং ২০০ জনের বেশি আহত হন।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। তবে, সীতাকুণ্ড শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের দুর্ঘটনা নতুন কোনো ঘটনা নয়। কয়েক দশক ধরে ইয়ার্ডগুলোতে অসংখ্য দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় আহত অনেক শ্রমিককে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে।

আজ আশরাফ মোল্লার মৃত্যুর বিষয়ে চমেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ এস খালেদ বলেন, 'আগুনে মোল্লার শ্বাসনালী পুড়ে যায়।'

বিশেষজ্ঞ ও অধিকার কর্মীদের মতে, শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রতি মালিকদের 'নিছক গাফিলতির' কারণে এসব ইয়ার্ডে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে।

শিপব্রেকিং ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের আহ্বায়ক তপন দত্ত বলেন, 'আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী জাহাজ ভাঙার জন্য তীরে আনার আগে মালিকদের অবশ্যই বিষাক্ত উপাদান অপসারণ করতে হবে। কিন্তু, শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের অধিকাংশ মালিক সঠিকভাবে বিষাক্ত উপাদান অপসারণ করেন না। মালিকরা শ্রমিকদের জাহাজ ভাঙতে বাধ্য করেন। কিন্তু, জাহাজে বিষাক্ত উপাদান থাকায় ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটে।'

তিনি আরও বলেন, 'নিয়মানুযায়ী শ্রমিকদের জাহাজ ভাঙার কাজে নিয়োজিত করার আগে অবশ্যই প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কিন্তু, বেশিরভাগ মালিক তা করেন না। এর পরিবর্তে তারা সঠিক প্রশিক্ষণ না দিয়ে অপ্রশিক্ষিতদের জাহাজ ভাঙার কাজে নিয়োজিত করেন। ফলে, দুর্ঘটনা ঘটে।'

'বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিএ) কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম শহরে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেছিল যা এখন 'নিষ্ক্রিয়', বলেন তিনি।

শিপব্রেকিং ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের সদস্য ফজলুল কবির মিন্টুর মতে, শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় না। ফলে, শ্রমিকরা বেশি দুর্ঘটনা ঝুঁকিতে থাকেন। এ কারণে কারণে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার এত বেশি।

তিনি বলেন, 'শিপব্রেকিং শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। শ্রম আইন অনুযায়ী, একজন শ্রমিককে প্রতি ২ ঘণ্টা পর পর আধা ঘণ্টা বিশ্রাম দিতে হবে। যেন তিনি কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন। কিন্তু, এই নিয়ম মানা হয় না। এর পরিবর্তে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে শ্রমিকরা আট থেকে ১০ ঘণ্টা ডিউটি করতে বাধ্য হন। যা তাদের একাগ্রতাকে ব্যাহত করে।'

'ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ বছরে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় মোট ১০৩ জন শ্রমিক নিহত ও শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছেন,' বলেন তিনি।

ফজলুল কবির মিন্টুর বলেন, 'বর্তমান শ্রম আইন অনুযায়ী মালিকদের একজন মৃত ভিকটিমকে ২ লাখ টাকা দিতে হবে। কিন্তু, এই নিয়ম মালিকদের জন্য কোনো ব্যাপারই না। তাই তারা শ্রমিকদের জীবনের ব্যাপারে উদাসীন। একজন শ্রমিকের জীবনের মূল্য মাত্র ২ লাখ টাকা।'

গত ২ জুন এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, '২০২২ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পে বড় দুর্ঘটনার ১৮টির মধ্যে ৬টি ঘটেছে কবির স্টিল রি-রোলিং মিলের মালিকানাধীন ইয়ার্ডে।'

জানতে চাইলে কবির স্টিল শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের পরিচালক দুলালুল করিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করছি। শ্রমিকদের সব ধরনের নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হচ্ছে। তবুও অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে।'

'কেউ চায় না তার ইয়ার্ডে দুর্ঘটনা ঘটুক,' তিনি বলেন।

আজ তাহের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের দুর্ঘটনায় আশরাফ মোল্লা নিহত হন। তাহের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের মালিক আবু তাহের ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শ্রমিকদের হ্যান্ড গ্লাভস, গামবুট এবং গগলসসহ সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়।'

কেন এই দুর্ঘটনা ঘটল জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এটা দুর্ভাগ্য।'

শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) সভাপতি তাহের বলেন, 'সীতাকুণ্ডে ৩০০ ইয়ার্ডের মধ্যে এখন প্রায় ৩০টি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড চালু আছে। সব মালিক এখন শ্রমিকদের জন্য ইয়ার্ডগুলো নিরাপদ রাখতে আন্তরিক। আমরা সব ইয়ার্ডকে গ্রিন ইয়ার্ড করতে কাজ করছি।'

যোগাযোগ করা হলে কলকারখানা ও স্থাপনা পরিদর্শন বিভাগের পরিদর্শক শুভঙ্কর দত্ত বলেন, 'আমি তাহের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে দুর্ঘটনার কথা শুনেছি। আমি সিএমচিএইচে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে কাজ করছি। আজকের বিষয়টিও দেখছি।'

শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে প্রায়ই দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, 'শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোকে গ্রিন ইয়ার্ড হিসেবে গড়ে তোলার কাজ চলছে। ৭টি ইয়ার্ড ইতোমধ্যে আবেদন করেছে এবং আমরা এর মধ্যে পিএইচপি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড এবং এসএন করপোরেশন শিপব্রেকিং ইয়ার্ডকে গ্রিন ইয়ার্ড হিসাবে সার্টিফিকেট দিয়েছি। এই বিষয়ে অন্যান্য ইয়ার্ডের সুবিধা পরিদর্শন করছি।'

Comments