পুলিশ হত্যায় যেভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন রবিউল

রবিউল ও তার কয়েকজন সহযোগী গাজীপুরে মামুনের মরদেহ ফেলে দেয়। এমনকি, মরদেহটি পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, যেন তাকে চেনা না যায়।
আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এসে রবিউল ইসলাম ওরফে আরভ খান দাবি করেছেন, ২০১৮ সালে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না। তবে, পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার জড়িত থাকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে।

বনানীতে রবিউলের ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে ২০১৮ সালের ৮ জুলাই পিটিয়ে হত্যা করা হয় স্পেশাল ব্রাঞ্চের পরিদর্শক মামুন এমরান খানকে। হত্যার সময় রবিউল সেখানে ছিলেন না।

কিন্তু মামুন মারা গেছে খবর পেয়ে তিনি ফোনে এক সহকারীকে নির্দেশ দেন, মামুনের একটি পায়ের আঙ্গুল কেটে সেখান থেকে রক্ত বের হয় কি না, তা দেখতে।

এরপর রবিউল ও তার কয়েকজন সহযোগী গাজীপুরে মামুনের মরদেহ ফেলে দেয়। এমনকি, মরদেহটি পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, যেন তাকে চেনা না যায়।

হত্যা মামলার আসামি রহমত উল্লাহর স্বীকারোক্তি এবং ঢাকার একটি আদালতে পুলিশের জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে এসব ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।

গত ১৫ মার্চ দুবাইয়ে নিজের স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে আমন্ত্রণ জানানোর পর স্পটলাইটে আসেন রবিউল।

ফেসবুক লাইভে এসে তিনি দাবি করেন, ওই ফ্ল্যাটটি তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান 'আপন বিল্ডার্স'র কার্যালয়। পুলিশ কর্মকর্তাকে ওই ফ্ল্যাটের ভেতরে হত্যা করা হয়েছিল, কিন্তু সে সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না এবং 'হত্যার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না'।

যেভাবে শুরু

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মামলার আরেক আসামি রবিউলের স্ত্রী সুরিয়া আক্তার কেয়া বলেন, তিনি ও তার সহযোগীরা যৌন ব্যবসা চালানোর জন্য ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিল।

ধনী ব্যক্তিদের সেখানে জন্মদিনের পার্টির মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের অশ্লীল ছবি তুলে পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইল করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

কেয়াকে এক সহযোগী জানিয়েছিলেন, একজন প্রকৌশলী রহমত উল্লাহ তাদের সম্ভাব্য টার্গেট হতে পারে। রবিউলকে এই তথ্য জানান কেয়া এবং রবিউল তাকে ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন।

একটি 'জন্মদিনের পার্টি'তে আমন্ত্রণ পেয়ে রহমত উল্লাহ তার পুলিশ পরিদর্শক বন্ধু মামুনকেও সেখানে যেতে অনুরোধ করেন।

রহমত ও মামুন বনানীতে পৌঁছালে কেয়া ও ওই চক্রের আরও ২ নারী তাদেরকে ফ্ল্যাটে নিয়ে যান।

তারা ২ জন একটি কক্ষে বসে থাকার সময় রবিউলের সহযোগী স্বপন, দিদার, আতিক ও মিজান এসে নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন এবং সেখানে 'অসামাজিক কার্যকলাপে' জড়িত থাকার অভিযোগ আনেন।

মামুন নিজেকে পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তাদের চ্যালেঞ্জ করলে ৪ জন মিলে তাকে মারধর শুরু করেন। তারা তার হাত বেঁধে চেপে ধরেন এবং এক পর্যায়ে মামুন অজ্ঞান হয়ে যান।

ওই সময় ভবনের বাইরে থাকা রবিউল রাত ১০টার দিকে আফতাবনগরের বাসার দিকে রওনা হন এবং রাত ১২টার দিকে স্বপন তাকে জানান যে ওই পুলিশ কর্মকর্তা মারা গেছেন।

তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে স্বপনকে রবিউল নির্দেশ দেন, মামুনের পায়ের আঙুল কাটতে এবং সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে কি না, তা দেখতে। পরের দিন গাজীপুরের একটি ঝোপে মামুনের মরদেহ ফেলে তা পুড়িয়ে ফেলা হয়।

মামুনের মরদেহ যে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেটিতে খিলক্ষেতের একটি গ্যাস স্টেশন থেকে ১ হাজার টাকার গ্যাস নেন রবিউল।

তদন্ত ও বিচার

২০১৯ সালে ঢাকার একটি আদালতে হত্যার বিবরণসহ একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ।

প্রতিবেদন ও ৪ আসামির জবানবন্দি থেকে জানা যায়, রবিউল বনানীর ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ কর্মকর্তার মোটরসাইকেলটি নিয়ে স্বপনের কাছে দেন বিক্রির জন্য।

স্বপন কোনো ক্রেতা খুঁজে না পাওয়ায় রবিউল তাকে বলেন মোটরসাইকেলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে রেখে আসতে। পরবর্তীতে সেখান থেকেই মামুনের মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করা হয়।

২০১৯ সালের ৩১ মার্চ পুলিশের গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেখ মাহবুবুর রহমান ২ নাবালকসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত-১ রবিউল ইসলাম, রহমত উল্লাহ, স্বপন সরকার, দিদার পাঠান, মিজান শেখ, আতিক হাসান, সুরাইয়া আক্তার কেয়া ও সরোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার দুলাল গতকাল বুধবার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা হাইকোর্ট থেকে একটি চিঠি পেয়েছি, যেখানে ১ বছরের মধ্যে এই মামলার বিচার শেষ করতে বলা হয়েছে। আগামী ৯ এপ্রিল মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত।'

এ ছাড়া, ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ঢাকার জুভেনাইল কোর্ট-৭ এ মামলায় ২ নাবালিকা মেয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

স্বপন, দিদার, মিজান ও আতিক তাদের জবানবন্দিতে বলেছেন, রবিউল তার বনানীর ফ্ল্যাটে যৌন ব্যবসা দেখাশোনা ও চাঁদাবাজি করার জন্য তাদের 'নিযুক্ত' করেছিল।

কেয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। জামিন পাওয়ার পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। রবিউলকে কখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি এবং বাকি ৬ আসামি কারাগারে রয়েছেন।

প্রসিকিউশনের ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে শুধুমাত্র অভিযোগকারী জাহাঙ্গীর আলম খান আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Abantika: A victim of institutional neglect

The universities also didn't organise any awareness activities regarding where and how to file complaints.

4h ago