‘স্বর্ণ আত্মসাৎ’ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এমপি আনার খুন

‘পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা ২৫ এপ্রিল কলকাতায় একটি বাসা ভাড়া নেয়।’
আনার
আনোয়ারুল আজীম আনার। ফাইল ছবি সংগৃহীত

কলকাতায় খুন হওয়া ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার এবং তাকে হত্যার মূল সন্দেহভাজন আক্তারুজ্জামান স্বর্ণ চোরাকারবারের চক্র নিয়ন্ত্রণ করতেন।

এমপি আনার প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের স্বর্ণ আত্মসাৎ করার জেরে তাকে হত্যা করা হয় বলে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানিয়েছে।

আক্তারুজ্জামান নিজ শহর ঝিনাইদহে শাহীন মিয়া নামে পরিচিত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিবি কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আক্তারুজ্জামান দুবাই থেকে বাংলাদেশে সোনার বার পাচার করতেন এবং সংসদ সদস্য আনার স্বর্ণের চালান ভারতে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতেন।

ডিবি ও একটি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের কোনো এক সময় আজীম তার পার্টনারের কাছে স্বর্ণ চোরাকারবারির টাকা থেকে বড় অংশ চান।

তারা বলছেন, 'আনার ১০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের দুটি চালান পেয়ে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে না দেওয়ায় তার ও আক্তারুজ্জামানের পার্টনারশিপ চরম খারাপ অবস্থায় পৌঁছায়।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, 'আনারের প্রস্তাব আক্তারুজ্জামান প্রত্যাখ্যান করেন এবং উভয়ের সম্পর্কে ফাটল ধরে।'

এরপর আক্তারুজ্জামান টাকা চাইতে শুরু করেন আনারের কাছে এবং ভারতে স্বর্ণ পৌঁছে দিতে পারে এমন লোক খুঁজে বের করেন বলে তদন্তকারীরা জানান।

এ ঘটনায় আটক সন্দেহভাজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাতে এক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, 'দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তি করার জন্য দুজনেই গত ছয় মাসে বেশ কয়েকবার দেখা করেন এবং আনার বারবারই আক্তারুজ্জামানকে টাকা দিতে রাজি হননি।'

একপর্যায়ে আক্তারুজ্জামান এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

চিকিৎসার কথা বলে ১২ মে কলকাতায় যান সংসদ সদস্য আনার। সেখানে এক রাত বন্ধুর বাড়িতে কাটানোর পরদিন তিনি ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছেন বলে বের হন। তিনি আর ফেরেননি। তবে ওই বন্ধুর ফোনে এমপির ফোন নম্বর থেকে কয়েকটি টেক্সট মেসেজ এসেছিল যেগুলোতে বলা হয়েছিল যে তাকে কল করার দরকার নেই।

গত বুধবার ভারত ও বাংলাদেশের পুলিশ জানায়, কলকাতার নিউ টাউনের একটি ফ্ল্যাটে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার তার পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার মরদেহ উদ্ধার করতে পারেনি।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, 'হত্যাকারীরা লাশটি এমনভাবে টুকরো টুকরো করেছে যে, মানুষের দেহাবশেষ হিসেবে শনাক্ত করা কঠিন হবে।'

গ্রেপ্তার তিন সন্দেহভাজনের বরাত দিয়ে তিনি এ কথা বলেছেন।

তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে ভারতীয় পুলিশ লাশের কিছু অংশ খুঁজে বের করতে সক্ষম হবে।

ডিবি প্রধান বলেন, 'হত্যাকারীরা দুই থেকে তিন মাস আগে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং এ হত্যা মিশনের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামানের মালিকানাধীন গুলশান ও বসুন্ধরার দুটি বাড়িতে একাধিক বৈঠক হয়। কিন্তু ডিএমপির নজরদারির কারণে ঢাকায় তারা খুন করেনি।'

'খুনিরা জানত যে এমপি আনার প্রায়ই কলকাতায় যান এবং সেখানে থাকতেন। এরপর খুনিরা নতুন পরিকল্পনা করে।'

হারুন বলেন, 'পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা ২৫ এপ্রিল কলকাতায় একটি বাসা ভাড়া নেয়। ৩০ এপ্রিল আক্তারুজ্জামান, তার বান্ধবী এবং খুনি আমানুল্লাহ একটি ফ্লাইটে কলকাতা গিয়ে ভাড়া করা ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন।'

গোয়েন্দারা জানান, জাহিদ ও সিয়াম নামে আরও দুজনকে কলকাতায় ভাড়া করেন আক্তারুজ্জামান। এরপর হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ১০ মে বাংলাদেশে ফিরে আসেন তিনি।

১৩ মে সংসদ সদস্য আনার তার বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসা থেকে বের হলে খুনিদের একজন ফয়সাল তাকে একটি সাদা গাড়িতে করে নিউ টাউনের ভাড়া করা ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়।

দুপুর ২টা ৫১ মিনিটে আনার ওই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন এবং হত্যাকারীরা পরবর্তী আধা ঘণ্টার মধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে হত্যা করে।

হত্যাকারীরা অবশ্য এমপি আনারের মোবাইল ফোন চালু রাখে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিভিন্ন জনকে টেক্সট মেসেজ পাঠায় বলে জানান ডিবি প্রধান হারুন।

১৫ মে আমানুল্লাহ ও আক্তারুজ্জামানের বান্ধবী বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এরপর ১৬ মে মুস্তাফিজ এবং ১৭ মে ফয়সাল দেশে ফেরেন।

গোয়েন্দারা জানান, ভারতীয় ক্যাবচালক রাজুকে ভাড়া করা হয়েছিল এবং তাকে দিয়ে মরদেহ লুকানো হয়।

হারুন বলেন, 'হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের তিনজনকে আটক করা হয়েছে এবং হত্যার পেছনে দায়ী মূল ব্যক্তিকে খুঁজে বের করাই এখন প্রধান লক্ষ্য।'

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আনারের খুনিদের 'প্রায় চিহ্নিত' করে ফেলেছে।

Comments

The Daily Star  | English

The psychological costs of an uprising

The systemic issues make even the admission of one’s struggles a minefield

11h ago