‘তারা কি আদৌ বেঁচে আছে’

এখনো প্রিয়জনের অপেক্ষায় গুমের শিকার ২ ব্যক্তির পরিবার।
জাহিদ হাসান ও এএসএম শহীদুল আলম সিরাজ। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রামে দুটি পৃথক ঘটনায় নিখোঁজ হওয়া দুই ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা এখনো তাদের প্রিয়জনদের ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।

নিখোঁজদের মধ্যে একজনকে ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব-৭) সদস্যরা তুলে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তুলে নিয়ে যাওয়া জাহিদ হাসান (১৮) ২০১৮ সালের ১২ অক্টোবর বন্দর নগরীর মুরাদপুর এলাকায় একটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার প্রধান সাক্ষী ছিলেন। তিনি কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষা এলাকার মোহাম্মদ ইয়াসিনের ছেলে।

মুরাদপুর রেলক্রসিং এলাকায় ওই বন্দুকযুদ্ধে যুবলীগ নেতা অসীম রায় বাবু নিহত হন। র‌্যাবের দাবি, তিনি মাদক চোরাকারবারি ছিলেন। সেই সময় র‌্যাবের চারজন সদস্যও আহত হয়েছিলেন। জাহিদ ছিলেন অসীমের ব্যক্তিগত চালক। পরিবারের দাবি, অসীম রিয়াজুদ্দিন বাজারে কাপড়ের ব্যবসা করতেন।

নিখোঁজের তালিকায় বিএনপি নেতা এএসএম শহীদুল আলম সিরাজও রয়েছেন। ২০১২ সাল থেকে তিনি নিখোঁজ।

চট্টগ্রাম উত্তর বিএনপির নেতা এবং ফটিকছড়ি উপজেলার লেলাং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজ ঢাকায় বিএনপির 'ঢাকা চলো' আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পর ২০১২ সালের ৬ মার্চ নিখোঁজ হন বলে তার পরিবার জানায়।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর 'আয়নাঘর' থেকে দীর্ঘদিন পরে ফিরে এসেছেন অনেকে। বছরের পর বছর নিখোঁজ থাকার পর ফিরে আসায় এই দুটি পরিবার আবারও তাদের প্রিয়জনদের জীবিত ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধছেন।

তারা এখন সম্ভাব্য সব উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন শুধু তাদের প্রিয়জনরা বেঁচে আছেন কি না, তা জানার জন্য। 

জাহিদের বড় ভাই মেহেদী হাসান বিপ্লব বলেন, 'সেদিন রাতে আমি, জাহিদ ও আমার মা আমাদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে খালার বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলাম। রাত সাড়ে ৩টার দিকে বাইরে কিছু লোকের কথা বলার শব্দে আমরা জেগে উঠি। ৪-৫ জন নিজেদের আমাদের অতিথি হিসেবে পরিচয় দিয়ে দরজা খোলার জন্য বলে।' 

মেহেদী যখন তাদের পরিচয় সম্পর্কে জানতে চান, তখন তারা নিজেদের 'প্রশাসনের লোক' হিসেবে পরিচয় দেয়। 

'তারা বারবার জাহিদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছিলেন', যোগ করেন মেহেদী। 

তিনি আরও জানান, কথোপকথনের মাঝেই তার চাচা মো. ফারুক দরজা খুলে দেন। দরজা খোলামাত্রই সাদা পোশাকে থাকা ব্যক্তিরা সঙ্গে সঙ্গে জাহিদ ও তার চাচাত ভাই ফয়সালকে ধরে ফেলে এবং তাদের কোমরে বাঁধা আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখায়। 

'তারা জাহিদকে একটি কালো এসইউভি গাড়িতে জোর করে তুলে নেয়। তাকে তুলে নেওয়ার পর আমি ও মা র‌্যাব অফিসে গিয়ে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। আমরা র‌্যাবের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছি এবং একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি সেই সময়।' 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিপ্লব বলেন, 'আমার ভাই এখনো বেঁচে আছে—এই আশায় কয়েকদিন আগে কর্ণফুলী থানায় গিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ এখনো এই বিষয়ে কোনো সূত্র খুঁজে পায়নি। এখন আমরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার মা এখন ভাইয়ের কথা ভেবে শয্যাশায়ী।' 

র‌্যাব-৭ এর তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিফতা উদ্দিন আহমেদ সেই সময় ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'আমরাও গাড়ির ড্রাইভারকে খুঁজছি। কারণ ঘটনার (অসীমের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ) সময় আমরা তাকে খুঁজে পাইনি।' 

নিখোঁজ শহীদুল আলম সিরাজের বড় ছেলে আজিম অনন বলেন, 'আমার বাবা ফটিকছড়ি উপজেলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। খুব অল্প বয়সে তিনি ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং তার নেতৃত্বের দক্ষতার প্রমাণ দেন।'

'২০১২ সালের ৬ মার্চ রাতে তিনি আমার মাকে ফোন করে জানান যে, তিনি ঢাকায় একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের পর বাড়ি ফেরার জন্য গাড়িতে উঠবেন। কিন্তু পরের দিন সকালে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।' 

অনন আরও বলেন, 'আমরা জানি না আমার বাবা জীবিত আছেন কি না। তবে আমরা অনেককে গোপন আয়নাঘর থেকে পরিবারের কাছে ফিরে আসতে দেখেছি। আমি আমার বাবাকে ফিরে পেতে চাই, তাকে "বাবা" বলে ডাকতে চাই। বাবাকে হারিয়ে গত এক যুগ ধরে সংগ্রাম করে যাচ্ছে আমার মা সুলতানা পারভীন ও আমার ভাই। আমরা কীভাবে দিন পার করে এসেছি, তা কেউ জানে না।' 

তিনি জানান, সেই সময় পাচলাইশ ও খুলশী থানায় তারা জিডি করেন। কিন্তু কেউ তাদের কোনো খোঁজ দিতে পারেনি। 

সনাক-টিআইবি চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান পেতে পরিবারগুলোর উচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আবেদন করা। আগের সরকারের সময় অনেকেই গোপন কারাগার ফিরে এসেছেন। তাই নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত।' 

'দেশে এখনো গোপন আটকাগার থাকতে পারে৷ এই বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান প্রয়োজন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিস্তারিত তালিকা প্রকাশ করা প্রয়োজন। পরিবারগুলো এখন আইনি সহায়তার জন্য আদালতের আশ্রয় নিতে পারে', বলেন তিনি।

Comments