নির্বাচনে ‘ছোট দলের’ ভোটের হিস্যা কত
০ দশমিক ০১ শতাংশ, ০ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং ০ দশমিক ২২ শতাংশ- এগুলো আওয়ামী লীগের মিত্র জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) ভোটের ভাগ। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে যেসব আসনে আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, সেসব আসনের মোট ভোটের মধ্যে এটুকু পেতে সক্ষম হয়েছিল দলটি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে অত্যন্ত খারাপ পারফরম্যান্স যেখানে দলের সাত জন প্রার্থীই বাজে ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল এবং এ কারণে নির্বাচন কমিশনে তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
পরের নির্বাচনে, এটি ২৮টি আসনের মধ্যে ২৪টিতে পরাজিত হয় এবং আমানতের প্রায় ৮৬ শতাংশ বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
২০১৮ সালের নির্বাচনে আমানত বাজেয়াপ্তের কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
প্রার্থীরা যদি তাদের নির্বাচনী এলাকায় প্রদত্ত ভোটের ১২.৫ শতাংশের কম পান তবে বাধ্যতামূলক জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়।
তবে এটিই একমাত্র দল নয়, যারা জাতীয় নির্বাচনে শোচনীয় ফলাফল করেছে।
আরও প্রায় ২০টি রাজনৈতিক দল রয়েছে যারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে মোট ভোটের ১ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছিল আর এতে করে প্রশ্ন ওঠে তারা কীভাবে সংসদে যেতে পারল।
গত নির্বাচনে তাদের মধ্যে ১৯টি দল ০.৫ শতাংশেরও কম ভোটারের ভোট পেয়েছিলেন।
২০০৮ সালের নির্বাচন, যাকে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হিসেবে দেখা হয়, তার মধ্যে কমপক্ষে ১৮টি ০.৫ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছে।
এই ২১টি রাজনৈতিক দল ২০০৮ সালের নির্বাচনে মোট ভোটের ৩ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছিল এবং সেই সমস্ত দল আসন্ন জাতীয় নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'আমার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি, নামধারী এই দলগুলো তাদের দলীয় নিবন্ধনকে কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জন করে এবং নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে সরকারের সহায়ক ভূমিকা পালন করে।'
ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী মিত্রের আরেকটি উদাহরণ দেখা যাক।
বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল ২০০৮ সালে শূন্য শতাংশ ভোট পেয়েছিল এবং এর একমাত্র প্রার্থী দিলীপ বড়ুয়া, যিনি দলের প্রধানও ছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং জামানতের অর্থ হারান।
২০১৮ সালে, এটি মোট ভোটের মাত্র ০.০০০৫ শতাংশ পেয়েছিল এবং এর দুই প্রার্থী তাদের জামানত হারিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে দলটি নির্বাচনে আসেনি।
বারবার এত কম ভোট পাওয়ার পরও কেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে জানতে চাইলে দিলীপ বড়ুয়া বলেন, তাদের একটি আদর্শ আছে এবং তারা তা সমুন্নত রাখতে চাযন এবং এগিয়ে যেতে চান।
তিনি বলেন, 'ভোট বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে এবং এ কারণেই মানুষ আমাদের ভোট দেয় না। ভোটের রাজনীতিতে আমরা অসহায়।'
জেপি (মঞ্জু) এবং সাম্যবাদীর মতো আওয়ামী লীগের আরও দুটি শরিকের ভোটার সংখ্যা খুবই নগন্য।
এর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে যেসব আসনে প্রার্থী দিয়েছিল, সেখানে যথাক্রমে ০.৩৭ শতাংশ, ২.১ শতাংশ এবং ১.০১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, যদিও তাদের কয়েকজন প্রার্থী আওয়ামী লীগের (নৌকা) প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
অপর শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (ইনু) পেয়েছে ০.৭২ শতাংশ, ১.১৯ শতাংশ ও ০.৭৪ শতাংশ ভোট।
এই পারফরম্যান্স সত্ত্বেও প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৭টি দলের বয়কটের মধ্যে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আশীর্বাদ নিয়ে চারটি দলই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বর্তমান প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ মোট ২৭টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির চেয়ারপারসন আইভি আহমেদ বলেছেন, একটি ছোট রাজনৈতিক দলের প্রচার ও জনগণের কাছে পৌঁছানোর এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ। দলটি ১৪ দলীয় জোটের অংশ।
তিনি বলেন, 'নির্বাচন যখন ব্যয়বহুল এবং পেশিশক্তির আধিপত্যে থাকে, তখন একটি আদর্শভিত্তিক দলের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। নির্বাচনের সময় অনেক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায় দল সংগঠিত ও লাভবান হয়।'
গত তিনটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে- তারা ৪৮ শতাংশ, ৭২ শতাংশ ও ৭৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে এবং জাপার ভোট ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়ে যথাক্রমে ৭.০৪ শতাংশ, ৭ শতাংশ এবং ৫.৩৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
২০১৪ সালে জাপার প্রায় অর্ধেক এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে এক চতুর্থাংশেরও বেশি প্রার্থী বাধ্যতামূলক ন্যূনতম ভোট পেতে ব্যর্থ হওয়ায় জামানত হারিয়েছেন।
গণফ্রন্টের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, তারা দেশের মানুষের পক্ষে কথা বলার জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
'আপনার যদি কোনও প্ল্যাটফর্ম না থাকে তবে আপনার বক্তব্য মূল্যহীন। আমাদের দলের নিবন্ধন সচল রাখতেই আমরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি।'
দলের মতাদর্শ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি। তিনি বলেন, তারা দেশের উন্নতির জন্য কাজ করছেন।
২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ কংগ্রেস, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি প্রথমবারের মতো এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ছোট ও নামসর্বস্ব এই দলগুলো বেশিরভাগই সুবিধাবাদী।
ক্ষমতাসীন মহলের কাছ থেকে কিছু সুবিধা পাওয়ার জন্য তারা নির্বাচনে অংশ নেয় এবং এটি সব শাসনামলে ঘটে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও বিরোধীদের সাথে মনস্তাত্ত্বিক খেলা খেলতে তাদের একত্র করে।
তিনি বলেন, 'নির্বাচন এলে এই ছোট দলগুলো এর পূর্ণ সুবিধা নেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু ব্যাঙয়ের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত মতপার্থক্য অনেক। কিছু ডানপন্থী রাজনীতিবিদ বিশ্বাস করেন যে তারা যত বেশি পদের জন্য লড়াই করবেন, তাদের ক্ষমতার অংশ পাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি হবে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বে এত বেশি ঢুকে পড়ে যে বিভক্ত হয়ে যায়।'
Comments