ইভিএম নিয়ে নির্বাচন কমিশনার আলমগীরের চ্যালেঞ্জ ও সুজনের বক্তব্য
ইভিএম সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরের চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে গণমাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
সুজনের লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়, জাতীয় প্রেসক্লাবে গত ২৮ আগস্ট সুজনের উদ্যোগে 'জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের উপযোগিতা' বিষয়ক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২৯ আগস্ট ইভিএম সম্পর্কে সুজনের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন যে, 'কারচুপির কথা যিনি বলছেন তাকে প্রমাণ দিতে হবে। উনি যদি প্রমাণ দিতে পারেন, তাহলে ইভিএম বাতিল করে দেবো। এর বাইরে কে কী বলবে, তা দেখে তো আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।'
নির্বাচন কমিশনারের মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এমন বক্তব্যে আমরা বিস্মিত হয়েছি। এটি সুস্পষ্ট যে, তিনি সুজনের লিখিত বক্তব্য পড়েননি বা পড়ার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেননি। বরং আমরা যে কথা বলিনি তা চ্যালেঞ্জ করে তিনি 'ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধে'র অবতারণা এবং একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছেন। এ ছাড়াও, জনগণের অর্থ থেকে বেতন-ভাতাপ্রাপ্ত একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যেভাবে জনগণের মতামত উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলছেন, তা অত্যন্ত দুঃখজনক।
সুজনের বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যেহেতু ইভিএম ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, এর সফটওয়ারের সোর্সকোড অন্য কারও কাছে নেই এবং এটি সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে, তাই এটি দিয়ে বাইরের কারও পক্ষে কারচুপি করা প্রায় অসম্ভব, যদিও কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের পক্ষে কমিশনের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কমিশনের ইন্ট্রানেটে ম্যালওয়ার ঢুকিয়ে অন্য কম্পিউটার থেকে ইভিএমের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সম্ভব। আমরা আরও বলেছি যে, বর্তমান ইভিএম কারিগরি দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল একটি যন্ত্র। এমনকি, সম্প্রতি সাবেক সিইসি নূরুল হুদাও ইভিএমে কিছু ত্রুটি থাকার কথা স্বীকার করেছেন। আর এই ত্রুটিকে কাজে লাগিয়ে কমিশনের এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তা, কারিগরি টিম এবং নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের পক্ষেই এ যন্ত্রটি দিয়ে নির্বাচনে কারসাজি করা সম্ভব।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন যে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের এবং এ কারণে কমিশন ইভিএম সম্পর্কে রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করেছে, যদিও সরকারি দলের মতামত সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেনি। সিইসি ঠিকই বলেছেন, নির্বাচন কমিশনেরই দায়িত্ব জনগণের পক্ষে এবং স্বার্থে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। আর এ কারণেই কমিশনকে সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে কমিশনকে অগাধ ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে এবং কমিশনারদেরকে অপসারণের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের বিচারকদের মতো সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। তাই ইভিএম ব্যবহার করে প্রশ্নাতীতভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাবে তা জনগণের সামনে প্রমাণ করার দায়িত্ব 'বার্ডেন অব প্রুফ' কমিশনের, অন্য কারও নয়। আমরা কমিশনকে উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোর এ অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকার বিনীত অনুরোধ করছি এবং ইভিএম যে সন্দেহাতীতভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য উপযোগী সে বিষয়ে জনগণের আস্থা অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।
সুজনের পক্ষ থেকে গত ২৮ আগস্টের অনুষ্ঠানে ইভিএম সম্পর্কে সুস্পষ্ট কতগুলো তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছিল। এগুলো হলো-
ইভিএমে ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল নেই
ইভিএমের একটি বড় দুর্বলতা হলো- এতে ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইলের (ভিভিপিএটি) ব্যাকআপ নেই, যার ফলে ভোটের ফলাফল পুনর্গণনা বা অডিট করা যায় না। অর্থাৎ, নির্বাচন কমিশন যে ফলাফল দেবে তা-ই গ্রহণ করতে হবে। ইভিএমের এ দুর্বলতার কারণেই বাংলাদেশের সবচেয়ে নামকরা প্রযুক্তিবিদ, বুয়েটের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী (যাকে ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশন কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির প্রধান করেছিল) বর্তমান ইভিএম কেনার বিরোধিতা করেছিলেন। এ ধরনের দুর্বলতা কাটাতেই ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেখানকার ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করা হয়েছিল। এ ছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানী ডেভিড ডিল স্থাপিত 'ভেরিফায়েড ভোটিং ফাউন্ডেশন'-এর মতে, 'প্রেগ্রামিংয়ে ভ্রান্তি, যান্ত্রিক ত্রুটি ও বিদ্বেষাত্মক কারসাজির মতো অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে ভোটার-যাচাইযোগ্য অডিট ট্রেইল না থাকলে ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা বা ব্যবহার করা উচিত নয়'। এ ছাড়াও, ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করলে অত্যধিক ব্যাটারি ক্ষয়, যন্ত্রটি জ্যাম হয়ে যাওয়া এবং ভোটারের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হওয়ার যুক্তি অনেকে দিচ্ছেন, যা ভারতের তুলনায় ১১ গুণ বেশি দামে কেনা আমদের ইভিএমের প্রযুক্তিগত দুর্বলতারই প্রতিফলন। প্রসঙ্গত, আমাদের ব্যবহৃত ইভিএমের ডিজিটাল অডিট ট্রেইল ব্যবহার করতে হলে অসংখ্য মেশিনের ফরেনসিক এনালাইসিস লাগবে, যার সক্ষমতা আমাদের দেশে নেই।
কর্মকর্তাদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা
অনেকের, বিশেষত যারা কায়িক পরিশ্রম-গৃহকর্মে নিয়োজিত বা বয়স্ক নাগরিক তাদের আঙুলের ছাপ ইভিএম শনাক্ত করতে পারে না বলে নির্বাচন কমিশন প্রিসাইডিং অফিসার-কারিগরি কর্মকর্তাদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা প্রদান করে। অর্থাৎ, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিজের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে ইভিএম খুলে দিতে পারেন, যাতে ভোটার ভোট দিতে পারেন। বিবিসির একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী- গত জাতীয় নির্বাচনে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা যদি ভোটারের উপস্থিতিতে নিজের আঙ্গুলের চাপ দিয়ে ভোট দেওয়ার জন্য ইভিএম খুলে দিতে পারেন, তা হলে ভোটারের অনুপস্থিতিতেও ইভিএম খুলে নিজে ভোট দিয়ে দিতে পারেন, যার মাধ্যমে ভোটের ফলাফল বদলে দেওয়া সম্ভব। আর কমিশন প্রিসাইডিং অফিসারকে ১ শতাংশ না ২৫ শতাংশ ওভাররাইড করার ক্ষমতা দিয়েছে তা বাইরের কারোরই জানার সুযোগ নেই। এ ছাড়া, ১ শতাংশ ওভাররাইড ক্ষমতা দিলেও প্রিসাইডিং অফিসাররা (যাদের অনেকেই পুলিশের ভেটিংয়ের মাধ্যমে গত জাতীয় নির্বাচনে নিয়োগ পেয়েছিলেন) যে ২৫ শতাংশ ভোট নিজের আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে দেবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এখানে কি কোনো চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স আছে? প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হলে, সামান্য কয়েক শতাংশ ভোটের ব্যবধানেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। তাই এই ওভাররাইডিংয়ের ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন ও তার অধীনস্থ নির্বাচনী কর্মকর্তারা জালিয়াতি করে নির্বাচনী ফলাফলই পাল্টে দিতে পারেন।
ইন্টিগ্রেটেড রেজাল্ট তৈরির সুযোগ নেই, ভোটদান ডিজিটাল কিন্তু ফলাফল তৈরি ম্যানুয়াল
ইভিএম ব্যবহারের বহু কথিত একটি আকর্ষণ হলো- এতে ভোটের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যাবে, যা সঠিক নয়। ডিজিটাল মেশিনে ভোট গ্রহণের তথ্য অডিট কার্ডে এনে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কেন্দ্রের ও আসনের ফলাফল তৈরি করতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় ভোটের সংখ্যা বদলে দিয়ে জালিয়াতি করা সম্ভব। অর্থাৎ, সব কেন্দ্রের ইন্টিগ্রেটেড ফলাফল স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি করতে বর্তমান ইভিএম সক্ষম নয়, যা বর্তমান ইভিএমের আরও একটি বড় প্রযুক্তিগত দুর্বলতা। এ কারণেই ইভিএমে ভোট হলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায় চূড়ান্ত ফলাফল পেতে। অনেকেরই মনে আছে গত জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা ৬টি আসন এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী ফলাফল মাঝরাতের পরে ঘোষিত হয়েছিল। সম্প্রতি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল পেতেও প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
অন্য যেকোনো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের মতো প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে ইভিএমকে প্রস্তুত করতে হয়
ইভিএম একটি জড় পদার্থ এবং এটিকে প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে কমান্ড দিয়ে পরিচালনা করতে হয়। প্রত্যেক নির্বাচনে প্রত্যেক আসনের জন্য প্রোগ্রামিং করে ইভিএমকে কনফিগার করতে হয়, কারণ প্রত্যেক আসনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রার্থী থাকে। এই প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমেও ইভিএমের মেমোরিতে ভোট সংরক্ষণে জালিয়াতি করা যায়। প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে কোনো প্রার্থীর নাম ব্যালট ইউনিট থেকে বাদ দেওয়াও যায়, যে অভিযোগ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে উঠেছিল।
নির্বাচন কমিশনের কারিগরি টিম ভোটের ফলাফলও পাল্টে দিতে পারে
ইভিএম যন্ত্র নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং এর কারিগরি টিম ভোটের ফলাফল বদলে দিতে পারে। অনেকরই স্মরণ আছে যে, গত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্তত ২ বার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছিল, ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমেই যা সম্ভব হয়েছিল বলে অনেকের ধারণা। নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও এমন অভিযোগ উঠেছিল। এ ছাড়াও, অনেক সময় ভোট শুরুর আগেই প্রার্থীর এজেন্ট থেকে রেজাল্ট শিটে দস্তখত নিয়ে নেওয়া হয়। আবার অনেক সময় বিরোধীদলের এজেন্টকে কেন্দ্রে আসতেও দেওয়া হয় না। গত গাজীপুরের সিটি নির্বাচনে বিরোধীদলের এজেন্টদের কাউকে কাউকে আশ্চর্যজনকভাবে কেরানীগঞ্জ জেলে পাওয়া যায়।
একটি কেন্দ্রের সব বুথের মাস্টার ডেটাবেজ নেই
একটি কেন্দ্রের ভোটারদের ভোটার ক্রমিক নম্বরের ভিত্তিতে একাধিক পোলিং বুথে ভাগ করা হয়। নির্দিষ্ট পোলিং কার্ড দিয়ে শুধু ওই নির্দিষ্ট ভোটারদের বায়োমেট্রিক তথ্যই একটি ইভিএমে স্থানান্তর করা হয় কেন্দ্রীয় সার্ভার থেকে। অর্থাৎ, একটি কেন্দ্রের সব ভোটারের তথ্য ওই কেন্দ্রের সব ইভিএম কিংবা একটি বিকল্প ইভিএমে থাকে না, ফলে একটি বুথের ইভিএম কাজ না করলে, নষ্ট হলে বা ইভিএমে ভোটারের বায়োমেট্রিক শনাক্ত করা না গেলে, অন্য ইভিএমে তাদের ভোট নেওয়া যায় না। তাই ডিজিটাল হলেও ইভিএম সত্যিকার অর্থেই ভোটার অবান্ধব একটি মেশিন।
ইন্টারনেট সংযুক্ত না থাকলেও দূর থেকে ইভিএম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব
ইভিএম ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, তাই যন্ত্রটিকে ভার্চুয়ালি ম্যানিপুলেট করা অসম্ভব, এই ধারণাটিও সম্পূর্ণ সঠিক নয়। ইভিএম ইন্টারনেটে সংযুক্ত নয়, তবে কমিশনের নিজস্ব প্রাইভেট নেট বা ইন্ট্রানেটে বসে কোন বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষে ম্যালওয়ার ঢুকিয়ে কারসাজি করা সম্ভব। ইভিএমের উৎপাদনকারীও বলেছেন, মেশিনের অভ্যন্তরে বিশেষ সিম যুক্ত করার মাধ্যমেও ইভিএমের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। আর যেহেতু ভোটের ফলাফল তৈরির জন্য অডিট কার্ডের প্রয়োজন হয়, এই অডিট কার্ডের ইন্টিগ্রিটি বা অখণ্ডতার ওপরও ভোটের ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে। বর্তমান ইভিএমে আগে থেকে সাজানো ফলাফলের প্রি-রেকর্ডেড অডিট কার্ড ব্যবহার করেও ইচ্ছানুযায়ী নির্বাচনী ফলাফল তৈরি করা যেতে পারে।
বায়োমেট্রিক ভিত্তিক ইভিএম নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করে
বায়োমেট্রিক বা আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে ভোটার শনাক্তকরণে জটিলতা ও ভোটারদের অসচেতনতার কারণে ইভিএম ব্যবহার করলে ভোটের হার কমে যায়। গত জাতীয় নির্বাচনে যে ৬টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল তাতে পেপার ব্যালট ব্যবহার করা অন্য আসনগুলোর তুলনায় ভোট পড়ার হার ছিল ৩০ শতাংশ কম। সাম্প্রতিক কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহারের কারণে ভোট পড়ার হার প্রায় ৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এ ছাড়াও, ভোট দেওয়ার ব্যাপারে ভুল শোধরাতে অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক বাটনে চাপ দিলেই ইভিএম হ্যাং হয়ে যায়। একবার হ্যাং হলেই ৫-১০ মিনিট অপচয় হয়, কারণ ইভিএমের সিনক্রোনাইজেশন বা একে রিস্টার্ট দিতে হয়। এ কারণেও ইভিএমে ভোটগ্রহণ পদ্ধতি ধীরগতির। অর্থাৎ, ইভিএম ব্যবহার করলে অনেক ভোটার তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তাই ইভিএম ব্যবহার করার কোনো যৌক্তিকতা আমরা খুঁজে পাই না।
ইভিএম একটি ব্ল্যাকবক্স, যার স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ থাকে
ব্যালট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভোটার নিজের হাতে সিল মেরে তা স্বচ্ছ ব্যালট বক্সে ফেলার পর তা প্রার্থীর এজেন্টের সামনে বা প্রকাশ্যে গণনা করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াই স্বচ্ছ ও বহুলাংশে দৃশ্যমান। অন্যদিকে, ইভিএমে ভোট প্রদান প্রক্রিয়া দৃশ্যমান নয়, ফলে ভোটারদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। একটি নির্বাচন স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হলো কি না এটিই নির্বাচনের মৌলিক বিষয়, এ লক্ষ্যেই নির্বাচনের যাবতীয় আয়োজন ও উদ্যোগ। ইভিএমের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হলে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। সাধারণ জনগণের পক্ষে এর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, ইভিএমের ফলাফল নিয়ে কেবল বিশ্বাস করা ছাড়া ভোটারদের গত্যন্তর নেই। তাই জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের মতো প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলো ইভিএম থেকে সরে এসেছে। ইভিএমের ওপর আস্থাহীনতার কারণে জার্মানির আদালত এটির ব্যবহারকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন। এসব কারণে পৃথিবীর ১৭৮টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৩টি দেশ বর্তমানে সব ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহার করে থাকে।
ইভিএম ব্যয়বহুল
২০১৮ সালে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয় করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। সেসময় কমিটির সুপারিশ পুরোপুরি আমলে নিয়ে প্রকল্প অনুমোদনের আগেই এবং যথাযথ ক্রয় পদ্ধতি উপেক্ষা করেই ইভিএম ক্রয় করার অভিযোগ ওঠে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে আরও কয়েকশ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে একটি দুর্বল যন্ত্রের জন্য, যা ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতি করা যায় এবং যা নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করে, এমন বিরাট পরিমাণের অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
ইভিএম আমাদের দেশের জন্য উপযোগী নয়
আমাদের আবহাওয়ায় অধিক পরিমাণের আর্দ্রতার কারণে দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকলে ইভিএম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর এসব যন্ত্র সংরক্ষণ করতে হয় অনেকটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ওয়ারহাউসে। ৪-৫ বছর আগে কেনা দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে মাত্র ৮০ হাজার এখন ব্যবহারযোগ্য বলে শোনা যায়। আগামী বছরের শেষ পর্যন্ত আরও অনেকগুলো অকেজো হয়ে পড়তে পারে। তাই দ্রুত আমাদের ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসতে হবে। কেনার পর এগুলো ব্যবহারের মতো কারিগরি সক্ষমতা আমাদের আছে কি না তা নিয়েও অনেকের সন্দেহ রয়েছে।
নিখুঁত এনআইডি এবং বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডার এখনো তৈরি হয়নি
সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের নিখুঁত বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডার সঠিকভাবে তৈরি হয়নি বলে নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বিষয়ক লাখ লাখ অভিযোগ উঠেছে। এনআইডিতে ভুলের বিষয়টি খোদ সিইসিই স্বীকার করেছেন। আরেকটি নতুন সমস্যা হলো প্রায় ৫ কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধনের তথ্য হারিয়ে যাওয়া। ২০২৩ সালের মধ্যে কোটি কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি তৈরিসহ বিদ্যমান এনআইডির কোটি কোটি ভুল শুধরানো অসম্ভব। তাই যেখানে নিখুঁত এনআইডি এবং বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডারই তৈরি হয়নি, সেখানে অর্ধেক (১৫০) আসনে ইভিএমে ভোটের যৌক্তিকতা কোথায়?
আমরা মনে করি, উপরোক্ত এসব দুর্বলতার কারণে অনেকেরই ইভিএমের ওপর কোনো আস্থা নেই, ইচ্ছা করলে কমিশন একটি জরিপের মাধ্যমে তা নিরূপণ করতে পারে। এমনকি, ইভিএমে ভোট চুরি হয় এমন মন্তব্য করে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সর্বশেষ নির্বাচনে উভয় প্যানেলই ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই এটিকে ভোট জালিয়াতির যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছে। আর এটি যেহেতু সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে, তাই ইভিএমের ওপর ভোটারদের আস্থা মূলত নির্ভর করে কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর। আমাদের সিইসির মতেই কমিশনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো জনগণের আস্থাহীনতা, যা দূরীভূত করার দায়িত্ব কমিশনের নিজের। তাই ইভিএমের কারিগরি দুর্বলতা, কমিশনের ওপর আস্থাহীনতা এবং আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচন এড়ানোর স্বার্থে কমিশনকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার বিনীত আহ্বান জানাই। একইসঙ্গে কমিশনকে স্মরণ করে দিতে চাই যে, সুষ্ঠু নির্বাচনই একমাত্র শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের পথ এবং সে পথ রুদ্ধ হলে অশান্তির মধ্য দিয়ে ক্ষমতা বদল হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়, যা কারও জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না এবং যার ফলে জাতি হিসেবে আমরা এক ভয়াবহ বিপদের দিকে ধাবিত হতে পারি। আর এজন্য কমিশনের সদস্যদেরও ইতিহাস ক্ষমা করবে না।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে আস্থাহীনতার একটি বড় কারণ হলো- এটি সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে গঠিত হয়েছে, যদিও আইনে স্বচ্ছ পদ্ধতিতে কমিশন গঠনের বিধান রয়েছে। আমরা নিশ্চিত নই তরিকত ফেডারেশনের মতো বিশেষ দলের সুপারিশে এবারও কমিশনাররা নিয়োগ পেয়েছে কি না। অনেকেরই স্মরণ আছে যে, তরিকত ফেডারেশনের সুপারিশে ২০১৭ সালে সিইসিসহ ৩ জন কমিশনার নিয়োগ পেয়েছিলেন। তথ্য অধিকার আইনে দরখাস্ত করেও এবার কোন দল কার নাম প্রস্তাব করেছে তা আমরা পাইনি। এ ছাড়াও, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন প্রণীত আচরণবিধি পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ না করার কারণে কমিশনাররা তাদের শপথ ভঙ্গ করেছেন বলে আমাদের বিশ্বাস। কমিশনারদের অসংলগ্ন বক্তব্য এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করে সরকারি দলের প্রস্তাব অর্ধেক গ্রহণ করে ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহকে আরও উস্কে দিয়েছে বলে আমাদের আশঙ্কা।
এমনি পরিস্থিতিতে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে কমিশনকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই।
Comments