শোকজেই শেষ নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ

গত রোববার পর্যন্ত নির্বাচনী তদন্ত কমিটি ৬২ জন প্রার্থীকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য নোটিশ দিয়েছে।

আগামী সাত জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটলেও নির্বাচন কমিশন নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

নির্বাচনী আচরণবিধির ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, প্রার্থীরা নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।  এই ধারায় রাজনৈতিক দলগুলোকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করতে পারে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু এখন পর্যন্ত কমিশনের কর্মকাণ্ড শুধু ৬০ জনের বেশি প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য বা আওয়ামী লীগের নেতা কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তারা।

এই ধরনের দায়মুক্তি ভোগ করার কারণে বর্তমান সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ইচ্ছামতো নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, গত রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্বাচনী তদন্ত কমিটি ৬২ জন প্রার্থীকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য নোটিশ দিয়েছে।

ডেইলি স্টারের কাছে তাদের মধ্যে ৩৮ জনের নাম রয়েছে- যাদের মধ্যে ৩১ জন আওয়ামী লীগের মনোনীত এবং বাকি সাত জন স্বতন্ত্র বা অন্য দলের।

৩৮ প্রার্থীর মধ্যে ২৫ জন আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য, তিন জন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য এবং একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রয়েছেন।

যাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, পটুয়াখালী-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মহিবুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, মাগুরা-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাকিব আল হাসান এবং সুনামগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ সাদিক।

নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের মধ্যে রয়েছে মনোনয়নপত্র জমার সময় মিছিল, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর সমাবেশ, সমাবেশে ভোট চাওয়া এবং নির্বাচনী প্রচারে সরকারি যানবাহন ব্যবহার করা।

নির্বাচনী বিধিমালার আওতায় এগুলোর কোনোটিই অনুমোদিত নয়। কারণ ১৮ ডিসেম্বর নির্ধারিত প্রতীক বরাদ্দ না হওয়া পর্যন্ত প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবেন না।

কয়েকজন নিয়ম লঙ্ঘনকারী আবারও একই কাজ করেছেন।

নির্বাচনী আইন ভঙ্গের ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে আছেন নাটোর-২ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল।

এছাড়াও নাটোর আওয়ামী লীগের সহসভাপতিও তিনি। অতীতে অন্তত চার বার নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন। যার মধ্যে ২০১৫, ২০১৬, ২০২১ এবং ২০২২ সালে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরমেয়র ও জেলাপরিষদ নির্বাচন রয়েছে।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সালে যখন তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, তখন তিনি ইসির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি আর নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করবেন না।

তবে তারপরও ২০১৬, ২০২১ ও ২০২২ সালে তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি।

এবার গত ২৮ নভেম্বর শিমুল তার নির্বাচনী এলাকায় জনসভা ও মিছিল করে যানজটের সৃষ্টি করেন।

এ ঘটনায় সহকারী জজ শারমিন খাতুনের নেতৃত্বে নাটোর-২ নির্বাচনী তদন্ত কমিটি ব্যাখ্যা চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে।

জবাবে সংসদ সদস্য এই অপরাধের পুনরাবৃত্তি না করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং ১ ডিসেম্বর তদন্ত কমিটি তাকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য ইসির কাছে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানান নাটোর আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোজাম্মেল হক।

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য শিমুলকে ফোন কল ও মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি রিপ্লাই করেননি।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দুই দিন পর ১৭ নভেম্বর একটি স্কুল মাঠে জনসভা করেন রাজশাহী-১ আসনের আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী।

গত ২২ নভেম্বর নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে তাকে সতর্ক করে ইসি।

ওমর ফারুক যিনি একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী তারপরও গত ২ ডিসেম্বর তানোর পৌরসভা এলাকায় সমাবেশ করে ভোট চান।

গত রোববার রাজশাহী-১ আসনের নির্বাচনী তদন্ত কমিটি তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে আজকের মধ্যে তার পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দিতে বলেছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া প্রতিবেদন অনুসারে, এর আগেও নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে রাজশাহীর এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে বৈঠক করে একজন প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান তিনি। এর আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় নির্বাচনী আইন ভঙ্গের দায়ে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।

তাকে ফোন কল এবং টেক্সট মেসেজ পাঠানো হলে তিনিও কোনো রিপ্লাই দেননি।

গত ৩০ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, 'কোনো প্রার্থী নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

গতকাল পর্যন্ত ইসি কাউকে বিচারের আওতায় আনেনি।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তার উচিত ছিল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে 'তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা' নেওয়া।

এর পরিবর্তে ইসি নির্বাচনী তদন্ত কমিটির ওপর নির্ভর করছে, যাদের তিন দিনের মধ্যে এই জাতীয় অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত ও সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

তিনি গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিন্তু তারা (কমিটি) কী সুপারিশ করছে তা আমরা জানি না। আমরা নির্বাচন কমিশনকে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখিনি।'

জনগণ এইসব নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের দিকে নজর রাখছে এবং এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এই সমস্ত কিছু (নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়) সামগ্রিক প্রভাব আছে।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, তদন্ত কমিটিগুলোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সুপারিশ করার কথা রয়েছে।

'কিন্তু আমরা এখনও কোনো তদন্ত কমিটির কাছ থেকে এ ধরনের কোনো সুপারিশ (শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে) পাইনি। কমিশন সুপারিশ পাওয়ার পরেই বিষয়টি বিবেচনায় নেবে, বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

5h ago