প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণী কখনো যাচাই করেনি নির্বাচন কমিশন
নির্বাচনের আগে প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণী জমা দিতে হয় নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষেও সব প্রার্থী তাদের সম্পদের হিসাব দিয়েছেন।
কিন্তু, প্রার্থীদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নেয়নি নির্বাচন কমিশন, যদিও তা করার সক্ষমতা আছে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটির। এতে প্রার্থীদের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসির আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে, সম্পদের হিসাব যাচাই-বাছাইয়ে ইসির সক্ষমতা নেই বলে দাবি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রার্থীদের সম্পদের হিসাব যাচাই-বাছাইয়ের সক্ষমতা ইসি'র থাকলে ভালো হতো। এতে বাধা নেই। কারণ সংবিধান অনুযায়ী ইসি'র যে কোনো কাজে সহযোগিতা করা নির্বাহী বিভাগের কর্তব্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও সচিব বদিউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সম্পদের হিসাব যাচাই করতে নির্বাচন কমিশন এনবিআরকে বলতে পারে। আর যাদের সম্পদ নিয়ে বেশি সন্দেহ হয় তাদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বলতে পারে। তারা এই কাজটি সহজেই করতে পারে।'
সংবিধানে বলা হয়েছে, যে কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ ইসিকে সহায়তা করতে বাধ্য। ইসি তাদের সহায়তা চাইলে প্রতিষ্ঠানগুলো সহযোগিতা করবে। উল্লেখ্য, সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, 'নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।'
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসেন বলেন, 'প্রার্থীদের জমা দেওয়া সম্পদের বিবরণ অবশ্যই যাচাই-বাছাই করা উচিত। যদি তারা (ইসি) স্বল্প সময়ের নোটিশে এটি করতে না পারে, তবে নির্বাচনের পরে যাচাই করার ব্যবস্থা থাকা উচিত।'
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রার্থীদের সম্পদের তথ্য নেওয়া নির্বাচন কমিশনের কাগুজে কার্যক্রম ছাড়া কিছু নয়। কোনো প্রার্থীর সম্পদ নিয়ে কখনো প্রশ্ন করা হয়েছে কি না জানা নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রার্থীদের হলফনামা পাওয়ার পরপরই ইসির তা ওয়েবসাইটে আপলোড করার কথা। কিন্তু এটা করতেও কয়েক সপ্তাহ লেগে যায়।'
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের জন্য হলফনামা জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে ফৌজদারি আইনে তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
২০২৩ সালের সংশোধিত আরপিএ অনুযায়ী, হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে প্রার্থিতা বাতিল করার বিধান রয়েছে।
২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট ইসিকে প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণী নিয়ে তা প্রকাশ করতে আদেশ দিয়েছিল।
আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশের ৩০০ আসনে অন্তত ১ হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তাদের মধ্যে ১৫০০ জনের বেশি ২৭টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী।
যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রার্থীদের সম্পদের তথ্য রেকর্ড করার বিধান থাকলে তা যাচাইয়েরও ব্যবস্থা থাকতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, '৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এটা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে সংশ্লিষ্টদের আগামী সংসদে আইনটি সংশোধনের কথা বিবেচনা করা উচিত। এতে সম্পদ বিবরণীর প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে।'
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। দেশের অন্যতম প্রাচীন এ দলটি ক্ষমতাসীনদের সম্পদের হিসাব প্রকাশের বিষয়ে কঠোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পর্যায়ক্রমে তারা সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার বিশ্লেষণ করে এমন তথ্যই মিলেছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৫টি অগ্রাধিকার ঘোষণা করেছিল। তার মধ্যে দ্বিতীয় নম্বরে 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা' নেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। এতে আরও বলা হয়েছিল, 'ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনোপর্জিত আয়, ঋণখেলাপী, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালোটাকা ও পেশীশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
দলটির ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও সম্পদের হিসাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালের ইশতেহারে থাকা 'ক্ষমতাধরদের' শব্দটি ছাঁটাই করা হয়েছে। তার বদলে ২০১৪ সালের ইশতেহারের 'দুর্নীতি প্রতিরোধ' শীর্ষক অংশে বলা হয়েছে, 'নিজেদের সম্পদ, আয়-রোজগার সম্পর্কে "সর্বস্তরের নাগরিকদের" জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।' অর্থাৎ 'ক্ষমতাধরদের' বদলে 'দেশের সকল নাগরিকদের' সম্পদের হিসাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালে দেওয়া আওয়ামী লীগের ইশতেহার থেকে সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টিই বাদ দেওয়া হয়েছে। তার বদলে 'দুর্নীতি-দুর্বত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে' বলে উল্লেখ করা হয়।
আইনি উদ্যোগেও সুফল নেই
আওয়ামী লীগেরই সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ২০১০ সালে বেসরকারি বিল হিসেবে 'সংসদ সদস্য আচরণ আইন' সংসদে উত্থাপন করেছিলেন। বিলটির সুপারিশে বলা হয়েছে, 'সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের পাশাপাশি জনগণের নিকট জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা থাকলে সংসদ সদস্যদের সম্মান ও মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি পাবে। পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্রে যেমন, ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্স, ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভা, কানাডিয়ান পার্লামেন্ট এবং সাউথ আফ্রিকান পার্লামেন্টে সংসদ সদস্যদের জন্য কোড অব কনডাক্ট রয়েছে।' কিন্তু এই খসড়াটি আইন হিসেবে পাসের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'সাবের হোসেন চৌধুরী প্রস্তাবিত বিলটি জাতীয় সংসদে পাস হলে সংসদ সদস্যরা সম্পদের হিসাব প্রতি বছর প্রকাশ করতে বাধ্য হতেন। এতে সম্পদের হিসাব গ্রহণে স্বচ্ছতার মাত্রা আরও বাড়তো। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া শক্তিশালী ভিত্তি পেত। কিন্তু সেটা আলোর মুখ দেখেনি।'
প্রসঙ্গত, প্রার্থীদের অস্বাভাবিকহারে সম্পদ বাড়ার বিষয়ে গত ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকরা। আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজধানীর ধানমন্ডির অফিসে করা এক ব্রিফিংয়ে তখন ওবায়দুল কাদের বলেন, 'নির্বাচন কমিশন যদি কাউকে দুর্নীতিবাজ মনে করে, সেটা তাদের ব্যাপার। যদি কমিশন এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন না করে, তাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়, অনুমতিপ্রাপ্ত কাউকে তো এই মুহূর্তে আপনি দুর্নীতিবাজ বলতে পারেন না।'
অন্যদিকে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে নির্বাচনী প্রার্থীদের সম্পদের হিসাব দেখে অবাক হওয়ার কথা জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুলতানা কামাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখন পত্রিকা পড়তে থাকি, আমি ভাবতে থাকি, আমি কি একটা বাস্তব জগতে বাস করছি! এটাও সম্ভব! একেকজন মানুষের সম্পদ ২০০ গুণ, ৩০০ গুণ, ৪০০ গুণ বেড়েছে!'
'প্রার্থীদের সম্পদের হিসাব অবশ্যই যাচাই করে দেখা উচিত। না হলে হিসাব নিয়ে কী লাভ?,' বলেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সম্পদের হিসাব যাচাইয়ের দায়িত্ব ইসির নয়। আরপিও প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণী যাচাই-বাছাই করা ইসির জন্য বাধ্যতামূলক করেনি।'
'এনবিআর বা দুদক চাইলে সম্পদের তথ্য যাচাই করতে পারে,' বলেন তিনি।
Comments