নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে আপত্তি ইসির

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
ছবি: স্টার ফাইল ফটো

নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি এবং নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে তদন্তসহ ১০টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

গতকাল সোমবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজকে পাঠানো এক চিঠিতে ইসি সতর্ক করে জানিয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা হলে সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে।

চার মাসের সময়সীমার মধ্যে জাতীয় ও স্থানীয় সব নির্বাচন সম্পন্ন করার প্রস্তাবে ইসি দ্বিমত জানিয়ে বলেছে, অভিজ্ঞতা বলছে, ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত হওয়ায় শুধুমাত্র স্থানীয় সরকার নির্বাচন শেষ করতেই প্রায় এক বছর লেগে যায়।

নির্বাচন কমিশনারদের ব্যর্থতার তদন্তের দায়িত্ব সংসদীয় কমিটিকে দেওয়ার বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবেরও আপত্তি জানিয়েছে ইসি।

এছাড়া, প্রস্তাবিত নির্বাচন কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫-এরও বিরোধিতা করেছে। যেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে নির্বাচন কমিশনারদের জন্য ফৌজদারি দায়বদ্ধতা আরোপের কথা বলা হয়েছে।

ইসি বলছে, এই বিধান কমিশনারদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করবে এবং তাদের রাজনৈতিক চাপের মুখে ফেলবে।

এতে আরও যুক্তি দেওয়া হয়েছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ইতোমধ্যেই এই বিষয়টি পরিচালনা করছে এবং এই ধরনের বিধান যোগ করা হলে ইসির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে দুর্বল করবে।

ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য আলাদা কমিশন গঠন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতাকে ক্ষুন্ন করবে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করবে।

গতকাল ইসি সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আখতার আহমেদ বলেন, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে ইসির স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে।

সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত ভোটার তালিকা ব্যবস্থাপনা এবং জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ জাতীয় নাগরিক তথ্য কমিশনের কাছে হস্তান্তরের বিষয়েও দ্বিমত পোষণ করেছে ইসি।

ইসি জানিয়েছে, এতে ইসির স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনার ক্ষমতা দুর্বল হবে এবং সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন হবে, যেখানে নির্বাচন কমিশনের কার্যাবলীর রূপরেখা দেওয়া আছে।

পলাতক ব্যক্তিদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে কমিশন আপত্তি জানিয়েছে বলেছে, এই ধরনের বিধিনিষেধ নির্বাচনী সংস্কারের মাধ্যমে নয়, বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে মোকাবিলা করা উচিত।

অনলাইনে জমা দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার পরিবর্তে প্রার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার প্রস্তাবের সঙ্গে ইসি দ্বিমত জানিয়েছে। এই প্রসঙ্গে, ইসি পর্যাপ্ত লজিস্টিক সহায়তা এবং প্রার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে মনোনয়ন দাখিল করতে বাধার সম্মুখীন হওয়ার পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।

শুধুমাত্র নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে ইসি। জানিয়েছে, নিয়োগগুলো কঠোর নিয়মের পরিবর্তে যোগ্যতা এবং পদমর্যাদার ভিত্তিতে হওয়া উচিত।

কমিশন সরকারের সমন্বিত তহবিলের পরিবর্তে সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছে, সতর্ক করে দিয়েছে যে এই পদক্ষেপ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বাড়িয়ে তুলবে এবং ইসির আর্থিক স্বাধীনতার সঙ্গে আপস করবে।

নির্বাচন-সম্পর্কিত মামলা দায়েরের জন্য সময়সীমা তুলে নেওয়ার সুপারিশের সঙ্গেও ইসি একমত হয়নি। ইসি জানিয়েছে, এটি বিরোধগুলো দীর্ঘায়িত করবে এবং রাজনৈতিক হয়রানি বাড়াবে।

কমিশন সংক্ষুব্ধ রাজনৈতিক দলগুলোকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল চ্যালেঞ্জ করার অনুমতি দেওয়ার বিষয়েও আপত্তি জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে ১৯৭২ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে ইতোমধ্যেই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নির্বাচন চ্যালেঞ্জের ব্যবস্থা রয়েছে।

ইসির চিঠি, যার অনুলিপি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।

প্রক্সি ভোটিং

প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ইসি প্রক্সি ভোটিং সিস্টেমকে সবচেয়ে ভালো বিকল্প হিসেবে সমর্থন দিয়েছে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের একজন মনোনীত ভোটার প্রবাসী বাংলাদেশির পক্ষে ভোট প্রদান করতে পারবেন।

নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ গতকাল ইসি সচিবালয়ে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মিশন প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এসব বিষয়ে জানান।

'আমরা যদি সত্যিই আমাদের প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই একটি বিকল্প অথবা একাধিক বিকল্পের সমন্বয়কে গ্রহণ করতে হবে,' তিনি বলেন।

ইসি এর আগে জানিয়েছিল, তারা প্রবাসীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার সঙ্গে পোস্টাল ব্যালট সিস্টেম এবং অনলাইন ভোটিং সিস্টেমও বিবেচনা করছে।

গতকালের ব্রিফিংয়ে প্রক্সি ভোটিং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উপর আস্থার অভাব তৈরি করবে কিনা জানতে চাইলে আবুল ফজল বলেন, 'যদি আমরা বৃহৎ পরিসরে প্রবাসীদের ভোটদান সহজ করতে চাই, তাহলে প্রক্সি ভোটিংই একমাত্র বাস্তবসম্মত সমাধান বলে মনে হচ্ছে। অন্য দুটি পদ্ধতি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে পরীক্ষা করা যেতে পারে, তবে বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নাও হতে পারে।'

তিনি বলেন, 'এই পদ্ধতি (প্রক্সি ভোটিং) ইতোমধ্যে ভারতের প্রতিরক্ষা কর্মীদের জন্য চালু আছে। এছাড়া, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের মতো কয়েকটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশেও এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। পোস্টাল ব্যালট এখন আর আমাদের জন্য কার্যকরী নয়। ব্যালট পেপার ছাপানো এবং ভোটের দিনের মধ্যে ব্যালট পাঠানো, সংগ্রহ করা এবং গণনার জন্য ফেরত আনতে খুব কম সময় থাকে।

কমিশনার আরও বলেন, 'দ্বিতীয় বিকল্প হলো অনলাইন ভোটিং। তবে, মিশরের রাষ্ট্রদূত যেমন উল্লেখ করেছেন, অনলাইন ভোটিংয়ে তাদের অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না, যার ফলে তারা এই ব্যবস্থাটি বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত অনলাইন ভোটিং সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বললেও, তারা এটি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি।'

বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন, তিনজন নির্বাচন কমিশনার এবং ইসি সচিব, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রের মিশন প্রধানদের অবহিত করেন।

আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, ব্রুনেই দারুসসালাম, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মরক্কো, ওমান, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন, কাতার, সৌদি আরব, তুরস্ক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মিশন প্রধানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বৈঠকে। তবে, সৌদি আরব এবং তুরস্কসহ সাত দেশের রাষ্ট্রদূত বা প্রতিনিধিরা বৈঠকে অংশগ্রহণ করেননি।

Comments

The Daily Star  | English
rohingya-migration

Persecuted by Arakan Army, Rohingyas fleeing to Bangladesh

Amid escalating violence in Myanmar’s Rakhine State, Rohingyas are trespassing into Bangladesh every day, crossing the border allegedly to escape the brutality of Myanmar’s rebel group, the Arakan Army (AA).

1h ago