গরিবের ভরসা ‘ইঁদুরধান’

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ফলিমারী গ্রামের একটি খেতে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান কুড়াচ্ছেন এক নারী। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

'পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা এই ভাড়ারের দেশে' ধানের সঙ্গে কৃষক ও ইঁদুরের সম্পর্ক স্থাপনে জীবনানন্দ দাশ যে চিত্রকল্প এঁকেছিলেন তা এ রকম– 'সবুজ ধানের নিচে—মাটির ভিতরে/ইঁদুরেরা চ'লে গেছে; আঁটির ভিতর থেকে চ'লে গেছে চাষা;/শস্যের খেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা।'

কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর দেশে ইঁদুরের কারণে গড়ে ৫০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী ইঁদুরের উৎপাত নিয়ে করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যতম ইঁদুর উপদ্রুত এবং বংশবিস্তারকারী এলাকা হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

আবার আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রের (ইরি) ২০১৩ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যে পরিমাণ ধান-চাল খেয়ে নষ্ট করে, তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। আর শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০ থেকে ৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে।

বাংলাদেশে আমন ধানের মৌসুমেও ফসলের খেতে ইঁদুরের খুব উৎপাত দেখা দেয়। ইঁদুর খেতের পাকা ধান কেটে গর্তে রাখে।

আর আমন ধান কাটার সময় এসব ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহের রীতিও বেশ পুরোনো। গর্ত থেকে সংগৃহীত এই পরিচিত 'ইঁদুরধান' হিসেবে।

গ্রামাঞ্চলে সাধারণত ভূমিহীন ও দরিদ্র মানুষরাই খেতে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহের কাজ করেন। বিশেষ করে হেমন্তে আমন ধান কাটার মৌসুমে অনেক নারী ও শিশুকে এভাবে ধান সংগ্রহ করতে দেখা যায়। কেউ কেউ ১০-১২ দিনে ২৫-৩০টি গর্ত খুঁড়ে ৩-৪ মন ধানও সংগ্রহ করে থাকেন। তা দিয়ে তাদের বেশ কিছুদিনের খোরাকি হয়ে যায়।

এমন একজন 'ধানকুড়ানি' হলেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ফলিমারী গ্রামের সালেহা বেওয়া (৫৮)। তার পরিবারের নিজস্ব কোনো জমি নেই। ধানকাটার মৌসুমে তিনি মাঠে মাঠে ঘুরে গর্ত থেকে সংগ্রহ করেন ইঁদুরধান।

সালেহা বেওয়া জানান, প্রতিবছর এভাবে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ৪ মনের বেশি ধান পান। তাতে তার ২ মাস চলে যায়। তিনি বলেন, 'অভাব আছে দ্যাখিতো হামরাগুলা ইন্দুরের খাইল (গর্ত) খুরি (খুঁড়ে) ধান আনি। হামরাগুলা ধানকুড়ানি হয়া গ্যাছি। ইন্দুরধান হামার সম্বল।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার উত্তর সাপ্টানা গ্রামের আরেক ধানকুড়ানি বাচ্চা রানীর (৫০) কাছ থেকে জানা যায়, একেকটি গর্ত খুঁড়ে ধান বের করতে ২-৩ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই কাজ। আবার অনেক সময় ইঁদুরের গর্ত থেকে সাপ বেরিয়ে আসে। তাই সাবধানেই কাজটি করতে হয়।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বৈদ্যের বাজার এলাকার ধানকুড়ানি হালিমা বেগম (৪৫) জানান, গত বছর তিনি তার ২ মেয়েকে নিয়ে ইঁদুরের গর্ত থেকে ৯ মনের মতো ধান সংগ্রহ করেছিলেন। এবার ৬-৭ মন ধান পেতে পারেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

হালিমা বেগম বলেন, 'হামারতো আর জমি নাই যে ধান আবাদ করমো। ইন্দুরের খাইল (গর্ত) খুঁড়ি কিছু ধান পাই। তাক দিয়া ২-৩ মাস সংসার চলে।'

এই গ্রামের কৃষক নরেশ চন্দ্র বর্মণের (৬৫) ভাষ্য, ইঁদুর ফসলের বড় শত্রু। তাই ধানকুড়ানিরা ইঁদুরের গর্ত খুঁড়লেও তাদের বাধা দেওয়া হয় না। কারণ গর্ত খুঁড়লে খেত থেকে ইঁদুর পালিয়ে যায়।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হামিদুর রহমান বলেন, 'কেবল আমন ধানের মৌসুমেই মাঠে মাঠে ধানকুড়ানিদের দেখা মেলে। এই ইঁদুরধান সংগ্রহের বিষয়টি বাংলার আবহমান কৃষি সংস্কৃতিরই অংশ।'

Comments

The Daily Star  | English

Is the govt backing the wrongdoers?

BNP acting Chairman Tarique Rahman yesterday questioned whether the government is being lenient on the killers of a scrap trader in front of Mitford hospital due to what he said its silent support for such incidents of mob violence.

4h ago