আশ্রয়ণের ঘর এখন ‘মাদকসেবীদের আস্তানা’

জামালপুরের সরিষাবাড়িতে সুফল বয়ে আনেনি মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর। কর্মসংস্থান, বসবাসের পরিবেশ, এমনকি যাতায়াতের রাস্তা ছাড়াই দুর্গম চরাঞ্চলে বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প ফেজ-২।
সুবিধাভোগীরা ছেড়ে যাওয়ায় খালি পড়ে আছে আশ্রয়ণের ঘরগুলো। ছবি: স্টার

জামালপুরের সরিষাবাড়িতে সুফল বয়ে আনেনি মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর। কর্মসংস্থান, বসবাসের পরিবেশ, এমনকি যাতায়াতের রাস্তা ছাড়াই দুর্গম চরাঞ্চলে বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প ফেজ-২।

এসব ঘরে মানুষ না থাকায় মাদকসেবীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে বলে জানা গেছে।

১ বছর না যেতেই অধিকাংশ ঘরে ফাটল, সুপেয় পানির সংকট এবং সন্ধ্যা নামলেই ভূতুড়ে পরিবেশের কারণে ঘর ছেড়ে যাচ্ছেন উপকারভোগীরা। প্রভাবশালী দালালচক্রের পছন্দের জায়গা ও প্রশাসনের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবে পানিতে যেতে বসেছে সরকারের কোটি টাকা। এর ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সরকারের উন্নয়ন এবং প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

সরিষাবাড়ি উপজেলার আওনা ইউনিয়নের দুর্গম ঘুইঞ্চার চর আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে এমনই চিত্র দেখা গেছে।

তবে, প্রশাসন জানিয়েছে, বরাদ্দ পাওয়ার পরও যারা ঘরে থাকছেন না, তাদের দলিল বাতিল করে নতুনদের বরাদ্দ দেওয়া হবে।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প হাতে নেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের (ফেজ ২) অধীনে সরিষাবাড়ি উপজেলায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ম পর্যায়ে ২৯৫টি ঘর বরাদ্দ হয়। প্রতিটি ঘরের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। ২য় পর্যায়ে প্রতিটি ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় ২৫টি ঘর৷

২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতিটি ২ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় আরও ৩টি ঘর। এর মধ্যে ১ম পর্যায়ে আওনা ইউনিয়নের যমুনা নদীঘেঁষা দুর্গম এলাকা ঘুইঞ্চার চরে নির্মিত ১৪৬টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। উপজেলার সর্বমোট ৩২৩টি ঘরই নির্মাণ সম্পন্ন ও উদ্বোধনের পর উপকারভোগীদের হাতে দলিল হস্তান্তর দেখানো হলেও বাস্তবে এর উল্টো প্রমাণ মিলেছে।

সরেজমিনে ঘুইঞ্চার চরে দেখা যায়, ২টি নদী পার হয়ে এবং প্রায় ৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যেতে হয় আশ্রয়ণ প্রকল্পে। যাতায়াতের রাস্তা বলতে খেতের সরু আইল। এর আশেপাশে নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, এমনকি কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা। সন্ধ্যা নামলেই পুরো এলাকায় গা ছমছমে পরিবেশ।

১৪৬টি ঘরের মধ্যে মাত্র ১৫-১৬টি ঘরে উপকারভোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। বাকি ঘরগুলোতে তালা ঝুলছে। বেশ কয়েকটি ঘরের দেওয়াল ও মেঝেতে ফাটলও ধরেছে। টিনের চালে স্ক্রুর বদলে তারকাঁটা ব্যবহার করায় বৃষ্টি পানি চুইয়ে ঘরের ভেতরে পড়ে।

প্রধানমন্ত্রীর উপহার লেখা সম্বলিত সাইনবোর্ডগুলো টানানো হয়নি কোনো ঘরেই। একটি ঘরের মেঝেতে সেগুলো অযত্নে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

স্থানীয়রা জানায়, আশ্রয়ণ প্রকল্প ফাঁকা পড়ে থাকায় স্থানীয় কৃষকরা প্রখর রোদে খেতে কাজ করে ক্লান্তি দূর করার জন্য সেখানে বসেন। অধিকাংশ ঘরের বারান্দায় চরাঞ্চলের মানুষ দিনে গরু-ছাগল বেঁধে রাখেন। আগাছায় ভরে গেছে অনেক ঘরের প্রাঙ্গণ। বসবাসের অনুপযোগী হওয়ায় মানুষ এসব ঘর ছেড়ে যাচ্ছেন।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ১৫টি অগভীর নলকূপ এখানে দেওয়া হলেও ১৪টি চুরি হয়ে গেছে। অবশিষ্ট আছে মাত্র একটি। সেটিরও পানিতে প্রচুর আয়রন থাকায় এই নলকূপ ব্যবহার করেন না কেউই।

এ ব্যাপারে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য উপজেলায় মোট ৩৭টি অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ঘুইঞ্চার চরে ১৫টি স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি নলকূপের খরচ পড়েছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি নলকূপের গভীরতা ৬১ মিটার, ফলে পানিতে আয়রন থাকলেও কিছু করার নেই।'

তিনি বলেন, 'মালিকানা হস্তান্তরের পর চুরি প্রতিরোধে উপকারভোগীদেরই সজাগ থাকতে হবে। সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই।'

বেহাল দশায় পড়ে আছে আশ্রয়ণের ঘরগুলো। ছবি: স্টার

সুবিধাভোগীদের একজন শাহীনুর বেগম (৪৫)। তিনি এসেছেন দৌলতপুর থেকে। শাহীনুর বলেন, 'সরকার অনেক টাকা খরচ করে ঘর দিয়েছে। অথচ এই এলাকায় কোনো রোজগার করার উপায় নেই। এমনকি সরকারি কোনো রিলিফ, ভাতা বা আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হয় না। এই কারণে এখানে থাকার পরিবেশ নেই।'

সুবিধাভোগী আনোয়ার হোসেন বলেন, 'সরকার ঘর দিলেও, কাজ দেয়নি। মানুষের কাছে হাত পেতে চলতে হয় আমাকে। কিন্তু আশ্রয়ণের এই ঘরে এমন জায়গায়, ভিক্ষা করারও উপায় নেই।'

মফিজ উদ্দিন বলেন, 'তারাকান্দি থেকে বড় আশা নিয়ে এখানে এসেছিলাম। অথচ এখানে গরু-ছাগলও চরানোর উপায় নেই। যাতায়াতের রাস্তা নেই, কোনো ব্যবসা করার সুযোগ নেই। এই ঘরে থাকতে হলে বহু দূরে গিয়ে কাজ করতে হবে, নয়তো না খেয়ে পড়ে থাকতে হবে এখানে।'

তিনি আরও বলেন, 'রাতে যে আরামে ঘুমাবেন, সেই উপায়ও নেই। জিনিসপত্র চোরে নিয়ে যায়।'

শিক্ষার্থী শাকিল মিয়া বলেন, 'আশেপাশে কোথাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। প্রতিদিন ৫-৬ মাইল পায়ে হেঁটে দৌলতপুর মাদরাসায় পড়তে যেতে হয়। অনেক কষ্ট হয় এত রাস্তা হাঁটতে। এই কারণে প্রায়ই মাদরাসায় যাওয়া হয় না।'

রেহানা বেগম জানান, ১৫টির মধ্যে ১৪টি চুরি যাওয়ার পর যে একটা নলকূপ অবশিষ্ট আছে, সেটার পানিতেও আয়রন ও দুর্গন্ধ। এই পানি খাওয়া ও অন্যান্য ব্যবহারের অনুপযোগী বলে দেড়-দুই মাইল দূর থেকে সবাইকে পানি এনে ব্যবহার করাতে হয়।

এদিকে ঘর ছেড়ে সুবিধাভোগীরা চলে যাওয়ায় বিল বকেয়া পড়ছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির। মানুষ না থাকলেও মিটার থাকায় মাসে মাসে বিল ধার্য হচ্ছে প্রতিটি হিসাব নম্বরের বিপরীতে। বিলের কপি পড়ে থাকছে ঘরগুলোর দরজার ফাঁকে।

এ ব্যাপারে সরিষাবাড়ি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার নুরুল হুদা বলেন, 'অনেক ঘরে মানুষ না থাকায় বিল বকেয়া পড়ছে। এর মধ্যে কিছু গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে।'

সরিষাবাড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. গিয়াস উদ্দিন পাঠান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো খালি পড়ে থাকায় সেখানে মাদকসেবীদের আস্তানা গড়ে উঠেছে। তারা নির্বিঘ্নে সেখানে মাদক সেবন করছে।'

তিনি অভিযোগ করে বলেন, 'এই দুর্গম চরে আশ্রয়ণ প্রকল্প করার আছে আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের পরামর্শ করা হয়নি, এমনকি আমাদেরকে পরিদর্শনেও নেওয়া হয়নি। এমন একটি জায়গা, যেখানে কোনো রাস্তা-ঘাট নেই, কোনো কাজের ব্যবস্থা নেই, সেখানে মানুষ থাকবে কীভাবে?'

আশ্রয়ণ প্রকল্পের এমন বেহাল দশা নিয়ে কথা হয় সরিষাবাড়ি উপজেলার নির্বাহী অফিসার উপমা ফারিসার সঙ্গে। তিনি বলেন, 'আমি যোগদানের আগে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো করা হয়েছে। শুরুতে ঘর নেওয়ার জন্য অনেকের আগ্রহ ছিল বলে শুনেছি। ঘুইঞ্চার চরের ঘরগুলোতে বসবাসের উপযোগী করতে আমরা চেষ্টা করছি। এ ছাড়া, চলাচলের রাস্তাও নির্মাণ করা হচ্ছে।'

Comments