১৯ বছরে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ৩৮৭৩

বাংলাদেশে ১৯ বছরে ৩ হাজার ৮৭৩টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৪৬৬টি এবং ২০২২ সালে সর্বনিম্ন ১৮টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

বাংলাদেশে ১৯ বছরে ৩ হাজার ৮৭৩টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৪৬৬টি এবং ২০২২ সালে সর্বনিম্ন ১৮টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের অভিযোগে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং র‌্যাব ও পুলিশের সাবেক ও বর্তমান ৬ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আসার কারণেই চলতি বছরে সবচেয়ে কম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৪ সালে ২০৭টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০০৫ সালে ৩৭৭টি, ২০০৬ সালে ৩৫২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

গত ৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে ২০১৭ সালে ১৬২টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০১৮ সালে ৪৬৬টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, যা ১৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৯ সালে ৩৮৮টি এমন হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০২০ সালে এই সংখ্যাটি কিছুটা কমে ২২২ হয়। আর গত বছর দেশে ৮০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ঘটেছে ১৮টি।

২০১৭ থেকে ২০২২ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে পুলিশ। বাহিনীটির হাতে ৭০৩টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। একই সময়ে র‌্যাব ৩৬৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৮ সালে দেশে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চলে। সেবছর বিভিন্ন এলাকায় মানুষ নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তাই সেবছর সংখ্যাটি বেশি। ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র থেকে র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আসার ফলে আমরা দ্রুত দেখলাম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিশেষ করে ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা কমে গেল। এই সময় গুমের ঘটনাও কমে যায়। যদিও পরবর্তীতে জঙ্গি তকমা দিয়ে অনেককে তুলে নেওয়া হয়। অনেককে আবার আদালতে উপস্থাপন করা হয়।'

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কেন ঘটে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'রাষ্ট্র যখন কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ধাবিত হয় এবং জনগণ যখন তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, জনসমর্থিত না এমন সরকার নির্বাচিত হয়, সরকার যখন জনবিচ্ছিন্ন থেকে তার কাজ পরিচালনা করতে চায়, তখন নানান দিক থেকে সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখোমুখি হতে পারে। এটি সরকার স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। সেই কারণে সমাজে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হয়। যেখানে মানুষ তার অধিকার নিয়ে কথা বলবে না। এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়। যার কারণে মানুষের মধ্যে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। ফলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে।'

বিচার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, 'সরকার যারা পরিচালনা করেন, তারা চাইলে রাতারাতি ক্রসফায়ার বন্ধ সম্ভব। গুমের ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব। এটা সম্ভব বলেই আওয়ামী লীগ এই বিষয়ে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। নিশ্চয়ই তারা পারবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তাদের প্রয়োজনে সেটা দরকার, তাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত আছে।'

বাংলাদেশে সার্বিকভাবে মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন দেখছেন জানতে চাইলে নূর খান বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে আমরা লক্ষ্য করছি বাংলাদেশের মানবাধিকার সংকুচিত হতে হতে এমন একটা জায়গায় চলে এসেছে, এখানে আর মানুষের মানবাধিকার সমুন্নত আছে এটা বলা যাবে না। মানবাধিকার একটি বিভীষিকাময় অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ন্যায্যবিচার কমে গেছে, মানুষ অধিকার আদায়ের দাবি হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার থেকে মানুষ এখন চূড়ান্তভাবে বঞ্চিত। মানুষের চলাফেরা, কথা বলা, সমাবেশ করার যে অধিকার, তার সবকিছু এখন সংকুচিত। এক কথায় বলতে গেলে কর্তৃত্ববাদী শাসন ও পুলিশি ব্যবস্থার মধ্যে আমরা আছি। আজকে সমাবেশ করতে হলে অনুমতি নিতে হয়। নানা বিধিনিষেধ দিয়ে মানবাধিকারকে বেঁধে ফেলা হয়েছে। সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে জনগণের অধিকারকে সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। আমরা একটি বিভীষিকাময় অবস্থার মধ্যে আছি।'

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'জনগণের শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। দেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে। এগুলো পুনর্জীবিত করার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। এই উদ্যোগ হতে হবে জনগণের শাসনব্যবস্থা কায়েমরে মধ্য দিয়ে। সবাইকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। দলীয় রাজনীতি দিয়ে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না।'

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের এখানে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটতো না। আইনের শাসন যতটা প্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল, আমরা ততটুকু পারিনি। আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আমরা এখনো তেমনিভাবে তা করতে পারিনি। বারবার এসব থেকে পিছিয়ে গেছি। অপরাধীরা ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে আসত। আইনের প্রয়োগ যতটা শক্তিশালী হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। এক কারণেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটে থাকতে পারে।'

কাজী রিয়াজুল হক ২০১৬ সালের ২ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন।

২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং চলতি বছর সবচেয়ে কম। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা বা সংগঠন যে তথ্য দেয়, সেগুলো নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা আছে, বিতর্ক আছে। আমি জানি না তারা কিসের ভিত্তিতে এসব তথ্য দিয়েছে। তাদের দেওয়া সব ঘটনার প্রমাণ আছে কি না, তা আমার জানা নেই। তবে বর্তমানে আমাদের দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা বেশ কয়েকটি অপারেশন ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছে। এ কারণে এই হত্যাকাণ্ড কমে যেতে পারে। কয়েকটি ঘটনায় শাস্তি হয়েছে। যার ফলে অপরাধগুলো একটু কমতে পারে।'

যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিষেধাজ্ঞা আসার কারণেই কি চলতি বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমেছে, এমন প্রশ্ন করলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, 'কে, কোথা থেকে নিষেধাজ্ঞা আনল, তার ফলে বাংলাদেশ অচল হয়ে যাবে, সেটা আমি বিশ্বাস করি না। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার সজাগ হয়েছে। সেকারণে মনে হয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে যাচ্ছে।'

Comments