সৌদিতে আহত হয়ে দেশে ফিরে হাসপাতালের মেঝেতে রাশিদা

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন সৌদিফেরত রাশিদা বেগম (৩৫)। ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আনতে ৩ মাস আগে সৌদি আরবে যান রাশিদা বেগম (৩৫)। গৃহকর্মী হিসেবে সেখানে যাওয়া এবং দুর্বিষহ অবস্থা থেকে পালাতে গিয়ে ৪ তলা থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন রাশিদা। ৩ মাস সেখানকার হাসপাতালে নামমাত্র চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া তাকে।

গত ২১ ডিসেম্বর সৌদি আরব থেকে ঢাকায় ফেরেন রাশিদা। পা ও কোমড়সহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ৭-৮টি ফ্র্যাকচার নিয়ে ঢাকা হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে আসেন তিনি। সম্প্রতি ডেইলি স্টারকে তিনি তার সেই অভিজ্ঞতা জানান।

রাশিদার বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জে। তার স্বামী নজরুল সরকার পেশায় রিকশাচালক।

'আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। স্বামী রিকশা চালায়। শুনছিলাম বিদেশে গিয়ে কয়েকদিন কাজ করলে ভালো উপার্জন করা যায়। সেই আশায় গ্রামের এক দালালকে ধরে ৩ মাস আগে সৌদি আরবে যাই,' বলেন রাশিদা।

'আমাকে ২-৩ মাসের চেষ্টায় সব কাগজপত্র করে দেওয়া হয়। পল্টন এলাকার একটি অফিস থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন বিমানবন্দরে এক লোক আমাকে বলেছিলেন, সৌদি আরবে যদি কোনো ছেলে খারাপ দৃষ্টিতে তাকায়, "দুকদুক" শব্দ বলে, তাহলে সর্তক হয়ে যেতে হবে।'

রাশিদা বলেন, 'দুকদুক শব্দের মানে কী আমি জানি না। তবে ওই লোক বলেন, এই শব্দ দিয়ে কুপ্রস্তাব বোঝায়। তিনি আমাকে সাবধান করেন।'

৯৫০ রিয়াল বেতনের চাকরির কথা বলা হয়েছিল রাশিদাকে। সৌদি আরবে পৌঁছানোর পর একটি ৪ তলা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। ৪ তলা বাড়ির দোতলায় একটি রুমে থাকতে দেওয়া হয়। শুরুতেই ওই বাড়ির লোকজন তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও পাসপোর্ট নিয়ে নেয়।

রাশিদা বলেন, 'ওই বাড়িতে অনেক লোকজন। কিন্তু রাত ১০টা পর্যন্ত আমার সাথে কেউ দেখা করতে আসেনি। এতক্ষণ আমাকে কোনো খাবারও দেওয়া হয়নি। কী কাজ করতে হবে সেসবও কেউ বলেনি।'

'রাতে এক লোক আমার রুমে এসে আমাকে বনরুটি, পানি আর আপেল দিয়ে যায়।'

ওই বাড়িতে দেড় দিন ছিলেন রাশিদা।

ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে রাশিদা রুম থেকে বের হন।

'রুম থেকে বের হয়েই দেখি যে লোক খাবার দিয়ে গিয়েছিল সে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখামাত্র তিনি 'দুকদুক' বলে ওঠেন। তখন আমি ভয় পেয়ে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেই। বিকেলে এক তরুণী আমার সাথে কথা বলতে আসে। আমি তাকে কাজের ব্যাপারে জানতে চাই। সে আমাকে কিছু জানায় না।'

রাশিদা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার কাছে ওই বাড়ির পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছিল না। আমি সেখান থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। ছেলের সঙ্গে কথা বলার জন্য ওই মেয়েটির কাছে আমি আমার ফোন ফেরত চাই। কিন্তু সে আমাকে অন্য একটা ফোন দেয়। আমি বাসায় ১ মিনিটও কথা বলতে পারিনি। তারা আমার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নেয়।'

'আমি ভয় পেয়ে যাই। বুঝতে পেরেছিলাম আমার ছেলেও আমাকে সেখান থেকে বের করতে পারবে না। আমার নিজেরই বের হতে হবে। ছাদে একটা পাইপ ছিল। আমি ওটা বেয়ে নিচে নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।'

পাইপ বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে ৪ তলা থেকে পড়ে যান রাশিদা। ভাঙা কোমড়- পা নিয়ে সৌদি আরবের হাসপাতালে ৩ মাস ভর্তি ছিলেন তিনি।

'হাসপাতালে কেউই আমার সাথে তেমন ভালো আচরণ করে নাই। আমি তাদের ভাষা জানি না। আমার কোনো সাহায্যকারীও ছিল না। পাসপোর্ট দিলেও ফোনটা আর ফেরত পাইনি। নামমাত্র চিকিৎসা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠায়ে দিয়েছে,' বলেন রাশিদা।

রাশিদার ছেলে নূর ইসলাম (২০) বলেন, 'আমাদেরকে ফাইজুল (দালাল) নিশ্চয়তা দিয়েছিল মা'কে কোনো খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না। কিন্তু এ ঘটনার পর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।'

 

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান হাসপাতালে বেড খালি নেই। তাই মেঝেতেই বিছানা করে থাকতে হচ্ছে রাশিদাকে। মায়ের এই অবস্থায় ছেলের চোখ ভিজে যায়।

'আমাদের ভালো রাখার জন্যই মা বিদেশে গিয়ে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন। এ ঘটনায় আমরা অনুতপ্ত। আমাদের কাছে মায়ের চিকিৎসাই এখন বড়। মা ভালো হয়ে বাড়ি ফিরুক এটাই আমরা চাই,' বলেন নূর।

সৌদি আরব থেকে আহত হয়ে গৃহকর্মী ফেরত আসার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে এখনও আসেনি। অভিযোগ পেলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

তিনি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রবাসী কর্মীদের জন্য যে নির্দেশনা দেওয়া আছে তা সবাইকে অনুসরণ করার জন্য অনুরোধ করেন।

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

7h ago