টাকা নয়, ‘ভালো কাজ’র বিনিময়ে খাওয়া যায় যে হোটেলে

কোনো সুসজ্জিত কক্ষ নেই, নেই চেয়ার-টেবিল, ক্যাশ কাউন্টার, এমনকি কোনো হট্টগোলও নেই। রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাত ঘেঁষে খোলা আকাশের নিচে বেঞ্চ পেতে পরিচালিত এই হোটেলে প্রতিদিন খেতে আসেন কয়েক শ মানুষ।
রাজধানীর পান্থকুঞ্জের ‘ভালো কাজের হোটেল’। ছবি: স্টার

কোনো সুসজ্জিত কক্ষ নেই, নেই চেয়ার-টেবিল, ক্যাশ কাউন্টার, এমনকি কোনো হট্টগোলও নেই। রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাত ঘেঁষে খোলা আকাশের নিচে বেঞ্চ পেতে পরিচালিত এই হোটেলে প্রতিদিন খেতে আসেন কয়েক শ মানুষ।

এই হোটেলে এক বেলা খাবার খেতে গেলে আপনাকে দিনে একটিমাত্র ভালো কাজ করলেই চলবে। তবে কেউ যদি সেদিন কোনো ভালো কাজ নাও করে থাকেন, তাকেও খালি মুখে হোটেল থেকে ফিরতে হবে না। কেবল পরদিন একটি ভালো কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিলেই চলবে।

গত সপ্তাহে রাজধানীর পান্থকুঞ্জের 'ভালো কাজের হোটেল' খেতে এসেছিলেন মো. সারোয়ার হোসেন (৬০)। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ভিক্ষা করি। তেজগাঁও রেলস্টেশনে ঘুমাই। দুর্ঘটনায় এক হাত কাটা পড়ে যায়। এরপর থেকে আর কাজ করতে পারি না। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ভিক্ষা করে ঠিক দুপুরে আমি এখানে চলে আসি। দুপুরে এখানেই খাই।'

তার পাশেই বেঞ্চে খেতে বসেছিলেন কোহিনূর বেগম। সঙ্গে আছে তার ৪ বছরের নাতি ও আড়াই বছর বয়সী নাতনি। পেশায় তিনি একজন গৃহকর্মী।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ৩ বাসায় কাজ করি। আজকে কাজের ফাঁকে আমার নাতি-নাতনিকে নিয়ে এখানে খেতে আসলাম। এদের খাবার খুব ভালো। তাই মাঝেমাঝে এখানে খেতে আসি।'

'বাসায় এই নাতি-নাতনিকে অত ভালো খেতে দিতে পারি না। দেখা যায় একটা ডিম ২ জনকে ভাগ করে খেতে হয়। এখানে পুরো একটা ডিম খেতে পারে, ডাল-সবজি খেতে পারে। শরীরে পুষ্টি পায়', বলেন কোহিনূর।

রাজধানীর ৫ এলাকায় ভালো কাজের হোটেলের কার্যক্রম চলে। এর মধ্যে পান্থকুঞ্জে দুপুর ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত, সাত রাস্তার মোড়ে দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত, কমলাপুরে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত, বনানীর কড়াইল বস্তিতে দুপুর আড়াইটা থেকে ৪টা পর্যন্ত এবং বাসাবোতে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া চলে।

চট্টগ্রামেও সপ্তাহে ১ দিন চলে 'ভালো কাজের হোটেল'র কার্যক্রম। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় নগরীর স্টেডিয়াম এলাকায় ভালো কাজের হোটেলে খেতে আসেন শ খানেক মানুষ।

উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকায় ৫টি এলাকায় খাবার পরিবেশনের জন্য প্রতিদিন ১২০ কেজি চাল রান্না হয়। প্রতি সপ্তাহের শনি, রবি ও মঙ্গল— এই ৩ দিন ডিম খিচুড়ি এবং বাকি ৪ দিন ভাত, ডিম ও ডাল-সবজি রান্না করা হয়।

পান্থকুঞ্জে খাবার পরিবেশন করছিলেন ভালো কাজের হোটেলের উদ্যোক্তাদের একজন বোরহান উদ্দিন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতিদিন ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ লোক খাওয়ানো হয়। আমাদের একটাই গাড়ি। বাসাবোতে রান্নাবান্নার কাজ হয়। তারপর গাড়িতে সেগুলো তুলে একেক এলাকায় ঘুরে ঘুরে আমরা খাবার পৌঁছে দেই।'

বর্তমানে ভালো কাজের হোটেলে ১ হাজার ৯২৬ স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন। সবাই মিলে যে যার সাধ্যমতো নিয়মিত চাঁদা দিয়ে এই হোটেল পরিচালনা করে চলেছেন।

বোরহান উদ্দিন বলেন, 'আমি এখানে স্বেচ্ছাশ্রম দেই। মাসে ৩০০ টাকা চাঁদাও দেই। আমাদের এই হোটেলে যারা আসেন, তাদের বেশিরভাগই পথশিশু, ছিন্নমূল লোক। বড় একটা অংশ নিম্নবিত্ত। অনেকে আসেন যারা মানসিক বিকারগ্রস্ত, পাগল। তাদেরকেও অনেক ধৈর্যের সঙ্গে দেখাশোনা করতে হয়।'

তবে, যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষই ভালো কাজের হোটেলে খেতে পারবেন বলে জানান তিনি। বলেন, 'এমন অনেকেই আছেন যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল, কিন্তু হয়তো কখনো এমন হয়েছে যে পকেটে টাকা নেই বা রাস্তায় আটকে গেছেন; এমন পরিস্থিতিতে তারা নিশ্চিত মনেই ভালো কাজের হোটেলে খাবার খেতে পারবেন।'

Comments