কেন বলা হয় আইএমএফের ঋণে কোনো দেশ উপকৃত হয় না

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ নিয়ে কোনো দেশ প্রকৃত অর্থে উপকৃত হয় না, এমন ধারণা প্রচলিত আছে। এমন উদাহরণও আছে।
আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে গেলে তারা যে শর্তগুলো দেয়, তা সাধারণ মানুষের বিপক্ষে যায়

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ নিয়ে কোনো দেশ প্রকৃত অর্থে উপকৃত হয় না, এমন ধারণা প্রচলিত আছে। এমন উদাহরণও আছে।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং আর্থিক নীতি সংশ্লিষ্ট নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশও আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে। জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, এই ঋণ কি বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে বের করে আনতে পারবে?

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে অর্থনীতিবিদ-বিশ্লেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলামের সঙ্গে।

আমরা যেসব সাফল্য অর্জন করেছিলাম—বর্তমান অর্থমন্ত্রীর গাফিলতি, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনায় সেখান থেকে ছিটকে পড়েছি। পুঁজিপাচারের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে চাপে পড়েছে এবং রিজার্ভ পতনের যে ধারা সূচিত হয়েছে, দক্ষতার অভাবে সেটাকে অর্থমন্ত্রী যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে পারেননি।

দ্য ডেইলি স্টার: কেন এমন ধারণা প্রচলিত যে আইএমএফের ঋণ নিয়ে কোনো দেশের উপকার হয় না। তাদের ঋণ নিলে দেশ বরং দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়ে। বিষয়টি আসলেই কি এমন?

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে গেলে তারা যে শর্তগুলো দেয়, তা সাধারণ মানুষের বিপক্ষে যায়। কারণ তারা ভর্তুকি কমাতে বলে, সুদের হার বাড়াতে বলে, সরকারের অন্যান্য নীতি সংস্কার করতে বলে। তাদের দেওয়া শর্তগুলোকে গণমুখী বলা যাবে না। বাংলাদেশকে ২০১২ সালের পর আর আইএমএফের ঋণ নিতে হয়নি। সরকার এবার অন্য কোনো উপায় না পেয়ে এই ঋণ নিয়েছে।

আমরা যেসব সাফল্য অর্জন করেছিলাম—বর্তমান অর্থমন্ত্রীর গাফিলতি, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনায় সেখান থেকে ছিটকে পড়েছি। পুঁজিপাচারের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে চাপে পড়েছে এবং রিজার্ভ পতনের যে ধারা সূচিত হয়েছে, দক্ষতার অভাবে সেটাকে অর্থমন্ত্রী যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে পারেননি। এখানে যতদিন পরিবর্তন না আসবে, ততদিন দেশের অর্থনীতিতে সমস্যা লেগেই থাকবে।

ডেইলি স্টার: বিপদে পড়ে আইএমএফের ঋণ নিয়ে বিপদ কাটিয়েছে, এমন কোনো উদাহরণ নেই?

অধ্যাপক মইনুল: আইএমএফের ঋণে সংকট কাটানোর উদাহরণ তেমন একটা নেই। যেমন ইন্দোনেশিয়া বিপদে পড়ে আইএমএফের ঋণ নিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে আইএমএফের প্রেসক্রিপশন তাদের অর্থনীতিকে ওলট-পালট করে দিয়েছিল। অনেক পরে এখন তারা সংকট কাটিয়ে উঠেছে। কাজেই আইএমফের ঋণ নিয়ে তারা ভালো অবস্থায় ফিরেছে, সেটাও বলা যাবে না।

আইএমএফের ঋণ নিয়ে উপকৃত হয়েছে এমন রেকর্ড খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। তাদের ঋণ নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে অনেক দেরি হয়। কারণ, আইএমএফের প্রেসক্রিপশনের প্রধান উদ্দেশ্য কোনো দেশকে সংকট থেকে উদ্ধার করা নয়। তাদের এজেন্ডার মধ্যে প্রো-ক্যাপিটালিস্ট বায়াস থাকে। এর প্রভাবে মানুষের আয় বৈষম্য বাড়ে, ধনীদের সম্পদ অনেক বেশি বেড়ে যায়।

আইএমএফের প্রেসক্রিপশন সব সময় দেশের স্বার্থে হয় না, সেটা তো আমরা ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়াতেই দেখতে পেয়েছি। মাহাথির মোহাম্মদ তখন আইএমএফের ঋণ নেননি। তারা যখন সংকটে পড়েছিলেন, তখন আইএমএফের প্রেসক্রিপশন মেনে নেননি। তারা নিজেদের মতো করে সংস্কার করেছে এবং মুক্তি পেয়েছে। আমাদের একজন দক্ষ অর্থমন্ত্রী থাকলে আমরাও একইভাবে মুক্তি পেতে পারতাম।

ডেইলি স্টার: সম্প্রতি আইএমএফের ঋণ প্রসঙ্গে আর্জেন্টিনার নাম আলোচনায় আসে। আর্জেন্টিনা আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার পর তাদের অবস্থা কেমন হয়েছে?

অধ্যাপক মইনুল: আইএমএফের ঋণ নেওয়ার পর আর্জেন্টিনার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। আইএমএফের ঋণ নেওয়ার পর তাদের অর্থনীতি ধসে গেছে। শুধু আইএমএফের ঋণ ও তাদের শর্তের কারণেই এমন হয়েছে তা নয়। আর্জেন্টিনার ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক ত্রুটি-দুর্নীতি ছিল।

ডেইলি স্টার: ভর্তুকি না দেওয়ার মতো জনবিমুখ শর্ত যেমন আছে, তেমনি আইএমএফের কিছু ভালো শর্তও তো দেখা যায়। যেমন: আর্থিক খাত সংস্কার করা, রাজস্ব বাড়ানো ইত্যাদি। তাহলে আইএমএফের সমালোচনা করি কেন?

অধ্যাপক মইনুল: ঢালাওভাবে আইএমএফের সমালোচনা করা ঠিক না। কিন্তু, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, যে ঋণ আমরা নিচ্ছি, সেটা যেন ফেরত দিতে পারি। ফলে অর্থনীতি ভালো হোক বা খারাপ, ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়াই তাদের অগ্রাধিকার।

আইএমএফের ঋণ আমরা বাধ্য হয়েই নিয়েছি। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামাতে না পারলে দেশের অর্থনীতির এই সংকট সহজে কাটবে না। প্রশ্ন হচ্ছে আইএমএফের ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণে আমাদের সংকট কাটবে কি না? এই প্রশ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের মূল সংকট কী, রিজার্ভ কেন কমে যাচ্ছে?

আমাদের রিজার্ভ কমছে মূলত ৪টি কারণে। আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফিরিয়ে না আনা এবং ব্যাংক থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ ঋণের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়ে যাওয়া।

এসব বিষয়ে আমরা নজর দেবো কি না? এই বিষয়গুলোতে আমরা নজর দেইনি, এখনো দিচ্ছি না। নজর না দেওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে আইএমএফের ঋণ নিয়ে আমরা মুক্তি পাব না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আইএমএফের শর্তের মধ্যে এই ৪টির কোনোটিই নেই। এসব তো আর একদিনে এত বেড়ে যায়নি। আমাদের এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর ভূমিকা আছে হুন্ডিতে। অনেক এক্সচেঞ্জ হাউস বন্ধ করে দিতে হবে। এত হাউসের দরকার কী বাংলাদেশে?

কাজেই আইএমএফের অগ্রাধিকার অন্যত্র। তারা ব্যাংকখাতে সংস্কারের কথা বলছে, খেলাপি ঋণের বিষয়ে কঠোর হতে বলছে। খেলাপি ঋণের ব্যাপারে বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপিরা ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে খেলাপির তালিকা থেকে নাম কাটিয়েছে। রাঘব-বোয়াল সবাই একই কাজ করায় অর্থমন্ত্রী যে ২০ জন ঋণখেলাপির তালিকা দিলেন, সেখানে তাদের নাম নেই।

কাজেই সত্যিকারের সমস্যাগুলোতে আইএমএফ হয়তো হাত দিতে বলেনি। বলে থাকলে তো ভালো।

বিশ্ববাজারে কোন জিনিসের দাম কত, সেটা বের করা খুবই সহজ। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি একটি শক্তিশালী কমিটি করে দেয়, কমিটি যদি প্রতিটি এলসি পরীক্ষা করে, আন্ডার-ওভার ইনভয়েসিং থাকলে অ্যালাউ না করে, তাহলেই হয়। আমাদের দেশে প্রতি বছর আমদানিতে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে। কাজেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার প্রধান কারণ তো এটাই।

ডেইলি স্টার: আইএমএফ যদি বলে থাকে আর্থিক খাতের সংস্কার করতে হবে, ব্যাংক খাতের অনিয়ম বন্ধ করতে হবে, তাহলে তার মধ্যে তো খেলাপি ঋণসহ সব বিষয়ই পড়ে।

অধ্যাপক মইনুল: বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। তবে আইএমএফ বলছে, এর পরিমাণ তারও আড়াই থেকে ৩ গুণ বেশি হবে। এটা অনেক বেশি। এ ব্যাপারে আইএমএফের স্ট্যান্ডকে আমি সমর্থন করি। কিন্তু ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আইএমএফের শর্ত নেই।

ডেইলি স্টার: আবারও প্রথম প্রশ্নে ফিরি, এসব কারণেই কি বলা হয় যে আইএমএফের ঋণে কোনো দেশের উপকার হয় না?

অধ্যাপক মইনুল: একেবারে উপকার হয়নি, সেটা হয়তো ঠিক নয়। কিন্তু আইএমএফের প্রেসক্রিপশন সব সময় দেশের স্বার্থে হয় না, সেটা তো আমরা ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়াতেই দেখতে পেয়েছি। মাহাথির মোহাম্মদ তখন আইএমএফের ঋণ নেননি। তারা যখন সংকটে পড়েছিলেন, তখন আইএমএফের প্রেসক্রিপশন মেনে নেননি। তারা নিজেদের মতো করে সংস্কার করেছে এবং মুক্তি পেয়েছে। আমাদের একজন দক্ষ অর্থমন্ত্রী থাকলে আমরাও একইভাবে মুক্তি পেতে পারতাম।

ডেইলি স্টার: বলছিলেন আন্ডার-ওভার ইনভয়েসিং করে দেশ থেকে ডলার পাচার করা হচ্ছে। কোনো সরকার ইচ্ছে করলেই কি তা বন্ধ করতে পারবে?

অধ্যাপক মইনুল: অবশ্যই পারবে। এখন তো তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। বিশ্ববাজারে কোন জিনিসের দাম কত, সেটা বের করা খুবই সহজ। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি একটি শক্তিশালী কমিটি করে দেয়, কমিটি যদি প্রতিটি এলসি পরীক্ষা করে, আন্ডার-ওভার ইনভয়েসিং থাকলে অ্যালাউ না করে, তাহলেই হয়। আমাদের দেশে প্রতি বছর আমদানিতে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে। কাজেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার প্রধান কারণ তো এটাই।

ডেইলি স্টার: সরকার বলে, আমাদের অর্থনীতির অবস্থা ভালো তার প্রমাণ হচ্ছে, আইএমএফ আমাদের ঋণ দিলো। শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের অবস্থা খারাপ বলে তারা ঋণ পায়নি।

অধ্যাপক মইনুল: বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিশ্চয়ই পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক ভালো। আমরা তো এখনো অত বড় সংকটে পড়িনি। কিন্তু ১ বছরে যেখানে আমাদের ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কমেছে, ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে সরকারের হিসাবে ৩২ বিলিয়ন এবং আইএমএফের হিসাবে ২৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে রিজার্ভ। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি পতনের ধারা। এটাকে থামাতে হবে। দক্ষতা না থাকায় অর্থমন্ত্রী এটা থামাতে পারছেন না। আইএমএফ ঋণ দিল বলে ভালো, না দিলে খারাপ—এভাবে ভাবা যাবে না। আমাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত। কিন্তু ব্যবস্থা নিচ্ছি না।

 

Comments