ভারতীয় পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে যা বললেন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী সম্প্রতি ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাস্তবসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা থেকে বাংলাদেশের অতিরিক্ত পানি পাওয়ার সুযোগ নেই। এরচেয়ে বাংলাদেশের উচিত ভারতের আর্থিক সহায়তায় বর্ষায় পানি সংরক্ষণে একটি জলাধার বা সংরক্ষণাগার তৈরি করা।

তার এই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি সিলেটে একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনে মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নেয় টেলিগ্রাফ। এর ভিত্তিতে গত শুক্রবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে গণমাধ্যমটি।

জলাধার নির্মাণের প্রস্তাবটি ব্যক্তিগত, তবে সরকারের অনেকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছেন উল্লেখ করে মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী টেলিগ্রাফকে বলেছেন, শুষ্ক মৌসুমেও যেন তিস্তা থেকে পানি পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে কয়েক বছর ধরেই ভারতের সঙ্গে চুক্তি করতে চাইছে বাংলাদেশ। ২ দেশের মধ্য চুক্তিটি ২০১১ সালে সই হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি।

এই জলাধার তৈরির প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকার একমত হয়েছে কি না, এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে কি না, জলাধার তৈরিতে কত খরচ হতে পারে— এসব প্রশ্নের তিনি কোনো উত্তর দেননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী টেলিগ্রাফকে বলেন, 'বাস্তবসম্মতভাবে বলতে গেলে, পশ্চিমবঙ্গ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে পানি দিতে পারবে না। কারণ, কৃষি ও খাওয়ার পানির চাহিদা মেটাতে তারা মহানন্দা সংযোগ চ্যানেল দিয়ে গজলডোবার দিকে পানিপ্রবাহ ঘুরিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক দিক থেকে বললে, উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান দুর্বল। সুতরাং তারা রাজনৈতিক পুঁজির বিনিময়ে কোনো ধরনের পানি বণ্টন করতে চাইবে না।'

'শুষ্ক মৌসুমের জন্য আমাদের বর্ষায় পানি সংরক্ষণ করতে হবে। সেটা ব্যয়বহুল। ভারতের অর্থায়নে, কিংবা বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিলে ডালিয়ার চারপাশে এ জলাধার বা সংরক্ষণাগার তৈরি করতে হবে, যেখানে আমাদের একটি বাঁধ আছে। ভারতের ওপর নৌ পরিবহন শুল্ক বাড়াতে হবে। ভারতের এ খরচ বহন করা উচিত।'

তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশ মনে করে, উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য এই প্রকল্পটি সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। তবে ভূকৌশলগত কারণে আরেকটি অংশ চান না বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে কাজ করুক।

মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী সরকারি কর্মকর্তাদের এই অবস্থানের কারণ হিসেবে টেলিগ্রাফকে বলেছেন, 'প্রথমত, ভারত চায় বাংলাদেশ তিস্তা ইস্যুতে চীনের সঙ্গে কোনো প্রকল্প শুরু না করুক। দ্বিতীয়ত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশও ঋণের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা আছে।'

টেলিগ্রাফকে দেওয়া মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরীর এই সাক্ষাৎকার বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা তো দেশ বিরোধী কথা। সারা পৃথিবীতে আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে যে প্রাকটিস আছে, তিনি তার বিরোধী কথা বলেছেন, দেশের স্বার্থ বিরোধী কথা বলেছেন।'

নদী রক্ষা কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যানের এই মন্তব্য বিষয়ে কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, 'ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার নদীর পানি বিষয়ক সমস্যা সমাধানে যৌথ নদী কমিশন রয়েছে, তারা এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত সরকার বলেছে যে তারা তিস্তা সমস্যার সমাধান করবে। এই প্রেক্ষাপটে এসে ওনার এমন কথা ঠিক হয় না।'

তিনি আরও বলেন, 'ভারত নদীতে বাঁধ দেওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ গ্রীষ্মকালে যেমন সমস্যায় পড়ছে, তেমনি বর্ষাকালেও সমস্যায় পড়ছে। ভারতেরই উচিত এই সমস্যার দ্রুত সমাধান করা। আর যিনি বলেছেন "শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি পাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের নেই", এই কথার দায়দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।'

সিলেটে আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরীর মন্তব্য বিষয়ে বলেন, 'এমনও হতে পারে, টেলিগ্রামের প্রতিবেদনে হয়তো তার কথা পুরোটা কোট করা হয়নি।'

তিস্তার পানির বিষয়ে তিনি বলেন, 'সিকিমে ভারত ৩০-৩৫টি বাঁধ তৈরি করেছে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য। প্রতিটি বাঁধের কারণে অন্তত ৫ শতাংশ করে পানি কম আসছে। এই বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো কথা হয় না। তিস্তার পানি সমস্যা সমাধানে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে হবে। বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ তিস্তার পানির জন্য কষ্ট করছে।'

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আন্তঃসীমান্ত নদী সম্পর্কে এমন মন্তব্য করার আগে তার উচিত ছিল এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান জেনে নেওয়া। বাংলাদেশের সরকার সব মৌসুমই তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা চায়।'

মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি টেলিগ্রাফের প্রিন্ট ভার্সন ও অনলাইন দেখেছি। সেখানে আমি যা বলেছি, তার সব ছাপেনি, একটি অংশ বাদ রেখেছে। সেটা হচ্ছে, আমি জয়ন্ত বসুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই ফারাক্কা বাঁধ কি কলকাতা বন্দরকে সেভ করতে পারছে? তার উত্তর দিয়েছেন, না। আমরাও জানি ফারাক্কার পানি ডাইভার্ট করে নিয়ে যাওয়ার ফলে ওখানে পোর্টের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। তখন আমি তাকে বললাম, তাহলে তো আপনাদের উচিত হবে ফারাক্কা বাঁধটা ভেঙে ফেলা। ফারাক্কার জন্য নৌ ট্রানজিটসহ অনেক কিছুই তো পর্যুদস্ত অবস্থায় আছে। এই অংশটি ছাপা হয়নি। বাকি আমি যা বলেছি সেটাই ছেপেছে।'

তিনি বলেন, 'টেলিগ্রাফকে আমি যে কথাগুলো বলেছি, সেটা আমার ব্যক্তিগত মতবাদ, নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি সেগুলো বলিনি। ২০১১-১২ সালে আমার বেশ কিছু লেখা আছে। সেখানেও আমি দেখিয়েছি যে তিস্তার পানি ভারত কোনোভাবেই বাংলাদেশকে দেবে না। যেহেতু তারা দেবে না, যেহেতু তারা দিচ্ছে না, যেহেতু গত প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক থেকেও বিষয়টি ড্রপ করেছে, সুতরাং পানি বণ্টনের বিষয়টি তো আলোচনায়ই নেই।'

'শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দিলে তৃণমূল কংগ্রেস রাজনৈতিকভাবে তাদের কয়েকটি জেলায় টিকে থাকতে পারবে না' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এই কারণে তারা পানি দেবেও না। ২০১১ সাল থেকে আলোচনা শুরু করে প্রায় ১ যুগ পার হয়ে যাচ্ছে, সমাধান তো হচ্ছে না।'

এই মন্তব্য 'দেশ বিরোধী' কি না জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন রাখেন, 'চীন যখন রিজার্ভার করার প্রস্তাবনা দিয়েছে তখন সেটাকে দেশ বিরোধী বলা হয়নি কেন?'

'আমি তো বলেছি, এ দেশে জলাধার বা রিজার্ভার করা হলে সেটার টাকা দেবে ভারত', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Inside the lives of ride-sharing drivers

On the bustling streets of Dhaka, where traffic moves like molasses and the air hangs heavy with exhaust fumes, a new breed of urban warriors has emerged.

13h ago