বিলুপ্তির পথে উত্তরাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষা

সাঁওতালি ভাষার বর্ণমালা। ছবি: সংগৃহীত

সাঁওতালি, কুরুখ, সাদরি, মুন্ডালি— বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা যে ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলে তার মধ্যে কয়েকটি এগুলো।

তবে এই অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষার যে বিপুল বৈচিত্র্য তা হারিয়ে যেতে বসেছে। ভাষার পুনরুজ্জীবনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবই এর মূল কারণ তা নয় জাতিগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে তাদের ভাষায় কথা বলার আগ্রহ হারানোও অন্যতম কারণ।

দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলোর নিজস্ব বর্ণমালা এবং ধ্বনি রয়েছে। কিন্তু সমতলের এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে এখন বাংলায় কথা বলাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য দেখা যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করা পিপলস ইউনিয়ন অব দ্য মারজিনালাইড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (পুমডো) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হৈমন্তী সরকার বলেন, 'প্রত্যেক নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের তার নিজস্ব ভাষায় কথা বলার অধিকার রয়েছে যা তাদের নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে সহায়ক।'

'কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের ভাষাও তারা ভুলে যাচ্ছে, এর অর্থ হলো তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যও ভুলে যাচ্ছে।'

জাতিসংঘের তথ্যে, বর্তমানে বিশ্বে ৬ হাজার ৭০০ ভাষার মধ্যে ৯৬ শতাংশ ভাষায় কথা বলে মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ। যদিও আদিবাসীরা বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৬ শতাংশেরও কম, তারা বিশ্বের ৪ হাজারেরও বেশি ভাষায় কথা বলে।

এই ভাষাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিকে এখন 'বিপন্ন' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, বেশিরভাগেরই ২১০০ সালের মধ্যে বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি দুই সপ্তাহে বিশ্বের অন্তত একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাও কম হুমকির মুখে নেই, অধিকাংশই বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে বা বিপন্ন হওয়ার পথে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ শুমারি অনুযায়ী, সারাদেশে ৫০টিরও বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে, যার জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৫০ হাজার। যা দেশের পুরো জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশ।

তাদের মধ্যে রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলে সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে। এই ২ অঞ্চলে প্রায় ৩৫-৩৮টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বসবাস। রাজশাহীতে তাদের জনসংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৪৪ হাজার, অন্যদিকে রংপুর বিভাগে এই সংখ্যা প্রায় ৯১ হাজার যাদের অধিকাংশই দিনাজপুরে বসবাস করেন।

সাঁওতালরা দুটি বিভাগের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি।

'জাতীয় আদিবাসী পরিষদে'র সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, 'ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠিদের নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য নিজস্ব আলাদা ভাষা রয়েছে। সাঁওতালরা কথা বলার জন্য সাঁওতালি ভাষা ব্যবহার করে, যার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে।'

সাঁওতালদের মধ্যে সাঁওতালি ভাষায় এখনও কথাবার্তা চললেও ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে বলে তিনি জানান।

ওরাওঁ সম্প্রদায় কুরুখ ভাষায় কথা বলে। এই ভাষা ভারতের ঝাড়খণ্ডের নৃগোষ্ঠীও ব্যবহার করে থাকে। মুন্ডা সম্প্রদায় মুন্ডালি ভাষায় কথা বলে। এই সমস্ত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা এখন এই সম্প্রদায়ের লোকেরা খুব কমই ব্যবহার করে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এর প্রবণতা একবারেই কম বলে তিনি জানান।

যত কম বলা হয় একটি ভাষা, তত দ্রুত এটি বিলুপ্ত হতে থাকে।

সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষা সাদরি।

'আদিবাসী পরিষদে'র তথ্যসচিব মানিক সরেন বলেন, 'সাদরি এখনও অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে বলা একটি ভাষা। কিন্তু এটি একটি মিশ্র ভাষা।'

তিনি জানান, সমতলের বেশিরভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা বর্তমানে বিপন্ন, তাদের মধ্যে প্রায় ৭ থেকে ৮টি ইতোমধ্যেই বিভিন্ন কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

পুমডো সম্প্রতি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার বাগজানা ও আতাপুর ইউনিয়নে একটি জরিপ চালিয়ে একই তথ্য পেয়েছেন।

সেখানকার নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে ওরাওঁ, পাহান, মালো এবং মাহাতো।

স্কুলে শিশুদের মধ্যে পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, তাদের অধিকাংশই তাদের ঐতিহ্যবাহী ভাষায় কথা বলতে পারে না, অনেকে এখন পর্যন্ত জানেই না যে তাদের একটি নিজস্ব ভাষা আছে।

গত সোমবার সরেজমিনে পাঁচবিবি পৌরসভার দমদমা গ্রামে কয়েকজন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া যায়।

উচাই জারকা এসসি উচ্চ বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের প্রায় ৭০ জন শিক্ষার্থী আছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই নিজস্ব ভাষার সঙ্গে পরিচিত নন।

সিং সম্প্রদায়ের স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী পূজা সিং বলেন, 'আমি আমার বাবা-মাকেও এমন কোনো ভাষায় কথা বলতে শুনিনি।'

তার মতো, স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা জানায়, তারা তাদের দৈনন্দিন যোগাযোগের জন্য বাংলাই ব্যবহার করে। কারণ এই ভাষায় তাদের সব কাজ হচ্ছে।

দমদমা গ্রামের গৃহকর্মী সঞ্জিতা মাহাতো বলেন, 'আমার বাবা-মা বা শ্বশুরবাড়ির কেউই তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলেন না।'

'আদিবাসী পরিষদে'র সভাপতির মতে, দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে সরকারকে এই সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষাগুলোকে বাঁচাতে নেতৃত্ব দিতে হবে।

'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নিজস্ব ভাষায় তাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে শেখার বিকল্প এক্ষেত্রে সমাধান হতে পারে,' বলেন তিনি।

'আমরা বহুবার সরকারকে বলেছি কিন্তু এখনও এই বিষয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না,' বলেন তিনি।

বহুদিন ধরে সরকারকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের অন্তত একজন শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানানো হলেও সেই দাবিতে কখনোই কেউ কর্ণপাত করেনি বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, 'সরকারকেই এ বিষয়ে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে এই সমস্ত ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আমরা যদি এখনই এই প্রক্রিয়া শুরু করি তবে আমরা এখনও কিছু বিপন্ন ভাষাকে বাঁচাতে পারব।'

২০১৭ সালে সরকার সাদরি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিল।

'৬ বছর হয়ে গেছে এবং এখনও পর্যন্ত কোনো স্কুলে এ জাতীয় বই সরবরাহ করা হয়নি। গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে এই ভাষার ব্যবহারের প্রবণতা আরও কম,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Rising tea prices bring new life to northern growers

Better rates, higher yields, and improved quality are revitalising tea cultivation

12h ago