কেমন কেটেছিল মুজিবের কালজয়ী ভাষণের দিন

'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ' বইয়ে পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া স্মৃতিচারণ করেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চের দিনটি কীভাবে অতিবাহিত করেছিলেন। এম এ ওয়াজেদ মিয়া বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী।

৭ মার্চের ভাষণ শেষে শেখ মুজিবুর রহমান বাড়ি ফিরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে বসেন। খাওয়ার সময় গম্ভীর হয়ে বললেন, 'আমার যা বলার ছিলো আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যেকোনো মুহূর্তে গ্রেফতার বা হত্যা করতে পারে। সে জন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দুবেলা আমার সঙ্গে একত্রে খাবে। সেদিন থেকে এ নিয়ম আমরা ২৫ মার্চ দুপুর পর্যন্ত পালন করেছি। কেবল ২৫ শে মার্চ রাতে ব্যতিক্রম ঘটে। সে রাতে বঙ্গবন্ধু রাত এগারোটা পর্যন্ত বাড়ির নিচতলায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, যুবলীগ ও অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। ফলে শাশুড়ি বাদে আমরা সবাই খেয়ে নিয়েছিলাম।'

'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ' বইয়ে পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া স্মৃতিচারণ করেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৭ মার্চের দিনটি কীভাবে অতিবাহিত করেছিলেন। এম এ ওয়াজেদ মিয়া বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী।

বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম রোববার অনুষ্ঠিতব্য সমাবেশ থেকে কী ঘোষণা দেবেন।

৭ মার্চ সকাল থেকে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীসহ অন্যদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠতে শুরু করে। এম এ ওয়াজেদ মিয়া তখন ধানমন্ডির ওই বাড়িতেই থাকতেন। ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, '৭ই মার্চ সকালে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ী আওয়ীমী লীগের বহু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও ছাত্র নেতৃবৃন্দে ভরে যায়। উপস্থিত সবার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন দেশে পরিণত করার ব্যাপারে আলোচনা করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন সাহেবদের সঙ্গে লাইব্রেরি কক্ষে দ্বার রুদ্ধ করে আলাপে বসেন।'

'সুদীর্ঘ আলোচনার পর লাইব্রেরি কক্ষ থেকে বসার ঘরে অপেক্ষারত আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, 'তাঁরা ঐক্যমত্যে পৌঁছেছেন এবং ওইদিন বিকেল সাড়ে চার ঘটিকায় রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিতব্য সভায় দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করে একটি চার দফার ঘোষণা দেওয়া হবে। অতঃপর বঙ্গবন্ধু তৎমর্মে জনাব কামরুজ্জামান, জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ও ড. কামাল হোসেনকে নির্দেশ দিয়ে গোসল ও দুপুরের আহারের জন্য বাড়ীর ওপর তলায় চলে যান। আহার শেষে বঙ্গবন্ধু যখন বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সে সময় এক ফাঁকে এসে ড. কামাল হোসেন তাকে প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্রের খসড়াটি দেখিয়ে নেন।'

প্রখ্যাত আইনবিদ ড. কামাল হোসেন তার 'বাংলাদেশ: কোয়েস্ট ফর ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস' বইয়ে লিখেছেন, তাকে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতির খসড়া প্রস্তুত করতে বলা হয়েছিল, যা জনসভার পর গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে।

ওইদিন একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে সামরিক আইন বিলুপ্ত এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ও অন্যান্য দাবি সংবলিত ওই বিবৃতিটি তৈরি হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছিলেন, খসড়াটি তাজউদ্দীন আহমদের দায়িত্বে থাকবে এবং ভাষণের পর যেকোনো প্রয়োজনীয় সংশোধন করে তিনি সেটা জারি করবেন।

ভাষণে কী বলবেন মুজিব

মার্চের শুরুতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জাতীয় পরিষদের সভা স্থগিত করে এবং ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি বিলম্বিত করতে থাকে। এর প্রতিবাদে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বাংলাদেশ কার্যত শেষ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় চলতে থাকে। স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত স্বাধীনতাকামী জনগণ রাস্তায় নেমে আসেন। এই আন্দোলন দমাতে পাকিস্তানি বাহিনী আন্দোলনরত জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে অনেকে হতাহত হয়। একদিকে আন্দোলন চলছিল, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গোপণে তাদের সৈন্য সমাবেশ বৃদ্ধি করছিল। ৭ মার্চে জনসভার ঘোষণা আসার পর থেকেই নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান কী ঘোষণা দেবেন।

১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড তার 'দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ: মেমোরিস অব অ্যান আমেরিকান ডিপলোম্যাট' বইয়ে লিখেছেন,

১ মার্চ থেকেই জানা গিয়েছিল, শেখ মুজিব ৭ মার্চ একটি জনসমাবেশে তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার রূপরেখা ঘোষণা করবেন। পরবর্তীতে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া (খান) ৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।

তিনি আরও লিখেছেন, যুগপৎ দুটি ঘটনার কারণে পূর্ব পাকিস্তানিদের মনে অনেক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেয়। তবে মূল প্রশ্নটি ছিল শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার জন্য এই সময়টি বেঁছে নেবেন কি না, এবং যদি সেটা করেন তাহলে সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া কী হবে।

শেষের শুরু

ওয়াজেদ মিয়া তার বইয়ে আরও লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে রমনা রেসকোর্স বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার জন্য একটি ট্রাকে উঠেছিলেন। একটি নৌকা আকৃতির মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। জনতা স্লোগান দিয়ে শেখ মুজিবকে স্বাগত জানায়।

শেখ মুজিব বক্তৃতা দিতে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনগণের কোলাহল থেমে যায়। আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অনলবর্শী বক্তা আবেগপ্রবণ হয়ে এই বলে ভাষণ শুরু করেন, 'আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।'

বিকেলে বঙ্গবন্ধু তার ১৯ মিনিটের ভাষণে—নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও কীভাবে বাঙালিদের ক্ষমতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল তা বর্ণনা করেন। তিনি বাংলার মুক্তি চান। তিনি সর্বস্তরের জনগণকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অত্যাচার, শোষণ, পরাধীনতা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন এবং ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। দেশ কীভাবে চলবে সে সম্পর্কেও তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা দেন। এরপর আসে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে চূড়ান্ত ঘোষণা— '...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।'

বঙ্গবন্ধু তাদের কী বলবেন, তা জানার জন্য প্রায় পিনপতন নীরবতায় বক্তৃতা শুনছিল জনসমুদ্র। বিশাল জনসমুদ্র হাত তুলে সমর্থন জানায় মুজিবের বক্তৃতার।

ওয়াজেদ মিয়ার ওই দিনের কথা স্মরণ করে আরও লিখেছেন, সেদিন রাত ৮টার দিকে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকাস্থ কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারী ৩২ নম্বরের বাসায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।... তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে জানান যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন সত্ত্বেও ঢাকায় অবস্থিত সেনা বাহিনীর হাই কমান্ডের নির্দেশে বক্তৃতা প্রচার করতে না দেওয়ায় তাঁরা প্রতিবাদ স্বরূপ ৭ই মার্চ রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রদত্ত তাঁর সম্পূর্ণ ভাষণ পুনঃপ্রচার করার অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত ঢাকাস্থ রেডিও পাকিস্তান কেন্দ্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ও অফিসে উপস্থিত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওই রাত থেকে পরদিন রাত পর্যন্ত ঢাকাস্থ রেডিও পাকিস্তানের সকল অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। ৮ মার্চ সকাল ৮টায় হঠাৎ পাকিস্তান রেডিও ঢাকা কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় যে, ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা হুবহু সকাল ৯টায় প্রচার করা হবে। আমি ৯ তারিখ সকালে অফিসে যাওয়ার পথে গাড়ীর রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি সম্পূর্ণ শুনেছিলাম।

বঙ্গবন্ধুর যুগান্তকারী ভাষণ জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। ২৫ মার্চের কাল রাতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর আক্রমণের পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। পরবর্তী ৯ মাসে পাকিস্তানি সেনারা ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা পরিচালনা করে।

আর্চার ব্লাড আরও লিখেছেন, '৭ মার্চ রোববারের ভাষণটিতে মুজিব যা বলেছিলেন, তার চেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য ছিল, তিনি যা বলেননি সেটার জন্য।'

শেখ মুজিবের অগ্নিঝরা ভাষণটি ছিল অলিখিত। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করে। এর ফলে ভাষণটি ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেসি হেরিটেজের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। পাশাপাশি, এটি ইতিহাসবিদ ও লেখক জ্যাকব এফ ফিল্ডের 'উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচেস দ্যাট ইনস্পায়ারড হিস্ট্রি' বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেখানে গত আড়াই হাজার বছরে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী যুদ্ধকলীন বক্তৃতাগুলো স্থান পেয়েছে। এ সংকলনে সিসেরো থেকে উইনস্টন চার্চিল এবং আব্রাহাম লিংকন থেকে মাও সে তুংয়ের ভাষণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এ ভাষণের পর ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হতে হয় এবং পাকিস্তানের নির্জন কারাগারে নিয়ে রাখা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

Comments