জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের প্রতিবাদ ও প্রতিবেদকের বক্তব্য

ড. মনজুর আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনে বাংলাদেশের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে অংশগ্রহণ করে দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে সাক্ষাৎকার দেন। এখন তিনি সেই বক্তব্যকে ‘ব্যক্তিগত মতামত’ হিসেবে দাবি করছেন।
শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে তিস্তা অববাহিকার চিত্র। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

'রাজ্য নয়, বাংলাদেশকে দাবি জানাতে হবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে' শিরোনামে দ্য ডেইলি স্টার বাংলায় প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞ ড. আসিফ নজরুলের সাক্ষাৎকারের একটি অংশের প্রতিবাদ জানিয়েছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী।

গতকাল ১৩ মার্চ 'জনাব মো. নজরুল ইসলাম ওরফে আসিফ নজরুলের অশালীন ও অসত্য বক্তব্যের প্রতিবাদ' শিরোনামে দ্য ডেইলি স্টারের কাছে পাঠানো প্রতিবাদলিপিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান দাবি করেন, তিস্তা বিষয়ে তার বক্তব্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে আসিফ নজরুল যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে তার সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান প্রতিবাদলিপিতে বলেন, 'তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যা নিয়ে আমার (ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী) একটি সাম্প্রতিক বক্তব্যকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব মো. নজরুল ইসলাম ওরফে আসিফ নজরুল আপনার পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আমাকে হেয় করে অশালীন ও অসত্য বক্তব্য দিয়েছেন।'

'তিনি আমার বক্তব্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করেছেন এবং অপমানজনকভাবে মন্তব্য করে বলেছেন "সমস্যা হচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন পদে থাকা মানুষগুলো এমনভাবে কথা বলেন, যেন তারা বাংলাদেশের সরকার নয়, মনে হয় তারা ভারত সরকারের স্বার্থ দেখছেন। নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যকে আমি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক মনে করছি। এই বক্তব্যের পর এই পদে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার তার নেই। তাকে কথা বলতে হবে বাংলাদেশের স্বার্থে"।'

'আমি ভারতের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম যে, বাংলাদেশে তিস্তা নদীতে বড় বড় জলাধার তৈরি করে তাতে বর্ষার পানি ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে ব্যবহার করা যেতে পারে।'

'বছরখানেক আগে অনুরূপ একটি প্রস্তাব চীন সরকারও দিয়েছে। ওই সাক্ষাৎকারে আমি আরও বলেছিলাম যে, যেহেতু ভারত আমাদেরকে তিস্তার পানি দিচ্ছে না, তাই এইসব জলাধার তৈরির সমস্ত খরচ ভারতকেই বহন করতে হবে। যদি তারা এই খরচ বহনে অস্বীকৃতি জানায়, তবে ট্রানজিট মাশুল বৃদ্ধি করে জলাধার তৈরির খরচ উশুল করে নিতে হবে। আমি কোথাও বলিনি যে, তিস্তায় পানি নেই, তাই ভারত আমাদের পানি দিতে পারছে না। আমি বলেছি, ভারত আমাদের তিস্তার পানি দিচ্ছে না—গজলডোবা ব্যারেজ থেকে মহানন্দার লিংক ক্যানাল দিয়ে তিস্তার সব পানি নিয়ে যাচ্ছে। এটাও বলেছি, সম্ভবত ভবিষ্যতেও ভারত তিস্তা থেকে পানি আমাদের দেবে না। আমার এই ধারণাএকেবারে অমূলক নয়। ২০১১ সালে তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একযুগ পার হয়ে গেছে। চুক্তিও হয়নি, শুকনো মৌসুমে পানিও দেয়নি। এই বাস্তবতায় আমাদের একমাত্র পথ হচ্ছে বর্ষার সময়ে পানি ধরে রেখে তা শুকনো মৌসুমে ব্যবহার করা। এইভাবেই আমরা শুকনো মৌসুমে পানির জন্য ভারত নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে চাই।'

'তিস্তার পানি নিয়ে সাক্ষাৎকারে এই কথাগুলো আমি ব্যক্তিগতভাবে বলেছি। আমার সেই সাক্ষাৎকারে পরিষ্কারভাবে বলা ও লেখা আছে যে,আমার এইসব মতামত কোনোভাবেই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কিংবা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের চেয়ারম্যান হিসেবে নয়।'

'একজন ব্যক্তি তার সরকারি বা বেসরকারি দায়িত্বের বাইরেও নিজের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করতে পারেন। আসিফ নজরুল তো প্রতিনিয়ত টিভিতে এসে বিভিন্ন কথা বলেন। তার এইসব বক্তব্য কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তব্য? নিঃসন্দেহে নয়। ব্যক্তিগতভাবে তার এইসব বক্তব্য দেওয়ার জন্য কেউ কি তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করতে বলেছেন? আমার জানা মতে এমন দাবি কেউই করেননি। তিনি বলেছেন, আমার নাকি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। আমাকে নিয়ে করা তার বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা দাবি করছি।'

প্রতিবেদকের বক্তব্য

সম্প্রতি তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের আওতায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার আরও ২টি খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক নদী আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় এবং সেটি প্রকাশ করা হয়। সেখানে অধ্যাপক আসিফ নজরুল তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। দ্য ডেইলি স্টার এ ক্ষেত্রে কোনো মতামত প্রকাশ করেনি।

প্রতিবাদে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী উল্লেখ করেন, 'আমি বলেছি, ভারত আমাদের তিস্তার পানি দিচ্ছে না...।' অথচ ভারতের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, 'বাস্তবসম্মতভাবে বলতে গেলে, পশ্চিমবঙ্গ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে পানি দিতে পারবে না।' (Realistically speaking, Bengal will not be able to divert water to Bangladesh during the lean season; Daily Telegraph, 10 February)। এখানে 'দিচ্ছে না' আর 'দিতে পারবে না' সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহন করে।

দ্য ডেইলি স্টারকে পাঠানো প্রতিবাদে ড. মনজুর বলেছেন, 'তিস্তার পানি নিয়ে সাক্ষাৎকারে এই কথাগুলো আমি ব্যক্তিগতভাবে বলেছি। আমার সেই সাক্ষাৎকারে পরিষ্কারভাবে বলা ও লেখা আছে যে, আমার এইসব মতামত কোনোভাবেই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কিংবা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ এর চেয়ারম্যান হিসেবে নয়।'

ড. মনজুর আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলনে বাংলাদেশের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে অংশগ্রহণ করে দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে সাক্ষাৎকার দেন। এখন তিনি সেই বক্তব্যকে 'ব্যক্তিগত মতামত' হিসেবে দাবি করছেন।

টেলিগ্রাফে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও ড. মনজুরকে বাংলাদেশের 'একজন নীতি-নির্ধারক' ও 'জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান' হিসেবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

প্রতিবেদনটির শুরুতেই বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের একজন নীতি-নির্ধারক বলেছেন যে বাস্তবসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা থেকে বাংলাদেশের অতিরিক্ত পানি পাওয়ার সুযোগ নেই। এরচেয়ে বাংলাদেশের উচিত ভারতের আর্থিক সহায়তায় বর্ষায় পানি সংরক্ষণে একটি জলাধার বা সংরক্ষণাগার তৈরি করা।'

Comments