ঢাকা-আরিচা রুটে মেট্রোরেল নির্মাণে মহাসড়কে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা সওজের

এমআরটি লাইন-৫ নির্মাণের কারণ সওজের মহাসড়ক সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হবে। এটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ককে 'মরণফাঁদে' পরিণত করতে পারে।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব অনুযায়ী মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করা হলে দীর্ঘ যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) প্রকৌশলীরা।

তারা বলছেন, ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৫ (নর্দান রুট) নামে পরিচিত মেট্রোরেল লাইনের নির্মাণের কারণ সওজের মহাসড়ক সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হবে। এটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ককে 'মরণফাঁদে' পরিণত করতে পারে।

সওজ প্রকৌশলীরা জানান, হেমায়েতপুর ও আমিনবাজারের মধ্যে প্রস্তাবিত মেট্রোরেল রুট নিয়ে অনেক আগেই উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি এবং এর পরিবর্তে একটি বিস্তারিত নকশা তৈরি করেছে।

এমআরটি লাইন-৫ প্রকল্পটি চলতি মাসের শেষের দিকে বা আগামী মাসের শুরুর দিকে নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। সওজ এবং ডিএমটিসিএল উভয়ই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের একই বিভাগের (সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ) অধীনে রয়েছে।

সওজ প্রকৌশলীদের আশঙ্কা প্রত্যাখ্যান করে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা সব কারিগরি দিক এবং মহাসড়ক সম্পর্কে সওজের ভবিষ্যত পরিকল্পনা বিবেচনা করে প্রস্তাবিত লাইনের বিস্তারিত নকশা তৈরি করেছে।

এমআরটি-৫ (নর্দান রুট) এর প্রকল্প পরিচালক মো. আফতাব হোসেন খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের এখন রুট পরিবর্তন করতে বলার অর্থ হচ্ছে শিগগির শুরু হতে যাওয়া মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ বাতিল করা।'

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া বিভিন্ন নথিতে সওজ প্রকৌশলীরা যে আশঙ্কা ও হতাশা প্রকাশ করেছেন তা প্রতিফলিত হয়েছে।

১৪টি স্টেশনসহ ২০ কিলোমিটার রেললাইন গাবতলী, মিরপুর ও গুলশান হয়ে হেমায়েতপুর ও ভাটারাকে সংযুক্ত করবে। হেমায়েতপুর থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত ৫ দশমিক ৬ কিলোমিটার এলিভেটেড এবং গাবতলী থেকে নতুনবাজার পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কিলোমিটার অংশ ভূগর্ভস্থ হবে। অবশিষ্ট শুন্য দশমিক ৯ কিলোমিটারও এলিভেটেড হবে।

হেমায়েতপুরে ডিপো নির্মাণের মাধ্যমে ৪১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকার প্রকল্পটির ভৌত নির্মাণ কাজ শুরু হবে। আফতাব হোসেন বলেন, 'মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করেছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মাসের শেষের দিকে বা আগামী মাসের শুরুতে প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।'

ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক রাজধানীকে উত্তর ও দক্ষিণের কয়েকটি জেলার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। গাবতলী ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটের মধ্যবর্তী প্রধান বাস স্টপ ও বাজার এলাকায় ডেডিকেটেড সার্ভিস লেন ও বাস বে নির্মাণে ৬৯৬ কোটি টাকা ব্যয় করছে সওজ।

এ ছাড়া, মহাসড়কের গাবতলী থেকে নবীনগর অংশকে এক্সপ্রেসওয়েতে রূপান্তরের জন্য ২০২১ সালে একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করে সওজ।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, একই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দুটি সংস্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবকে প্রতিফলিত করে।

মহাসড়কে স্টেশনসহ মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করা হলে তা ভবিষ্যতে মহাসড়ক সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে যোগ করেন তিনি।

সোমবার দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'এটি অন্যতম প্রধান মহাসড়ক। মহাসড়কের গুরুত্ব বিবেচনা করে একে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল।'

তিনি আরও বলেন, যেহেতু সওজ নকশা করার সময়েই বিষয়টি উত্থাপন করেছে, তাই ডিএমটিসিএলের এটি বিবেচনা করা উচিত ছিল।

বিতর্ক

প্রস্তাবিত মেট্রোরেল রুট সম্পর্কে সওজের আপত্তি উত্থাপন করার পর ২০২১ সালের ২৩ মার্চ একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সওজ ও ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে সওজ কর্মকর্তারা বলেন, হাইওয়ের জায়গা কমিয়ে মেট্রোরেল অবকাঠামো টেকসই হবে না। তাই তারা মেট্রো লাইনের হেমায়েতপুর থেকে আমিনবাজার অংশকে হয় দক্ষিণে সরানো বা মাটির নিচে নেওয়ার অনুরোধ জানান।

তবে এমআরটি-৫ প্রকল্পের পরিচালক আফতাব হোসেন খান সভায় বলেন, স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) বা সংশোধিত এসটিপি অনুযায়ী সওজের জায়গায় লাইনটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কারিগরি সমস্যা এবং মহাসড়কে যানবাহনের ভারী প্রবাহের কারণে লাইনটি দক্ষিণে সরানো যাচ্ছে না।

আবার বৈঠকে বসে কাগজপত্র চূড়ান্ত করার কথা ছিল, যা সিদ্ধান্তের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান হয়নি। ইতোমধ্যে, ডিএমটিসিএল প্রস্তাবিত রুট অনুসরণ করে লাইনের নকশার ৯০ শতাংশ সম্পন্ন করেছে।

এই বছরের ২৩ মার্চ সওজ এবং ডিএমটিসিএল কর্মকর্তাদের মধ্যে আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকের কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান হেমায়েতপুর ও বালিয়াপুর স্টেশন উত্তরে স্থানান্তরের জন্য ডিএমটিসিএলকে অনুরোধ করেন।

ঢাকা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আহাদ উল্লাহ বলেন, মহাসড়কের মাঝখানে মেট্রো লাইন নির্মাণ করা উচিত নয়। তিনি আরও বলেন, বিআরটি লাইন নির্মাণের কারণে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মতোই নির্মাণকালে মহাসড়কে তীব্র যানজট দেখা দিতে পারে।

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ডেডিকেটেড বাস লাইন বিআরটি লাইন-৩ নির্মাণের কারণে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী-গাজীপুর অংশে বছরের পর বছর ধরে যানজট তৈরি হচ্ছে।

সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, সড়ক ও জনপথের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (কারিগরি সেবা) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, প্রস্তাবিত রুট অনুসরণ করে লাইন নির্মাণ করা হলে মহাসড়কের ভবিষ্যত সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হবে।

সভার কার্যবিবরণীতে আরও বলা হয়, হাইওয়ের দক্ষিণ পাশে পর্যাপ্ত জমি রয়েছে এবং 'সওজের জমি ব্যবহার না করে মেট্রোরেলের নকশা পর্যালোচনা করা এখনও সম্ভব'।

সওজ সূত্র জানায়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরি ১৬ জুন প্রকল্পের স্থান পরিদর্শন করেন এবং সওজের উদ্বেগ উপেক্ষা করে ডিএমটিসিএল পরিকল্পনার অনুমোদন দেন।

সচিব বর্তমানে বিদেশে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

সূত্র জানায়, এরপর গত ২২ জুন ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় থেকে ঢাকা সার্কেল অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।

চিঠিতে বলা হয়, হেমায়েতপুরে একটি স্টেশন ও ডিপো নির্মাণের ফলে প্রস্তাবিত গাবতলী-নবীনগর এক্সপ্রেসওয়ে এবং পরিকল্পিত ঢাকা আউটার সার্কুলার রোডের জন্য বড় ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণের পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করবে। এটি সেখানে একটি স্থায়ী বাধাও তৈরি করবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, মহাসড়কে মেট্রোরেল লাইনের বেশিরভাগ কাঠামো নির্মাণ করা হবে, যা চালকদের দৃশ্যমানতা বাধাগ্রস্ত করবে এবং একইসঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করবে এবং যানবাহনের গতি হ্রাস করবে।

এ ছাড়া, এমআরটি লাইন সাধারণত শহরের অভ্যন্তরে তৈরি করা হয়, যেখানে যানবাহনের গতিসীমা কম থাকে। তবে হাইওয়েতে উচ্চগতির আন্তঃজেলা যানবাহন চলাচল করে এবং এতে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে।

যোগাযোগ করা হলে সওজের সবুজ উদ্দিন খান বলেন, কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছে। তবে প্রস্তাবিত রুটে মেট্রোরেল নির্মাণ হতে যাচ্ছে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমরা এক্সপ্রেসওয়ের রুট পরিবর্তন করব কারণ এটি শুরু করতে আরও সময় লাগবে। দুটি প্রকল্পই সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।'

যোগাযোগ করা হলে প্রকল্প পরিচালক এবং সওজের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আফতাব হোসেন খান বলেন, সওজের যুক্তিতে কারিগরি মূল্যায়নের অভাব রয়েছে এবং আবেগের বশবর্তী হয়ে করা।

নির্মাণকালে হেমায়েতপুর পয়েন্টে মহাসড়কের উত্তর পাশের দুই লেন বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, যানবাহন চলাচল নিরবচ্ছিন্ন রাখতে তারা দুই লেন ব্লক করার আগে দক্ষিণ পাশে দুটি লেন নির্মাণ করবেন।

রুটের অন্যান্য অংশে কোনো সমস্যা হবে না বলেও জানান তিনি।

Comments