পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ: মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে ধীরগতি

এপ্রিল মাসে প্রকাশিত ২০২১ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস এর প্রতিবেদনে বলা হয়, পল্লী অঞ্চলে পাঁচ বছরের কম বয়সি ৭ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। শহরাঞ্চলে এই সংখ্যা কিছুটা কম হলেও তাও শতকরা ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
ছবি: সংগৃহীত

'সকালবেলা আমি আমার স্ত্রীকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার দেখাইতে গেছিলাম। পোলাপাইনগুলারে আমার মায়ের কাছে রাইখা গেছিলাম। ১২টার দিকে আমার চাচতো ভাই ফোন দিয়া কয়, জলদি বাড়িত আয়। তোর পোলা আর মাইয়া পানিত পইড়া গেছে। আমরা বাড়িত যাইয়া দেখি বাড়ির ধারে খাদের পাশে মানুষের ভিড়। গিয়া শুনি আমার মাইয়া আর ভাইয়ের মাইয়াডা গর্তের পানিতে ডুইবা মইরা গেছে। বড় পোলাটারে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়া গেলে ডাক্তার কইলো পোলাডাও মইরা গেছে।'

একদিনে পানিতে ডুবে তিন সন্তানের মৃত্যুর বর্ণনা দিতে গিয়ে গলা ধরে আসে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ইটবাড়িয়া গ্রামের সোহেল ফকিরের।

গত ১২ মে গ্রামে বাঁধ নির্মাণের জন্য বাড়ির পাশে গর্ত করে মাটি কাটায় বৃষ্টিতে গর্তে পানি জমেছিল। অসাবধানতাবশত ৬-৭ ফুট গভীর সেই গর্তের পাশে খেলতে গিয়ে ডুবে গিয়ে মারা যায় তিন শিশু।

পটুয়াখালী জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, কেবল ৫ জুন একদিনেই পটুয়াখালী জেলায় পানিতে ডুবে ৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

২০২২ সালের জুলাই মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে জানায় প্রতি বছর বাংলাদেশে পানিতে ডুবে ১৪ হাজারের বেশি শিশু মারা যায়। যা ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ।

অন্যদিকে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত ২০২১ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস এর প্রতিবেদনে বলা হয়, পল্লী অঞ্চলে পাঁচ বছরের কম বয়সি ৭ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। শহরাঞ্চলে এই সংখ্যা কিছুটা কম হলেও তাও শতকরা ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।

সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ডিরেক্টর অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৬ সালে আমাদের করা জরিপে দেখা যায় পানিতে ডুবে বছরে ১৪ হাজার ৪৩৮ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সামগ্রিক সংখ্যানুপাতে আমরা দেখেছি প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০ শিশু পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'আমরা জরিপে একইসঙ্গে দেখেছিলাম সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এই সময়টিতে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু বেশি। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুকে আমরা তিন ভাবে ব্যাখ্যা করেছি। সেগুলো হলো- silent killer (গোপন ঘাতক), neglected (অবহেলাজনিত) এবং unrecognized (অস্বীকৃত)।'

পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কেমন

২০২২ সালের ১২ মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মারা যাওয়া ১১৩০টি মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান সমষ্টি। গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের সহযোগিতায় প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে ৯৮ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে। তাদের মধ্যে ৮১ শতাংশের বয়স ৯ বছরেরও কম। ৬১ শতাংশ শিশুরই চার বছর পূর্ণ হয়নি। যে সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়েছে।

প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনের সূত্রে জানা যায় পানিতে ডুবে সর্বাধিক ২৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ মারা গেছে চট্টগ্রাম বিভাগে। সবচেয়ে বেশি পানিতে ডুবে মারা যায় আগস্ট মাসে।

শিশু মৃত্যু নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, 'বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার খবর সংবাদপত্রে উঠে আসে না। পানিতে ডুবে মৃত্যু, অপমৃত্যু হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও আইনি জটিলতার কারণে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া অধিকাংশ শিশুর মৃত্যুই আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। যার ফলে কখনোই পুরোপুরি প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয় না।

পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব

২০২২ জুলাই মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ জানিয়েছিল পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হওয়া সত্ত্বেও পানিতে ডুবে প্রতিটি মৃত্যুই প্রতিরোধযোগ্য।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে দশটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছে। এই কৌশলগুলোর মধ্যে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ' করা গবেষণা থেকে তিনটি কৌশলকে সবচেয়ে কার্যকরী হিসেবে মতামত দিয়েছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ডিরেক্টর ড. ফজলুর রহমান বলেন, 'পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর জন্য আমরা তিনটি বিষয়কে সবসময় জোর দিয়েছি। যেটি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকেও সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এই তিনটি কৌশল হলো '৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন', '৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার শেখানো', এবং 'শিশুদের নিরাপত্তা ঝুঁকি হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি'।' ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য আমরা যে দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন তার নাম দিয়েছি আঁচল। আঁচলের ধারণাটি এজন্যই এসেছে যে, যখন আমরা জরিপ চালালাম তখন দেখলাম সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে মায়েরা তাদের সন্তানদের এই সময়টাতে নজরদারী সত্ত্বেও তারা পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। তাই আমরা প্রতিটি আঁচল কেন্দ্রের মাধ্যমে গ্রামের একজন নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দেখভালের জন্য নিয়োজিত রেখেছি। যেন এই সময়টিতে শিশুরা নিরাপদে থাকে।  আমাদের গবেষণায় আমরা দেখছি যেসব অঞ্চলে আঁচলের অধীনে কেন্দ্র রয়েছে সেখানে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু ৮৬ শতাংশ কমেছে।

আমরা গবেষণায় দেখেছি দেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধ করতে হলে প্রায় ৬ লাখ কেন্দ্রের প্রয়োজন হবে। তবে আশার কথা এটি যে আমাদের প্রস্তাবনা উপর ভিত্তি করে সরকার গত বছর থেকে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে।'

সরকারের প্রকল্প চলছে ঢিমেতালে

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রস্তাবিত সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু-যত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ৩ বছর মেয়াদি 'শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতার সুবিধা প্রদান' শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। প্রকল্পটির ক্ষেত্রে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চের (সিআইপিআরবি) করা গবেষণাই কাজে লাগাচ্ছে সরকার। প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করছে ব্লুমবার্গ ও রয়্যাল নেশন লাইফবোট ইন্সটিটিউট।

প্রকল্পের প্রস্তাবনায় নির্ধারণ করা হয়েছে হয়েছে, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় শিশু একাডেমির ১৬টি নির্ধারিত জেলায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

জেলাগুলো হলো বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, নীলফামারী, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ।

এই জেলাগুলোতে মোট ৮ হাজার সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশু যত্ন কেন্দ্র স্থাপন করে প্রতিটি কেন্দ্রে ২৫ জন শিশুকে ভর্তি করে ৫ বছরের কম বয়সী মোট ২ লাখ শিশুকে এই সেবা প্রদান করা হবে। পাশাপাশি ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের জন্য সুইমসেফ নামের উচ্চমানের প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর ভিত্তিতে প্রতি জেলায় ১০০টি করে মোট  ১৬০০ ভেন্যুতে মোট ৩ লাখ ৬ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানো হবে। যদিও এই প্রকল্পটি চলছে অনেকটাই ধীরগতিতে।

৩ বছর মেয়াদি প্রকল্পের দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও ইতোমধ্যে মাত্র ছয়টি জেলাতে প্রকল্প শুরু করতে পেরেছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। তবে এর মধ্যে পটুয়াখালী ও বরগুনার তিনটি উপজেলায় আগে থেকেই কার্যক্রম চালাচ্ছে সিআইপিআরবি। আট হাজারের মধ্যে যে ৩ হাজারের মতো শিশু যত্ন কেন্দ্রে কার্যক্রম চলছে তাও সিআইপিআরবি করা। নতুন করে কোন কেন্দ্র স্থাপন করতে পারেনি সরকার।

প্রকল্পের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্পটির প্রোগ্রাম ম্যানেজার তারিকুল ইসলাম চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেহেতু এটি সম্পূর্ণ নতুন প্রকল্প ছিল তাই শুরুতে পরিকল্পনায় আমাদের অনেকটা সময় লেগেছে। অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের আদেশ পেতেও আমাদের কিছুটা দেরি হয়েছে। যার ফলে গত বছরের মে মাস থেকে আমরা কাজ শুরু করতে পেরেছি। তিন বছর যথেষ্ট সময় নয়। এটি বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাছাড়া জনবলও পুরোপুরি নিয়োগ করা হয়নি। তবে আমরা আশা করছি আগামী অর্থবছর নাগাদ এই দুটি জেলার মতো বাকি জেলাগুলোতেও আমরা কার্যক্রম শুরু করতে পারব।'

Comments