নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে লাখো মানুষ

সিইজিআইএস বলছে, গত ২২ বছরে পদ্মা ও যমুনা নদীর ভাঙনে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছে।
টাঙ্গাইলের মাটিকাটা গ্রামে যমুনার নদীভাঙনের স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন হাশেম আলী মুন্সি (বামে)। ছবি: স্টার

টাঙ্গাইলের মাটিকাটা গ্রামে নদীভাঙনের স্থানে দাঁড়িয়ে ৯০ বছর বয়সী হাশেম আলী মুন্সি বলছিলেন, যমুনার তীর আগের মতোই বদলে যাচ্ছে। এই নদী তার যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে, সেই আক্ষেপ তার চোখে-মুখে তখন স্পষ্ট।

এক সময় কৃষক হাশেম আলীর ভালো পরিমাণ জমিই ছিল। কিন্তু নদীভাঙন তার বসতবাড়ি ও আবাদি জমি—উভয়ই গ্রাস করেছে।

'১২ বছর আগে নদীটি আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে ছিল। আর এখন নদীটি আমাদের গ্রামের বৃহৎ অংশ গ্রাস করে ফেলেছে। জমি হারানোর পর গ্রামের কৃষকরা পেশা বদলে দিনমজুরি বা রিকশা চালানো শুরু করে', বলেন হাশেম আলী।

গত ১২ বছরে যমুনা নদীর ভাঙনের শিকার ভূঞাপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম।

বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজারো হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এতে নদীতীরে বসবাসকারী মানুষ গৃহ-ভূমিহীন হয় এবং তারা নিকটবর্তী বাঁধ এলাকা, চর কিংবা শহুরে বস্তিতে গিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হন।

গত ২২ বছরে শুধু পদ্মা ও যমুনার ভাঙনে ৫০ হাজার ৯৫৫ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে, যা সেন্টমার্টিন দ্বীপের চেয়ে ৬ গুণ বড়। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) তথ্য অনুযায়ী, যমুনায় ২৫ হাজার ২৯০ হেক্টর ও পদ্মায় ২৫ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে।

সিইজিআইএস বলছে, গত ২২ বছরে এই দুই নদীর ভাঙনে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছে।

বাংলাদেশ একটি সক্রিয় বদ্বীপ। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ প্রধান নদীগুলোর প্লাবনভূমিতে বাস করে, যা ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের মধ্যে ২০ লাখ মানুষ চরাঞ্চলে বসবাস করে বলে বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

'যমুনা-মেঘনা নদী ভাঙন নিরসন প্রকল্প' শীর্ষক এডিবির আরেকটি নথিতে বলা হয়েছে, প্রধান নদীগুলোর তীরবর্তী আনুমানিক ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার জায়গা ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতি বছর আনুমানিক ১০ হাজার হেক্টর জমি ভাঙনের কবলে পড়ে, যার প্রভাব পড়ছে এক লাখেরও বেশি মানুষের ওপর।

এ বছর পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, তিস্তা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙনে কুড়িগ্রাম, বগুড়া, জামালপুর, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

মেঘনার উপনদী জয়ন্তীর তীরে বসেছিলেন শরীয়তপুরের গোসাইরহাট এলাকার সাইক্কা গ্রামের ইয়ারুন্নেছা বেগম (৬৫)। তার বেশিরভাগ ফসলি জমি ও বাড়ি নদীগর্ভে হারিয়ে গেলেও হাশেম আলীর মতো স্থির থেকে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারেননি তিনি। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট ছিল হতাশা।

বর্তমানে ইয়ারুন্নেসা বিধবা, তার ৫ মেয়ে রয়েছে। 'গত বছর নদী আমার ২৬ শতক ফসলি জমি গ্রাস করেছে। এখন আবার নদীভাঙন শুরু হয়েছে। এখন বাকি আছে কেবল আমার বাড়ির উঠানটুকু', বলেন ইয়ারুন্নেসা।

শরীয়তপুরের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন স্বপন জানান, তার পুরো ইউনিয়ন নদীবেষ্টিত এবং ইতোমধ্যে তার ইউনিয়নের ২০২ হেক্টর জমি জয়ন্তী নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ও শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম এনামুল হক শামীম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ২ বছর আগে তার জেলার ভাঙনপ্রবণ এলাকা পরিদর্শন করেন। এরপর থেকে ভাঙনের সময় পাউবো নদীতীরে কিছু জিও ব্যাগ ফেলে।

তবে জিও ব্যাগ ফেলে কার্যকরী কোনো ফল পাওয়া যায়নি বরে জানান নাসির উদ্দিন স্বপন।

যেহেতু সরকারি এই উদ্যোগ গ্রামবাসীদের জন্য তেমন আশার আলো দেখাচ্ছে না, তাই ইয়ারুন্নেসার মতো মানুষের কাছে তাদের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

বসতবাড়ির অবশিষ্ট অংশটুকুও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে পথে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না বলে জানান ইয়ারুন্নেসা।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কৃষক শংকর কুমার বৈদ্য কয়েক বছর আগে খোলপেটুয়া নদীর ভাঙনে তার বসতবাড়ি হারিয়েছেন। বর্তমানে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বরের একটি বস্তিতে থাকেন এবং ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করেন।

'বসতভিটা হারানোর পর আমি আমার বাড়ি ভেঙে অন্য গ্রামে চলে যাই। সেখানে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করেছি এবং ইজারা নেওয়া এক টুকরো জমিতে চিংড়ি চাষ করে আমার ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার খামারে ভাইরাস সংক্রমণ দেখা দিলে ক্ষতির সম্মুখীন হই। তাই ঢাকায় চলে আসা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না', বলেন শংকর।

মেঘনা নদী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে হাতিয়া উপজেলার নবনির্মিত কেয়ারিংচরে ২০০৭ সালে ঘর নির্মাণ করেন হাতিয়ার আব্দুল জলিল।

'কিন্তু মেঘনার ভাঙন শুরু হলে ২০১০, ২০১৩ ও ২০১৮  সালে ৩ বার আমি বাড়ি ভেঙে ফেলি। অবশেষে ২০২০ সালে কেয়ারিংচর ছেড়ে হাতিয়া শহরে চলে আসি', বলছিলেন জলিল।

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পাউবোর মনিটরিং সেলের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫০টিরও বেশি জেলায় প্রতিবছর নিয়মিত নদীভাঙনের ঘটনা ঘটছে।

চলতি বছরের ১১ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর তীরবর্তী এক হাজার ৫৩টি স্থানে মোট ২৩১ কিলোমিটার জায়গা নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে। তবে পাউবো বলছে, তারা দেশের সব ভাঙনকবলিত এলাকা পর্যবেক্ষণ করে না।

পাউবোর প্রকৌশলী রাশিদুল কবির বলেন, 'নদীতীরে কী পরিমাণ জমি বিলীন হয়েছে, তা আমরা পর্যবেক্ষণ করি না। তবে ভাঙনকবলিত ওইসব নদীতীরের দৈর্ঘ্য আমরা পর্যবেক্ষণ করি। ভাঙনরোধে যেসব এলাকায় উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, সেখানে আমরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিই।'

বর্তমানে পাউবো ২৪৬টি স্থানের ভাঙনরোধে উদ্যোগ নিয়েছে বা কাজ চলমান।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীভাঙন বাংলাদেশে একটি প্রচলিত সমস্যা এবং প্রতি বছর হাজারো মানুষ এর কারণে গৃহহীন হয়ে পড়ে।'

'সরকারের কাছে টিন ও শুকনো খাবারের মজুত আছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আমরা শুকনো খাবার ও টিন সরবরাহ করি, যাতে তারা অবিলম্বে অস্থায়ী বাড়ি তৈরি করে সেখানে বসবাস করতে পারে।'

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো নদীভাঙনের শিকার দেশ বিশ্বে আর নেই। যমুনা নদী প্রায়শই তার চ্যানেল পরিবর্তন করে, যার ফলেই নদীভাঙন ঘটে।

সিইজিআইএসের উপদেষ্টা ড. মমিনুল হক সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশের নদীগুলোর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কারণ এগুলো হিমালয় থেকে নেমে আসার সময় বিপুল পরিমাণ পলি নিয়ে আসছে, নতুন চরভূমি তৈরি করছে এবং ভাঙন সৃষ্টি করছে। বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন বৈশিষ্ট্যযুক্ত নদী নেই।'

তিনি বলেন, 'কিছু কিছু এলাকায় আমরা দেখতে পাই যমুনার অনেকগুলো চ্যানেল রয়েছে এবং এটি গড়ে ১১-১২ কিলোমিটার চওড়া। ভাঙনরোধে ভাঙনপ্রবণ নদীগুলোতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেওয়া পর্যন্ত ভাঙনরোধ সম্ভব নয়।'

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে এবং এর ফলে বন্যা ও নদী প্রবাহের বেগ বাড়ছে। এর ফলে বাড়ছে নদী ভাঙনও।'

তিনি বলেন, 'আমি যতদূর জানি, সরকারের কোনো সংস্থা সারাদেশে নদীভাঙনের কোনো রেকর্ড রাখছে না। আমাদের ৪০০টিরও বেশি নদী রয়েছে এবং সব নদীর ভাঙনের ওপর নজর রাখা সত্যিই খুব বড় একটি কাজ।'

গ্রামে ভাঙনরোধে পর্যাপ্ত উদ্যোগ না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, 'নদীভাঙন রোধে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আগে সরকার ব্যয় সুবিধা বিশ্লেষণ করে থাকে।'

তিনি বলেন, 'স্বাভাবিকভাবেই যেসব শহর বা শহরের জমি গ্রামের ফসলি জমির চেয়ে বেশি মূল্যবান, সেসব এলাকা সরকারি উদ্যোগে অগ্রাধিকার পায়।'

এ ছাড়াও, উচ্চ পলিযুক্ত নদীগুলো সব সময় ভাঙনপ্রবণ এবং বাঁধ নির্মাণের পরেও এগুলোতে ভাঙন হতে পারে।

ভাঙনপ্রবণ এলাকা থেকে জনগণকে রক্ষায় একটি বিস্তৃত জাতীয় কৌশলের কথা উল্লেখ করে ইউএনডিপির প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট আরিফ আবদুল্লাহ খান বলেন, 'বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য বাংলাদেশের একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রয়োজন। উন্নয়ন বিনিয়োগ ও ঝুঁকি হ্রাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের মাধ্যমে বাস্তুচ্যুতদের মূলধারায় এনে কাজটি করতে হবে।'

(ডেইলি স্টারের টাঙ্গাইল ও শরীয়তপুর প্রতিনিধি এই প্রতিবেদনটির জন্য তথ্য দিয়েছেন)

Comments