ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে রেলের ভাড়া বাড়লেও যাত্রীসুবিধা বাড়েনি

ছবি: স্টার

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ট্রেনের ভাড়া বাড়লেও সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি বলে এই রুটে নিয়মিত চলাচল করা যাত্রীদের অভিযোগ। তারা বলছেন, আগের মতোই শিডিউল বিপর্যয়, ট্রেন বিকল, ব্যবহারের অযোগ্য টয়লেট, লাইট ও ফ্যান নষ্ট থাকার সমস্যা এখনো রয়ে গেছে।

অপরদিকে ট্রেনের সংখ্যা কমানোয় কোনো কারণে ট্রেন ধরতে না পারলে অপেক্ষা করতে হয় দুই ঘণ্টা। আগে ৩০ মিনিট পরপর ট্রেন ছেড়ে যেত স্টেশন থেকে।

এমন অবস্থায় এ রুটে ট্রেনের ভাড়া কমিয়ে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবি তুলেছেন যাত্রীরা। একই দাবি নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও নাগরিক সংগঠনেরও।

তারা বলছেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারের ভর্তুকি পাওয়া একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। অন্য যানবাহনের মতো ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।

সড়ক পরিবহন মালিকদের সুবিধা দিতেই রেলের সাশ্রয়ী সেবা থেকে যাত্রীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।

রেল কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজের কারণে দীর্ঘ ৮ মাস বন্ধ থাকার পর গত ১ আগস্ট এই রুটে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়। আগে এই রুটে মেইল ট্রেন চলাচল করলেও এখন কমিউটার ট্রেন চলাচল করে। কমিউটার ট্রেনের ভাড়া সর্বনিম্ন ২০ টাকা। মেইল ট্রেনের ভাড়া ছিল ১৫ টাকা।

নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার কামরুল ইসলাম খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মেইল ট্রেনের চেয়ে কমিউটার ট্রেনে যাত্রীসুবিধা বেশি। সেই কারণে ট্রেনের ভাড়াও ৫ টাকা বেশি। যদিও যাত্রীরা বাড়তি কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না।'

দেশে লোকাল, মেইল, কমিউটার ও ইন্টারসিটি—এই ৪ ধরনের ট্রেন চলাচল করে। লোকাল ট্রেনে সর্বনিম্ন ৫ টাকা এবং ইন্টারসিটিতে সর্বনিম্ন ৩৫ টাকা ভাড়া। তবে নামে ভিন্নতা থাকলেও আদতে সেবার কোনো পার্থক্য নেই বলে জানান যাত্রীরা।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচলকারী ট্রেনের চালক নূর হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এসব ট্রেনের নামেই শুধু পার্থক্য। মেইল ট্রেনও যা কমিউটার ট্রেনও তা।'

গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টায় স্টেশনে একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাতে বসা যাত্রীদের চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। কথা বলে জানা গেল, সকাল ৬টা ৫ মিনিটে যে ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ছাড়েনি।

স্টেশনমাস্টার জানান, ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দেওয়ায় ট্রেনটি স্টেশন ছাড়েনি। ইঞ্জিনের ত্রুটি মেরামতের পর ৮টা ২০ মিনিটে স্টেশন ছাড়ে ট্রেনটি। একই কারণে কমলাপুর স্টেশন থেকে ৯টা ২০ মিনিটে যে ট্রেনটি ছাড়ার কথা ছিল, তা ছাড়ে ৯টা ৪৮ মিনিটে।

রাজধানীর মহাখালীর বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী সীমা আক্তারকে সকাল ১০টায় অফিসে প্রবেশ করতে হয়। সকালের প্রথম ট্রেনটি ধরার জন্য ৬টার সময় তিনি স্টেশনে চলে আসেন। কিন্তু সেই ট্রেন ছাড়ে ২ ঘণ্টা পর। ট্রেন যখন কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছায় তখন বাজে ৯টা।

সীমা আক্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সকাল ৬টা থেকে বসে ছিলাম। ট্রেন ছাড়তে ১০ মিনিট করতে করতে ২ ঘণ্টা পার করেছে, কিন্তু ছাড়েনি।'

গত ২ বছর ধরে এই রুটে নিয়মিত চলাচল করছেন সীমা। সময়মতো ট্রেন স্টেশনে না আসা এবং না ছাড়ার ঘটনা প্রায় সময়ই ঘটে বলে অভিযোগ করেন এই যাত্রী।

একই অভিযোগ অন্য যাত্রীদেরও। তারপরও অর্থ ও সড়কপথের যানজট এড়িয়ে সময় সাশ্রয়ে ট্রেনে যাতায়াত করতে বাধ্য হন তারা।

'এত এত সমস্যা, তারপরও যাওয়া তো লাগেই। বাসে শুধু গুলিস্তান যেতেই লাগে ৫৫ টাকা লাগে। তারপর তো আরও পথ আছে। এ কারণে টাকা ও সময় বাঁচাতে ট্রেনে উঠি,' বলেন সীমা।

এদিকে, সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনটির ৪টি বগি ঘুরে অন্তত ৭টি ফ্যান অকেজো দেখা যায়। রাতে অধিকাংশ লাইটও জ্বলে না বলে জানান যাত্রীরা। প্রতিটি বগির টয়লেট ব্যবহার-অযোগ্য। কোনোটির কলেই ছিল না পানি এবং পানির রাখার পাত্রও দেখা যায়নি।

সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার বাসিন্দা খুশবুন নাহার নিয়মিত ট্রেনে ঢাকায় যাতায়াত করেন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ট্রেনের কোনো টয়লেটই ব্যবহারের যোগ্য না। নারীদের জন্য তো নয়ই, পুরুষদের জন্যও না। টয়লেটে পানি রাখার পাত্র তো দূরে থাক, পানিই থাকে না।'

বাড়তি কোনো সুবিধা না দিয়ে ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই শিক্ষার্থী। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা ভাড়ায় চলাচল করার দাবি তার।

তিনি বলেন, 'ভাড়া অযথাই বাড়ানো হয়েছে। নতুন কোনো সুবিধা তো দিচ্ছে না। সবকিছু তো আগের মতোই। ফ্যান চলে তো, চলে না। তাহলে ভাড়া কেন বাড়বে?'

তবে আগের তুলনায় টিকিট বিক্রি বেড়েছে বলে জানান স্টেশনমাস্টার কামরুল ইসলাম। গত আগস্টে এ স্টেশন থেকে ৬০ হাজার টিকিট বিক্রি হয়েছে, যা আগে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার ছিল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথের নারায়ণগঞ্জ স্টেশন থেকে কমলাপুরের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। করোনা মহামারির আগে এই রুটে ১৬ জোড়া ট্রেন চলাচল করত। সে সময় ৩০ মিনিট পরপর একটি ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যেত।

কিন্তু করোনা সংকটের সময় এই ট্রেনের সংখ্যা কমিয়ে ৮ জোড়ায় আনা হয়। এরপর এই সংখ্যা আর বাড়ানো হয়নি। ফলে এখন দুই ঘণ্টা পরপর একটি ট্রেন স্টেশন ছেড়ে যায়।

রেলওয়ের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলমান ডুয়েল গেজ রেললাইন প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ট্রেন ও বগির সংখ্যা বাড়ানো হবে।

২০১৪ সালে নেওয়া এই প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি। গত ২৫ জুলাই নারায়ণগঞ্জে এই প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনে এসে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যায়নি।

যদিও প্রকল্পের ব্যয় ৬৫৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকায় দাঁড়ালেও তখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের ৮২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান রেলমন্ত্রী।

স্টেশনমাস্টার বলেন, 'ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ডুয়েল গেজ লাইনের কাজ চলছে। এ কারণে ট্রেনের ক্রসিং করানো সম্ভব হচ্ছে না। যার কারণে ৮টি ট্রেনের বেশি চালানোর সুযোগ এখন নেই। তবে কাজ শেষ হয়ে গেলে ট্রেন ও বগির সংখ্যা বাড়ানো হবে।'

তবে ভাড়া কমানোর ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান তিনি।

এদিকে ভাড়া কমানো, রেল ও বগির সংখ্যা বাড়ানোর দাবিতে আজ বুধবার মানববন্ধন কর্মসূচি করার কথা নারায়ণগঞ্জ যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের। আগামী ১০ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করারও ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।

সংগঠনটির আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া হওয়ার কথা ১০ টাকা। তারপরও ১৫ টাকা পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু কমিউটার ট্রেনের কথা বলে মূলত লোকাল ট্রেন চালিয়ে ২০ টাকা ভাড়া নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।'

'মূলত যাত্রীদের ট্রেনবিমুখ করার চিন্তা থেকেই ভাড়া বাড়ানো ও যাত্রীদের পর্যাপ্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। পরিবহন সিন্ডিকেটের সঙ্গে আঁতাত করেই এভাবে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

5h ago