২ মাসে ৩৪ মৃদু ভূমিকম্প, বড় মাত্রায় আঘাত হানার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কায় বাংলাদেশ
প্রতীকী ছবি | সংগৃহীত

গত দুই মাসে বাংলাদেশ ও এর আশেপাশে মৃদু মাত্রার প্রায় ৩৪টি ভূমিকম্প হয়েছে, যাকে উদ্বেগজনক লক্ষণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের ভাষ্য, মৃদু মাত্রার এসব ভূমিকম্প ইঙ্গিত দেয় যে, সামনে বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) ও ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যের বরাত দিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশে যেকোনো সময় একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। যদি তা ঘটে, তাহলে ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষকে উদ্ধার করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।'

'এই অঞ্চলে ৩৪টি মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি দেশের মানুষ অনুভব করেছে। এ ধরনের মৃদু ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দেয়', বলেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ বা এর আশেপাশের অঞ্চলে প্রতি দেড়শ বছরে সাত বা তারচেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। সেই হিসাবেও বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে।

সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে বাংলাদেশে পাঁচ দশমিক দুই মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ভারতের আসাম।

ইউএসজিএস অনুসারে, গোয়ালপাড়া থেকে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে ও গুয়াহাটির ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে উৎপন্ন ভূমিকম্পটির গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলটি ১৮৯৭ সালের আট দশমিক সাত মাত্রার ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি।

বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইতিহাস বিভাগের যৌথ এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু এরপরও আহসান মঞ্জিলসহ ১০টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশে বেশ কিছু চ্যুতি রয়েছে। এর মধ্যে ডাউকি চ্যুতি খুবই সক্রিয় ও বিপজ্জনক। ডাউকি ছাড়াও দেশের ভূমিকম্পের আরেকটি উৎস চট্টগ্রাম থেকে সিলেটের মধ্যকার ভূ-অভ্যন্তরীণ ৬২ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত একটি সাবডাকশন অঞ্চল। এই অঞ্চলে একটি ভিত্তিস্তরের (টেকটোনিক প্লেট) নিচে আরেকটি ভিত্তিস্তর তলিয়ে যেতে থাকে এবং এই অঞ্চলজুড়ে সক্রিয় মূল চ্যুতির অনেকগুলো শাখাও রয়েছে।

ঢাবির ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাবডাকশন অঞ্চলে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ এত বেশি যে এটি সম্ভবত বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। মৃদু মাত্রার এই ভূমিকম্পগুলো আমাদের সতর্ক করছে... বাংলাদেশে ভূমিকম্প আঘাত হানার বিষয়টি নিশ্চিত। কিন্তু কখন আঘাত হানবে, তা আমরা জানি না।'

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা মহানগরীতে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জাতীয় বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করে নির্মিত অনেক ভবন ভূমিকম্প হলে রাজধানীকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে।

অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, 'মানুষকে সচেতন করার মতো সময়ও আমাদের বাকি নেই। জীবন বাঁচাতে ত্রুটিপূর্ণ ভবনগুলো ঠিক করার এখনই সময়।'

তবে অধ্যাপক হুমায়ুনের মতে, ভূমিকম্প হলে মানুষ যাতে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পারে, সেজন্য জনগণকে সচেতন করা ও নিরাপদ স্থান চিহ্নিত করার ওপর সরকারের জোর দেওয়া উচিত।

তিনি মানুষকে সচেতন করতে নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া ও মোবাইল অ্যাপ তৈরির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

'কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা দেখতে পেয়েছি যে, সরকারের ফোকাস ভূমিকম্প-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের দিকে', বলেন তিনি।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দুটি প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ২০০ প্রকৌশলীকে কাঠামো নির্মাণ ও ভবন পরিদর্শন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।'

তুরস্কের ভূমিকম্পের পর সম্ভাব্য ভূমিকম্পের কথা মাথায় রেখে ঢাকা এই সংক্রান্ত কার্যক্রম ত্বরান্বিত করেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'অবশ্যই এগুলো যথেষ্ট নয়। আমরা ঢাকার পুরোনো ভবনগুলো পরীক্ষা করার জন্য একটি তৃতীয় পক্ষকে নিয়োগ দিতে এবং কীভাবে সেগুলোকে পুনরুদ্ধার করতে হবে, তা নির্ধারণের জন্য দুটি পেশাদার সংস্থার সঙ্গে কাজ করছি।'

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, টাঙ্গাইলের মধুপুর চ্যুতি থেকে উৎপন্ন ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে প্রায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে।

ভূমিকম্পটি দিনের বেলায় আঘাত হানলে প্রায় দুই লাখ ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে এবং আরও দুই লাখ ২৯ হাজার মানুষ আহত হতে পারে।

আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের অংশ হিসেবে ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপটি চালানো হয়।

Comments